প্রবাদ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উপলব্ধি করা সত্যকে মূর্তভাবে প্রকাশ করে

প্রবাদ (ইংরেজি: Proverb) হচ্ছে একটি সাধারণ, মূর্ত, ঐতিহ্যবাহী বক্তব্য যা সাধারণ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উপলব্ধি করা সত্যকে প্রকাশ করে। প্রবাদবাক্যগুলি প্রায়শ রূপক এবং সূত্রপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে। সম্মিলিতভাবে, তারা লোক কাহিনী (ইংরেজি: Folklore) এবং লোকসাহিত্যের একটি ঘরানা গঠন করে।

প্রবাদ সম্পর্কে বলা হয় ‘wit of one, wisdom of many’। যে কোনো প্রবাদই বহুকালের বহুজনের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে বিস্তৃত পরিচয় কোনো একজন মানুষের বাচনে স্বরূপধারণ করে। প্রায় সব প্রবাদের নেপথ্যেই কোনো একটি ঘটনা বা কাহিনি থাকে, যাকে উপলক্ষ করে বহুজনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত হয়। যেহেতু মানুষের সংস্কৃতির বিবর্তন সুনির্দিষ্ট আর্থসামাজিক উদ্বর্তনের ছক সারা বিশ্বেই একইভাবে গড়ে উঠেছে—তাই অনুরূপ অভিজ্ঞতা কিংবা একই অন্তকাঠামো (deep-structure)সম্পন্ন অভিজ্ঞতার নিরিখে, সারা পৃথিবীতে একই রকমের উপলব্ধির অভিব্যক্তি ঘটেছে। প্রবাদের মধ্যে। এই জন্যে প্রবাদ একান্তভাবেই একটি বিশ্বজনীন বাকশিল্প।

মনের ভাব সহজে অর্থবহ করে প্রকাশের জন্য এবং ভাষার সৌন্দর্য বাড়ানোর লক্ষ্যে বহুদিন ধরে প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার চলে আসছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ছোট আকারে কথার মাধ্যমে জনসাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে লোকোক্তিমূলক প্রবাদে রূপ নেয়। আবার জ্ঞানী ব্যক্তি গণের নীতি উপদেশমূলক কথাও প্রবাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রবাদের অর্থ ব্যঞ্জনা অর্থং কম কথায় গভীর ভাব প্রকাশের ক্ষমতা মানব চরিত্রে বৈশিষ্ট্য প্রকাশের সহায়ক। সরল প্রকাশভঙ্গি ও সহজবোধ্যতা থাকলে তা জনগণের সমর্থন লাভ করে এবং ভাষায় তার ব্যাপক ব্যবহার সম্ভব হয়ে ওঠে। ভাব প্রকাশের সহায়ক হিসেবে প্রবাদ-প্রবচনেয় গুরুত্ব অনেক। 

প্রবাদের আলোচনায় ড. সুশীলকুমার দে মন্তব্য করেছেন, বিশিষ্ট আকারে ও প্রকারে প্রকাশিত হইলেও ইহা (প্রবাদ) সাধারণভাবে প্রযোজ্য। কাহাকেও লক্ষ্য করা নয়, অথচ সকলকেই লক্ষ্য করা হইর উদ্দেশ্য। একজনের সহজ বুদ্ধিতে সহসা প্রতিফলিত হইলেও ইহা বহুজনের সুলভ বুদ্ধির উপায় ও ক্ষিপ্র প্রয়োগের অস্ত্র। 

প্রাত্যহিক যেসব ঘটনা সাধারণ মানুষকে প্রতারিত বা প্রতিষ্ঠিত করে, সেসব ঘটনাজাত অভিজ্ঞতার শিক্ষা ব্যবহার যোগ্য ভাষায় সংক্ষিপ্ত, সরল, সুতীক্ষ আকারে দেখা দেয়। এগুলো তখন জীবনের নীতি-নিয়মের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে প্রবাদ নামে আখ্যাত হয়ে কালান্তরে অনায়াসে উত্তৱণ করে।

প্রবাদ একদিকে লোকোক্তি অর্থাৎ প্রাকৃত প্রবাদ অজ্ঞাত মানুষের তৈরি, জনতার মুখে চলে আসা অপ্তবাক্য যাতে আছে মাটির গন্ধ। আর আছে প্রাজ্ঞোক্তি স্বনামধন্য মানুষের সৃষ্টি যা বিকীর্ণ করে বুদ্ধির বর্ণালী দীপ্তি।

প্রবাদ বাক্যের প্রকারভেদ

অভিজ্ঞতামূলক, নীতিকথামূলক, ঐতিহাসিক, মানব চরিত্রের সমালোচনা, সমাজের রীতি-নীতি ইত্যাদি বিষয়ক অসংখ্য প্রবাদ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়। যেমন: ধর্মের কল বাতাসে নড়ে (নীতিকথামূলক), গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল (মানব চরিত্র সমালােচনামূলক) ইত্যাদি।

মুসলিম রীতিনীতি মূলক কিছু প্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে। যেমনঃ বিসমিল্লায় গলদ; মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত; কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই ইত্যাদি।

ইংরেজি থেকে কিছু অনুবাদ মূলক প্রবাদের প্রচলন হয়েছে। যেমন: চক চক করলেই সোনা হয় না; রূপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো ইত্যাদি।

কিছু সংস্কৃত বাক্যাংশ বাংলার প্রবাদ হিসেবে চলছে। যেমন: অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী; অধিকন্তু ন দোষায়; অতি দর্পে হত লঙ্কা; মিষ্টান্ন মিতরে জনা ইত্যাদি ।

সাহিত্য রচনা থেকেও কিছু প্রবাদ এসেছে। যেমনঃ নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়? হাভাতে যদ্যপি চায় সাগর শুকায়ে যায় ; মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন ; কড়িতে বাঘের দুধ মিলে (ভারত)। এত ভঙ্গ বঙ্গ দেশ তবু রঙ্গে ভরা (ঈশ্বর গুপ্ত)। বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে (সঞ্জীবচন্দ্র)।

বিভিন্ন ভাষায় প্রবাদের মধ্যে অনেক সময় মিল পাওয়া যায়। দেশ ও ভাষায় ভিন্নতা থাকলেও কখনও ভাব ও ভাষাগত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।

তথ্যসূত্র

১. চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৮১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!