প্রলেতারিয় সংস্কৃতি (ইংরেজি: Proletarian Culture) হচ্ছে প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী সংস্কৃতি যা পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী সংস্কৃতির বিরোধীতা করে সাম্যবাদ অভিমুখী সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে। ফলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের নিমিত্তে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির সাংস্কৃতিক উপাদান দিয়ে প্রলেতারিয় সংস্কৃতি নির্মিত হয়। এক একটা সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির ভিত্তিতে সংস্কৃতির পরিচয় নির্ধারিত হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, দাস বা সামন্ততান্ত্রিক বা পুঁজিতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে তার অভ্যন্তরে বৈচিত্র, বিরোধ এবং বিভিন্নতাশূন্য একটি অখণ্ড সৃষ্টিকে বুঝায়।[১]
ভ্লাদিমির লেনিন তার ‘প্রলেতারিয় সংস্কৃতি প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন বুর্জোয়া যুগের ভাবাদর্শ ও সমাজতান্ত্রিক যুগের ভাবাদর্শ এক নয়। কিন্তু মার্কসবাদি দৃষ্টি থেকে দেখলে বুর্জোয়া বা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুকৃতিকে গ্রহণ করতে হবে। তিনি লিখেছেন,
‘বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের ভাবাদর্শ হিসাবে মার্কসবাদ বিশ্ব-ঐতিহাসিক তাৎপর্য অর্জন করেছে এই জন্য যে, মার্কস কখনোই বুর্জোয়া যুগের মূল্যবান সুকৃতিকে বিসর্জন দেয় নি, বরং উলটে, মানব চিন্তা ও সংস্কৃতির দুই সহস্রাধিক বছরের বিকাশের মধ্যে যা কিছ, মূল্যবান ছিলো তাকে আত্মস্থ করেছে ও ঢেলে সেজেছে। এই ভিত্তিতেই ও এই ধারাতেই, সর্ববিধ শোষণের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের শেষ সংগ্রামস্বরপ তার একনায়কত্বের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতায় অনুপ্রাণিত হয়ে আরো যে কাজ চলবে, তাকেই সত্যকার প্রলেতারীয় সংস্কৃতির বিকাশ বলে স্বীকার করা যায়।’[২]
মহামতি লেনিন প্রলেতারিয়েত ও শ্রমিকের সংস্কৃতিকে এক মহান সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন। প্রলেতারিয় সংস্কৃতি আকাশ থেকে পড়া কোনো আজগুবি বিষয় নয়, এটি মানবজাতির ধারাবাহিক সৃষ্টি। তিনি লিখেছিলেন,
“মানবজাতির সমগ্র বিকাশের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সংস্কৃতির যথাযথ জ্ঞান লাভ করেই এবং সে সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজিয়েই কেবল আমরা প্রলেতারীয় সংস্কৃতি গড়তে পারি।… …
পুঁজিবাদি সমাজ, জমিদারি সমাজ, আমলাতন্ত্রি সমাজের জোয়ালের নিচে মানব জাতি যে জ্ঞানভাণ্ডার জমিয়েছে, প্রলেতারীয় সংস্কৃতিকে হতে হবে তারই সুনিয়মিত বিকাশ।”[৩]
দাস সমাজে প্রভু এবং দাসের মধ্যে যে বিরোধ, সে বিরোধ প্রভুশ্রেণীর এবং দাসের বৈষয়িক ও মানসিক কর্মকাণ্ডেও প্রতিফলিত। সামন্ততান্ত্রিক সমাজেও অনুরূপ। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজেও উৎপাদনের হাতিয়ারের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত মালিকানা, উৎপাদনের যৌথ প্রক্রিয়া এবং উৎপাদিত সম্পদের ভোগ থেকে অধিকাংশকে বঞ্চিত রাখার ব্যবস্থায় যে শ্রেণীগত বিরোধ, দর্শনকোষ বৈষম্য, সংঘাত এবং ভাবভাবনার সৃষ্টি হয় তার প্রতিরূপ পুঁজিবাদী সমাজের সংস্কৃতি, বিশেষ করে তার আত্মিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়।
সমাজতান্ত্রিক সমাজে অর্থাৎ যে সমাজে উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষ শোষক এবং শোষিত হিসাবে বিভক্ত নয়, সে সমাজের সংস্কৃতিতে মৌল কোনো আর্থিক সংঘাতের প্রতিফলনের অবকাশ নাই। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতিও বৈচিত্রহীন নয়। বিরোধাত্মক বৈচিত্র্যের স্থানে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির বৈচিত্র্য সাধিত হয় সমাজের বিভিন্নমুখী উন্নতি সাধনের বিচিত্র সৃজনকর্মের মাধ্যমে।
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, “সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষ ও সমাজের রূপান্তরমূলক ক্রিয়া ও ফলাফলের সমষ্টি”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/literature/on-culture/
২. লেনিন রচনাটি লেখেন ৮ই অক্টোবর, ১৯২০ তারিখে। এখানে ভি. আই. লেনিনের বই সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭১, পৃষ্ঠা ৯৮-১০০ থেকে নেয়া হয়েছে।
৩ . ভ. ই. লেনিন, যুব লীগের কর্তব্য।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।