সাহিত্যকে বলা হয় ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্রের আয়না; অর্থাৎ সমাজ-রাষ্ট্রে বিদ্যমান দৃশ্যমান বা অদৃশ্য ব্যক্তি বস্তু চিন্তা আচার আচরণ সংস্কৃতি দৃষ্টিভঙ্গি মানসিকতা পরিকল্পনা ও দিক নির্দেশনা ইত্যাদি সবকিছুই সাহিত্যে উঠে আসে। এমনকি মহাবিশ্বের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ-ভাববাদ থেকে ভবিষ্যত বস্তুবাদ-ভাববাদ এর সবই সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথমদিকে শিক্ষাগ্রহণ, জ্ঞানার্জনের সুযোগ পেতো সমাজ-রাষ্ট্রের উচ্চ শ্রেণির মুষ্টিমেয় মানুষ ও অল্প সংখ্যক ধর্ম প্রচারক। তাদের শিক্ষা জ্ঞানার্জন নিজেদের শ্রেণি স্বার্থ রক্ষার্থেই ব্যবহৃত হতো। ফলে, প্রথমদিকের সাহিত্য অনিবার্য কারণেই সমাজ-রাষ্ট্রের উচ্চ শ্রেণির লোকেরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে নিজেদের মাঝে সীমাবদ্ধ রেখেছিলো।
মতাদর্শ দুই প্রকার যথা ক) সাম্যবাদী ও খ) বুর্জোয়া। মানব ইতিহাসের স্তরগুলো বর্তমান সময় পর্যন্ত পৌঁছাতে মোটামুটি তিনটি ধাপ অতিক্রম করে চতুর্থ পর্ব বা ধাপে অবস্থান করছে যা পুঁজিবাদ নামে পরিচিত। পূর্বের ধাপগুলো ছিলো আদিম সাম্যবাদ, দাস প্রথা, সামন্তবাদ।
মহাবিশ্বের অনিবার্য পদ্ধতি হচ্ছে পরিবর্তনশীলতা ও গতিশীলতা। অর্থাৎ পরিবর্তন ও গতিই মহাবিশ্বের নিয়ম। এই পরিবর্তন কারো চাওয়া না চাওয়ার শর্তের উপর নির্ভরশীল নয়। এমনকি প্রতিটি বস্তুকণা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক চিরন্তন পরিবর্তনের মধ্যে মানুষসহ অন্যান্য কিছু প্রাণি নিজেদের প্রয়োজনে কৃত্রিমভাবে প্রকৃতিতে আরেকটা পরিবর্তন করে। প্রকৃতিকে পরিবর্তন করা বা জয় করা আদৌ মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব হবে কিনা বা এই ‘প্রয়োজনীয় পরিবর্তন’ কতটুকু যুক্তিসঙ্গত এটা ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে।
অনুপ সাদি’র কবিতার বই ‘উন্মাদনামা’তে সর্বসাকুল্যে সতেরটি কবিতা আছে। প্রথম কবিতার শিরোনাম “উন্মাদনামা অথবা মানুষ মানুষ আর মানুষ অথবা প্রজন্মের ধারাবাহিক গল্প”। কবিতাটিতে মানুষের চিরাচরিত প্রাকৃতিক স্বাভাবিক জীবনে কৃত্রিম বাতাসের ঝটকা লাগার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। সরল গ্রামীণ মানুষের জীবন যাপনে যুক্ত হচ্ছে নাগরিক যান্ত্রিক জটিল শব্দ। গ্রামের মানুষের কাছে তখনো অনুন্নত রাষ্ট্রের রাজধানীর খবর খুব বেশি জানা না থাকলেও দেশীয় উঠতি রাজনীতির ধারক বাহকরা শোষণ লুণ্ঠন করছে। সেই বাতাস লাগতে শুরু করেছে গ্রামীণ জীবনে। দেশীয় নেতারা গরীব দুঃখী জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা, মিথ্যা আশ্বাস ও রঙ্গ তামশা করে। এই সবই প্রতারণা চাতুরীপনা ঠকবাজী। এক নতুন অভিজ্ঞতার পথ উন্মোচিত হতে থাকে জনমনে।
