জন মিলটনের রাষ্ট্রচিন্তা বা রাজনৈতিক চিন্তা (ইংরেজি: Political Thoughts of Milton) হচ্ছে তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মিলটন একটি প্রজাতান্ত্রিক রূপের সরকারকে সমর্থন করেছিলেন। ১৬৪৯ সালে মিলটন দ্য টেনিউর অফ কিংস অ্যান্ড ম্যাজিস্ট্রেটস গ্রন্থে একটি প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠনের পক্ষে সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। এছাড়াও বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার ও শিক্ষা সংক্রান্ত তাঁর মতামত ছিল।
জন মিলটনের রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে তাঁর জীবন ও কালের স্বতন্ত্র পর্যায় অনুসারে সর্বোত্তম শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। ১৬৪১-৪২ বছরগুলিতে তিনি গির্জার রাজনীতি এবং বিশপগণ কর্তৃক গির্জাশাসনের [episcopacy] বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য নিজেকে উত্সর্গ করেন। তার বিবাহ বিচ্ছেদের পরে লেখা আরেওপ্যাজিটিকা এবং কিছু সময়ের পরে তিনি ১৬৪৯-৫৪ সালে প্রথম চার্লসের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরে এবং বিদ্যমান সংসদীয় শাসনব্যবস্থার বিতর্কমূলক ন্যায়সঙ্গতা সম্পর্কে লিখেছিলেন। তারপরে ১৬৫৯–৬০ সালে তিনি বর্বর ব্রিটিশ স্টুয়ার্ট রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের [ইংরেজি: Restoration of the Stuart monarchy] পূর্বাভাস দিয়েছিলেন এবং এটি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য লিখেছিলেন।[১]
মিলটনের রাষ্ট্রচিন্তা ও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কার্যকলাপ
১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বা আগস্টে স্বদেশে ফিরে এসে মিলটন এবার নিজের মতো বাসা নিলেন, লন্ডনের অলডার্স গেইটে। সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই একটা স্কুল খুলবেন, কিছু প্রাইভেট ছাত্র নিয়ে। কিছুদিন আগে মাতৃহারা দুই ভাগিনেয় তাঁর সঙ্গে থাকবে, এছাড়াও বাইরে থেকে কিছু বালক আসবে। একই সঙ্গে তার নিজের পড়াশুনা চলবে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কিছু খসড়া এই সময় করেছিলেন, এতে দেখা যায় প্যারাডাইস লস্টের কাহিনী তিনি নাটকের আঙ্গিকে লেখার কথা ভাবছেন।
তবে কার্যত নাটকও নয়, এপিকও নয় ঐ সময়ের ধর্মবিষয়ক বিতর্কই তাঁর সমগ্র মনোযোগ দাবি করে বসছে। এই সময়ে মূলত প্যামফ্লেট বা প্রচার-পুস্তিকা রচনাতেই নিয়োজিত ছিলেন মিলটন। চার্চ ও পোপের আধিপত্য সংক্রান্ত বিতর্ক, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে জোরালো যুক্তিজালে প্রতিপক্ষকে বন্দী করাই ছিলো এসব রচনার উদ্দেশ্য। তিনি লিখছেন বিতর্কমূলক প্রচারপুস্তিকা: Of Reformation in England (1641). The Reason of Church Government, An Apology for Smecymnuus (1642) । খ্যাতির জন্য কবিতা, দেশের সেবায় গদ্য—আপাতত পুরোপুরি গদ্য রচনায় ঝুঁকে পড়ার এই কৈফিয়তও তিনি দিচ্ছেন।