হঠাৎ এসব পরিবর্তনের পেছনের শক্তি সাধারণ গ্রামীণ মানুষের কাছে ধরা না দিলেও পুঁজিবাদী সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রগুলোর কর্পোরেট বা লগ্নীপুঁজি খুব দ্রুতই সাধারণ মানুষের সস্তা শ্রমশক্তি লুণ্ঠন শোষণ করতে শুরু করে। একদিকে দেশীয় প্রতারকদের ছলচাতুরী অন্যদিকে সম্প্রসারণবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের শোষণ, গ্রামীণ প্রাকৃতিতে বেড়ে উঠা মানুষ হোঁচট খেলেও, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এসবের সাথে পাল্লা দিয়ে মানিয়ে নিতে পারে না। ফলে, একটা শ্রেণি দ্রুত নিজেদেরকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নীত করে এবং বিপরীতের শ্রেণিটা এরসাথে পাল্লা দিয়ে অধপতিত হয়। ‘আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প’র চিন্তার অধিকাংশটা জুড়ে স্থান পেয়েছে রাজনৈতিক সচেতন কিন্তু ঠকবাজ ব্যক্তিদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার উন্মত্ততা এবং তাদের অসারতা, জনগণের প্রতি দ্বায়িত্বহীনতা ইত্যাদি। গণমানুষকে লুটপাট করার নানান ফন্দি ফিকির। এসব কোনো রাজনৈতিক মতবাদের স্বীকৃত উপায় না থাকলেও, বুর্জোয়ারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে চায় শোষণ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে, এই বক্তব্য এই কাব্যগ্রন্থে স্পষ্ট হয়েছে।
দ্বিতীয় কবিতা ‘চা, ইলেকশন এবং ইতিহাস’ কবিতায় পুঁজিবাদী রাজনীতির অপকৌশলের ফাঁদে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজন এবং ফলশ্রুতিতে অপরাজনীতি গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে যায়। সর্বত্র রাজনীতি হয়ে উঠে নিপীড়ন শোষণের হাতিয়ার। ছলচাতুরী ঠকবাজী প্রতারণা ইত্যাদি সাধারণ মানুষের জীবন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে বিষাক্ত করে তোলে।
সমাজ রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মিত হওয়া উচিত সংস্কৃতি, বস্তুবাদী চিন্তা অনুশীলন ও সামাজিক রাজনৈতিক জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে। অথচ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পূর্ববাংলার মানুষকে ব্যবহার করা হয়েছে দাসের মতো, চিন্তা কর্ম জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা থেকে ভয়ানকভাবে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। এই দূরবস্থার মধ্যেও যতটুকু রাজনৈতিক চর্চা এগিয়ে যায়, এর ফলই ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কিন্তু এর মাধ্যমেও গণমানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আসেনি। একটি নতুন নাম ও একটি স্বাতন্ত্র্য পতাকা হয়েছে। পূর্বে ছিলো পশ্চিম পাকিস্থানীদের অপশাসন নিপীড়ন শোষণ লুটপাট, ১৯৭১ এর পরে ‘সেই জল হতে জন্মালো দুধে ভাতে ডুবে থাকা পুঁজিপতি’ অর্থাৎ নতুন নামের দেশে নব্য হিংস্র বাহিনী পূর্বের পশ্চিম পাকিস্থানীদের ধারাবাহিকতাই চালিয়ে যায়।
তৃতীয় কবিতা ‘নেতা বনাম ভাতার’ কবিতায় রাজনীতি ও বাংলার অজপাড়া গাঁয়ের সমাজ জীবনের বহুকালের চিত্র দেখা যায়। একদিকে নেতাদের লুটপাট কেন্দ্রিক চাহিদা লোভ নিপীড়ন নির্যাতন বেড়ে যায় অন্যদিকে সংস্কৃতি শিক্ষাদীক্ষা পরিকল্পনা ভবিষ্যতহীন ‘গান করি আর সঙসারধর্ম পালন করি’ নামক জীবন। এই চিত্রটি অতি পরিচিত কেননা বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেও বাংলাদেশের মানুষে অভিভাবকহীন দিকনির্দেশনাহীন শোষণ লুণ্ঠনের মধ্যদিয়ে দিশেহারা জীবন অতিবাহিত করছেন। অথচ ১৮৪৮ সালে ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ মানুষের লড়াই সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। লড়াই সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য যথাক্রমে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ।
যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম কবিতা ‘আমরা গনশত্রু খুঁজছি’ ও ‘জনসম্পদের স্বপদে দাঁড়ানো’ কবিতায় নেতাদের স্বৈরাচারিতা ‘একুশ শতকের শুন্য দশকের মন্ত্রি/ পন্য বিনিময়ে কিঙবা গোপনে বেচলেন তেল গ্যাস বিদ্যুত বন্দর’ প্রকাশিত হয়েছে। মূলত বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পূর্ণরূপে দূর্বৃত্তায়িত হয়েছে। নেতারা অল্প দিনে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। অতিরিক্ত অর্থকড়ি লুণ্ঠনের মাধ্যমে একেকজন আইন আদালত নৈতিকতাসহ সকল প্রকার আদর্শ থেকে বিচ্যুত ‘কিডনি, লিভার, হার্ট, কর্নিয়া করো রপ্তানি/মানব হইল সম্পদ, কী হে’ হয়ে গণবিরোধী অবস্থান পোক্ত করেছেন। সাধারণ মানুষের সাথে নেতারা অতি বিচ্ছিন্ন তামশাপূর্ণ ইচ্ছে মাফিক ‘গাড়িটায় করে কিছু ভালো রক্ষিতা নিয়ে এসো হে’ আচরণ করে যেন এক মগের মুল্লুক। দিনের বেলায় জনগণের সাথে তামশা শোষণ লুণ্ঠন আর রাতের বেলায় নেশা আর নারী। রাজনৈতিক জ্ঞানহীনদের হাতে প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষ নির্যাতিত লুন্ঠিত হয়। একবিংশ শতাব্দী শুরু হয়েছে ব্যাপকভাবে পুঁজিবাদের পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। চীন রাশিয়া আমেরিকা ইউরোপ এমনকি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত পূর্বের রাষ্ট্র দখল নীতি পরিত্যাগ করে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে অথচ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পুঁজিবাদী নীতি বোঝার চর্চাও করেনি। ফলে অনিবার্যভাবেই পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে।
আবার একুশ শতকের প্রথম দশকে এদেশে তরুণদের একাংশ ইতিবাচক ও নেতিবাচক স্বপ্ন দেখা শুরু করে। স্বপ্ন দেখা তরুণদের অধিকাংশই সুবিধাবাদী নীতিটাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কৌশলে শোষণ লুণ্ঠনের পরিকল্পনা করে এবং বাস্তবেও তারা সফলতা পায়, আত্মমর্যাদাহীন শাসকদের ফাঁপা রাজনীতির সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সুবিধাবাদী আমলাতন্ত্র। ফলে, সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপে দ্বৈত অপশাসনের বোঝা। মানুষ একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে ‘প্রত্যেকের ঘরে ঘরে কঙ্কাল মাতৃমুর্তি আর ব্যক্তিবাদ’। অন্যদিকে একাংশ রাষ্ট্রকে গণমানুষের জন্য ‘লেখো না বাজে কবিতা, বানাও বাস্তব ছবি/ একথা কহিছেন আগামীকালের কবি/ এসব ভেবেছেন ভবিষ্যতের কবি’ সৃষ্টি করতে চায়।