রাজা ১ম চার্লস-এর সঙ্গে পার্লামেন্টের বিরোধ চরমে উঠছে, এমন সময়, ১৬৪২ সালে, চৌত্রিশ বছর বয়সে মিলটন বিয়ে করলেন ষোল বছর বয়সের মেরী পাওয়েলকে। একে অল্প বয়স, তার উপর কট্টর রাজতন্ত্রবাদী পরিবারের মেয়ে চিন্তায়, আদর্শে, বয়সে এই দূরত্বের যা নিশ্চিত ফল, তাই ফললো। স্বামীগৃহে আসার অল্পদিন পরেই বিরক্ত বিভ্রান্ত বধূ ফিরে গেলেন পিতৃগৃহে। মিলটন ভেবেছিলেন ফিরে আসবেন অল্পদিন পরে, কিন্তু সেই অল্পদিন গড়িয়ে গেল গৃহযুদ্ধের চার বৎসরে–এর মধ্যে ফিরে আসা হয়তো বিপজ্জনক ছিল, কিন্তু মিলটনের মনে এক স্থায়ী তিক্ততার কারণ হয়ে রইল স্ত্রীর এই ব্যবহার।
মিলটন যে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, নারীচরিত্রে যে তার আস্থা টলে গিয়েছিল, তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে এই পর্বের বিভিন্ন রচনায়, এবং শেষ পর্বের মহাকাব্যে, ও নাটকে।
চার্চের বিধানে বিবাহ-বিচ্ছেদের ব্যবস্থা নেই। মিল্টন ধর্মশাস্ত্র ঘেঁটে প্রমাণ করলেন বিশেষ পরিস্থিতিতে বিবাহ-বিচ্ছেদ সংগত ও শাস্ত্রসম্মত। বিবাহ প্রচলিত ধারণামতে এক স্বর্গীয় বন্ধন, এক অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কিন্তু মিল্টন দেখাতে চাইলেন, এটা একটা সংস্কার মাত্র। বিবাহ দুইপক্ষের মধ্যে একটা চুক্তি, যা বিশেষ প্রয়োজনে বাতিল করা চলে। মিলটনের এই সকল প্রচার পুস্তিকা, The Doctrine and Discipline of Divorce (1643), Tetrachordon, ও Colastarion (1645), চার্চ কর্তৃপক্ষের নজরে এল। যাজকীয় কর্তৃত্বের বিষয়ে তাঁর পূর্বেকার বিরূপ সমালোচনা, এবং এখন, বিবাহ-বিচ্ছেদের বৈধতার পক্ষে তার এই চার্চ-বিরোধী মতবাদ, তাঁকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিতে এক বিপজ্জনক ও বৈপ্লবিক ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত করল। তাঁকে আক্রমণ করে যাজকেরা সরকারের নিকট অভিযোগ আনলেন। পার্লামেন্ট পর্যন্ত এই বাদানুবাদের ঢেউ গিয়ে পৌঁছল।
যাজকীয় উচ্চাসন থেকে ওয়েস্টমিস্টার অ্যাবীর হট পামার যখন এই ধর্মদ্রোহীর স্পর্ধায় বিস্ময় প্রকাশ করলেন, বিশেষত এই কারণে যে ঐ সকল আপত্তিকর রচনা সেন্সরশীপ এড়িয়ে অবাধে ছাপা হতে পারছে, তখন মিল্টন ভাবলেন, মুদ্রণ নিয়ন্ত্রণ আইন সম্বন্ধেই তার আপত্তি জানাবেন। এরই ফলস্বরূপ রচিত হলো তার সর্বাধিক পরিচিত পুস্তিকা, অ্যারিওপ্যাজিটিকা—অবাধ মুদ্রণের স্বপক্ষে তার বক্তব্য (১৬৪৪)। মিল্টনের বিতর্কমূলক বিস্তর গদ্যরচনার মধ্যে এটাই মধ্যমণি বলে বিবেচিত। গ্রিক সভ্যতার সময় থেকে অধুনাকাল পর্যন্ত মুক্তচিন্তার পক্ষে সর্বকালের মনীষীরা যা বলেছেন, তার মধ্যে একটি অমূল্য সংযোজন।[২]
দেশে শিক্ষার উন্নতি কিভাবে হতে পারে এই বিষয়ে মিলটন তার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেন Tracte of Education নামক পুস্তিকায়। এটি প্রকাশিত হয় ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে।
ইতিমধ্যে গৃহযুদ্ধের অবসানে মিল্টনের স্ত্রী ফিরে এলেন স্বামীগৃহে। স্বাভাবিক উদারতার বশে মিল্টন শুধু তার স্ত্রীর অপরাধ ক্ষমা করে তাকে গ্রহণই করলেন না, রাজনৈতিক বিপর্যয়ে বিপন্ন স্ত্রীর পরিবারবর্গও আশ্রয় পেল তার বাড়িতে।
ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড রাজশক্তিকে হারিয়ে ক্রমওয়েল পার্লামেন্টের শাসন প্রবর্তন করলেন। ক্রমওয়েলের অনুসারী লোকদের বলা হত পিউরিটান। এরা ছিলেন বিদ্বান, চরিত্রবান এবং সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি। মিলটন ছিলেন এই পিউরিটানদের দলভূক্ত। রাজ্যের বড় বড় সমস্যার ব্যাপারে ক্রমওয়েল মিলটনের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। এই সময় তিনি সরকারের ল্যাটিন সেক্রেটারির পদ গ্রহণ করেন।[৩]
ক্রমওয়েলের প্রজাতন্ত্র মিলটনের রাষ্ট্রচিন্তা সংক্রান্ত জীবনে নিয়ে এল এক নতুন অধ্যায়। পার্লামেন্টের জয়, রাজার বিচার ও মৃত্যুদণ্ড (১৬৪৯), ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা—সবই গেল মিলটনের রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়টির অনুকূলে। বিভিন্ন প্রচার পুস্তিকায় ইতিপূর্বেই মিলটন একজন রাজতন্ত্রবিরোধী, ও গণতন্ত্রী পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। স্বভাবতই নতুন সরকারের দৃষ্টিতে তার মূল্য তখন অপরিসীম। সরকারের কাছে তার প্রয়োজন আরও একটি কারণে বাড়ল: বর্বর রাজা চার্লসের মৃত্যুদণ্ডের পর সারা ইউরোপের রক্ষণশীল কীটেরা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাল। একটা প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায় দেশে ততােটা নয়, যতটা বিদেশে। বেশ কিছু তীব্র ও আক্রমণাত্মক পুস্তিকা লেখা হয় বর্বর রাজার পক্ষে। সবার আগে লেখা হয় স্বদেশেই, আইকন ব্যাসিলিকা (Eikon Basilike, রাজার প্রতিমূর্তি)। পুস্তিকাটি লেখেন ড. জন গডেন, নিহত রাজার খুব কাছের লোক। অন্তরীণ অবস্থায় রাজার মনের কথা ও ধ্যানের কথা, এই ভঙ্গীতে বইটি লেখা হয়। এই রচনায় রাজাকে একজন উন্নতমনা সন্ত ও শহীদের আসনে বসিয়ে দেন এই কুশলী লেখক। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মন কাড়ে। অল্পদিনের মধ্যে সাতচল্লিশটি মুদ্রণে এর প্রমাণ মেলে। দেশের বাইরে, ইউরোপের মূল ভূখণ্ডেই অনেকে কলম ধরলেন এই হত্যার প্রতিবাদে।
ক্রমওয়েল সরকারের পক্ষে এই প্রতিবাদের উপযুক্ত উত্তর দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ল, এবং মিল্টনকেই তারা এই কাজের জন্য বেছে নিলেন। আইকন ব্যাসিলিকার উত্তর মিল্টন লিখলেন আইকক্লাসটিস (১৬৪৯) –‘প্রতিমাচুর্ণকারী’। এভাবে শুরু হলো মিল্টনের নতুন দায়িত্ব—সেক্রেটারি অব ফরেইন টাঙস। সরকারি ডেসপ্যাচ তৈরি, প্রাপ্ত চিঠিপত্রের ইংরেজিতে ও প্রেরিতব্য চিঠিপত্রের লাতিনে ভাষান্তর, পুস্তিকাযুদ্ধে প্রতিপক্ষের জবাব দেওয়া, মিলটন তাঁর সর্বশক্তি, সর্বসময় নিয়োগ করলেন এই উত্তেজক ও সময়গ্রাসী কাজের মধ্যে। এক উচ্চতর কর্তব্যবোধ মিলটনকে ব্যস্ত রাখল বিশ বৎসর। এই দীর্ঘ সময় তিনি তার কবিতার চিন্তা ভুলে থাকতে বাধ্য হলেন। মিলটন জীবনের এটা মধ্য পর্যায়। এটি তাঁর গদ্য রচনার কাল। এই পর্বে তিনি যা লিখেছেন, তার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। এর বাইরে তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গদ্য রচনা হলো:
১৬৪৯ সাল: Tenure of Kings and Magistrates
১৬৫১ সাল: Defensio pro Populo Anglicano (Defence of the English People)
১৬৫৫ সাল: Defensio prose
১৬৬০ সাল: The Ready and Easy Way to Establish a Free Commonwealth.
মিলটনের লাতিনবিদ্যা যে দেশের কাজে লেগেছিল, উপরের বৃত্তান্ত থেকেই তা পরিষ্কার হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি ভাষাসংক্রান্ত সকল প্রশ্নে কমনওয়েলথের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে পড়েন। এমন কি অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও, যখন তার কাজের বোঝা যথেষ্ট হালকা করে দেওয়া হলো তখনও গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক চিঠিপত্রের অনুবাদের দায়িত্ব থেকে তিনি অব্যাহতি পান নি।
মিলটনের একটি চোখ ইতিপূর্বেই অকেজো হয়েছিল—এখন, লাতিন সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চোখের উপর যে অতিরিক্ত চাপ পড়ল, তার ফলে অন্য চোখটিও আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে গেল। তেতাল্লিশ বৎসর বয়সে মিল্টন একেবারেই অন্ধ হয়ে গেলেন। তাকে দায়িত্ব থেকে পুরোপুরি অব্যাহতি দেওয়া হলো না, তবে তাঁর কাজের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হলো।
মিলটনের রাষ্ট্রচিন্তা সংক্রান্ত বিপুল ও বিচিত্র গদ্য রচনার মধ্যে যদি কোনো মূল প্রসঙ্গ থাকে তবে তা স্বাধীনতা। চিন্তার স্বাধীনতা, বিবেকের ও নির্বাচনের স্বাধীনতা যেমন অ্যারিওপ্যাজিটিকার মূল বক্তব্য, তেমনি দাম্পত্য জীবনে, ধর্মীয় বিশ্বাসে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, স্বাধীনতাই সবচেয়ে জরুরি বিষয় হিসেবে ধরা দিয়েছে তাঁর চিন্তায়। তাঁর সকল গদ্য রচনার মধ্যে চিন্তার ও আবেগের এই ঐক্যই এক ধরনের ঐক্য আরোপ করেছে বলা যায়। তবে গদ্য পর্বের প্রথম বৎসরগুলিতে তিনি ব্যক্তিগত প্রেরণায় লিখেছেন, শেষের বৎসরগুলিতে লিখেছেন সরকারি প্রয়োজনের তাগিদে। অনেকটা সেই কারণেই সম্ভবত প্রথম পর্বের গদ্যে যে কল্পনার সৌকর্য দেখা যায়, পরবর্তী অনেক রচনায় তা অনুপস্থিত।
এই স্বাধীনতাবোধের সঙ্গে তাঁর ধর্মবোধের সামঞ্জস্য ঘটিয়েছিলেন মিলটন। তাঁর নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস ছিল একান্তই নিজস্ব। তাঁর বাড়িতে কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্মের জায়গা ছিল না। নিয়মিত বাইবেল পাঠ, ও ব্যক্তিগত প্রার্থনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর নিজের ধর্মাচরণ। রিফর্মেশন বা ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মূল বক্তব্য ছিল ব্যক্তির বিবেচনার উপর আস্থা, অনুশাসনভিত্তিক ধর্ম নয়, বুদ্ধি ও বিবেক পরিচালিত ধর্মবোধ, ন্যায়-অন্যায়বোধ। পিউরিট্যানের কাছে বাইবেল বড় ছিল, যাজক নয়। মুসা প্রবর্তিত ইহুদি ধর্মে আনুগত্যের উপর জোর পড়েছে। যিশু প্রবর্তিত খ্রিস্টান ধর্মে মানুষী বিবেক প্রাধান্য পেয়েছে, অন্তত রিফর্মেশনের এই শিক্ষা। মিলটন এই ক্রিশচিয়ান লিবার্টির কথাই বলেছেন।
মিলটন জীবনের এই মধ্য পর্যায়ে, যাকে গদ্যপর্যায়ও বলা যায়, যে অল্পসংখ্যক কবিতা লেখা হয় তার মধ্যে ষোলটি সনেটের গুচ্ছই উল্লেখের দাবি রাখে। সনেটগুলির একটি বৈশিষ্ট্য হলো, দেহে-মনে এরা পুরোপুরি পেত্রার্কীয় ধারার সনেট থেকে আলাদা—একেবারেই স্বতন্ত্র। মিলটনের ব্যক্তিগত ছাপ এদের সর্বাঙ্গে। এক কথায় এগুলিকে এক গুচ্ছ রাজনৈতিক কবিতা বলা যায়, যদিও কথাটা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। মিলটন তার জীবনের রাজনৈতিক পর্বেই এগুলি লিখেছিলেন। যাদের উদ্দেশ করে এদের কয়েকটি রচিত তারা হয় রাজনৈতিক মঞ্চের কুশীলব, যেমন লর্ড জেনারেল ফেয়ারফ্যাক্স (XV) লর্ড জেনারেল ক্রমওয়েল (XVI), কিংবা তার কোনো তরুণ বন্ধু, যারা তারই মতো সমকালীন রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছেন,—স্যার হেনরী ভেন (XVII) এডওয়ার্ড লরেন্স (XX) সীরিয়াক স্কিনার (XXI, XXII)। দুটি অরাজনৈতিক সনেট আছে, একটি তার অন্ধত্বের উপর ও একটি তার সদ্যমৃতা দ্বিতীয় স্ত্রীর স্মরণে। তবে এখানেও, এই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গেও, গতানুগতিক ধারার সনেটের সঙ্গে এদের কোনো মিল নেই। এই ষোলটি সনেট গঠনে শব্দ প্রয়োগে জমাট, অমসৃণ, গ্রন্থিল, পেত্রার্কীয় এলিজাবেথীয় ধারার সনেট যেখানে মূলত বিরহ-মিলনের প্রসঙ্গ, যেখানে গীতিকবিতার মাধুর্য ও মসৃণতা। মিলটনের সনেটে যেন পূর্বাহ্নেই তার মহাকাব্য-মনষ্কতার খবর আমরা পাই।
রাজতন্ত্রের পুনর্বাসন পরবর্তী জীবন
১৬৫৮ সালে লর্ডপ্রটেকটর ক্রমওয়েলের মৃত্যু হলে, রাজনৈতিক মঞ্চেও অস্থিরতা দেখা দিল। যদিও পিতার আসনে এসে তার পুত্র, কিন্তু ততদিনে দেশের জনমত ঘুরে গিয়েছে রাজতন্ত্রের পক্ষে, যা রাজতন্ত্রবিরোধী মিলটনের পক্ষে দুঃসংবাদ। কিন্তু আসন্ন পরিবর্তনের সব আলামত সত্ত্বেও কবি তাঁর বিশ্বাসে অবিচল থাকলেন, এবং শেষ পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালন করে গেলেন। শুধু তাই নয়, রাজতন্ত্র যে দেশের জন্য অকল্যাণই বয়ে আনবে, মিলটনের রাষ্ট্রচিন্তা সংক্রান্ত এই পুরনো মতকে নতুনভাবে প্রকাশ করতেও কুণ্ঠাবোধ করলেন না।
পিতৃ-সিংহাসনে নির্বাসন থেকে যুবরাজ চার্লস ফিরে এলেন ১৬৬০ সালে। এই সঙ্গেই সূচিত হলো দেশের জীবনে এক নূতন অধ্যায়, মিলটনের জীবনে এক দুঃখ দুর্ভোগের পালা। শুরু হলো ক্রমওয়েলপন্থীদের বিচার নিগ্রহ মৃত্যুদণ্ড। মৃতরাও রক্ষা পেল না। কবর থেকে তুলে এনে ক্রমওয়েলের ও আরও অনেকের কংকাল ফঁসিকাঠে ঝুলান হলো।[৪] মিলটন আবার ফিরে এলেন কাব্যচর্চায়।
তথ্যসূত্র
১. Blair Worden, Literature and Politics in Cromwellian England: John Milton, Andrew Marvell and Marchamont Nedham (2007), p. 154.
২. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, স্যামসন অ্যাগনিসটিজ, বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ, মার্চ ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ৪-১০।
৩. যাহেদ করিম সম্পাদিত নির্বাচিত জীবনী ১ম খণ্ড, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা; ২য় প্রকাশ আগস্ট ২০১০, পৃষ্ঠা ১০৬-১০৮।
৪. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, পূর্বোক্ত।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।