‘বিপন্ন শ্রমিকদের ইতিহাস’ কবিতাটি রাষ্ট্রীয় বিভাজনের নেতিবাচক দিক নিয়ে লেখা। বিশ্বব্যাপী ‘রাষ্ট্র রাষ্ট্র খেলা’ মূলত শোষণ লুন্ঠণ কেন্দ্রিক। শাসকদের শোষণ লুণ্ঠনের সুবিধার্থে সম্পূর্ণ পৃথিবীকে টুকরো টুকরো করেছে যেন ‘নিজের বাড়ি নিজের দেশে খাঁচা’ অথবা ‘জনগনের উপরে পড়ে রইলো নিজেদের লাশ’। উপরি কাঠামোতে কথিত স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি আবার একই আদলে ভিন্ন ভিন্ন নামে গড়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, এসবের উদ্দেশ্য নিপীড়ন লুন্ঠণ ও শোষণ। পুঁজিবাদী সমাজ-রাষ্ট্রে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক মানবিক নয় বরং স্বার্থপরতার, লোভের, শোষণের, হিংস্রতার আর সম্পদ লুটের। প্রতিনিয়ত প্রত্যেক ব্যক্তির অনিশ্চয়তার জীবনে, চিন্তায় সচেতন ভালোবাসা প্রেম আবেগ সুখানুভূতি থাকে না। গত একশ বছরের অধিক সময় ধরে পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ ঘটছে। এর বিকাশের সংগ্রামটা শ্রমিক শ্রেণির জন্য আত্মঘাতী। কেননা শ্রমিক শ্রেণির নিজেদের টিকে থাকার লড়াই করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে মালিক শ্রেণির কাছে তাঁদের শ্রমশক্তি বিক্রি করতে হয়। অন্যদিকে মালিক শ্রেণি শ্রমিকদের এই সস্তা শ্রমশক্তি দ্বারা উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য অধিক মুনাফায় শ্রমিক শ্রেণি তথা গণমানুষের নিকট বিক্রি করে। এভাবে গড়ে উঠছে মালিক শ্রেণির সম্পদের পাহাড়, বাড়ছে সম্পদের ব্যাপক ব্যবধান।
এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে, এই ব্যবধান কমিয়ে সমতা সৃষ্টি করতে হবে। ন্যায় ন্যায্য সমাজ রাষ্ট্র বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে। এক শতাব্দীর বেশি সময় যাবত এই কথা বলা হলেও কার্যকরী কোনো তত্ত্ব চর্চা অনুশীলন তেমন চোখে পড়ছে না। কোনো কোনো রাষ্ট্র গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের কথা বললেও, প্রকৃত বাস্তবতায় পুঁজিবাদী কর্মকান্ডই পরিচালিত হয়। বৃটিশদের ১৯০ বছর ভারতীয় উপমহাদেশ শাসনের নীতি ছিলো ‘divide and rule’ অর্থাৎ বিভাজনের মাধ্যমে শাসন। এক্ষেত্রে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্থানের জনগণের অশিক্ষা কুশিক্ষা ধর্মীয় কুসংষ্কারে ডুবে থাকা অর্থনৈতিকভাবে দূর্দশাগ্রস্থ অঞ্চলগুলোকে শাসন করার জন্য কাজে লাগিয়েছিলো।
আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প-এ স্থান পাওয়া কবিতাগুলোর বক্তব্য প্রায় একই রকম, অনুন্নত রাষ্ট্র অশিক্ষা কুশিক্ষা পশ্চাৎপদ শিক্ষাব্যবস্থা স্থুল চিন্তার রাজনীতি ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা চাতুরিপনা রাজনৈতিক অজ্ঞতা দারিদ্রতা রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা মুৎসুদ্দি ইত্যাদি। স্বাধীনতার ৬০ বছর পরে মানুষ বেড়েছে ৩ গুণ কিন্তু এখনো পর্যন্ত দেশের মানুষ তাঁদের মৌলিক চাহিদাগুলো রাষ্ট্র থেকে পূরণ করতে পারছে না। বরং শোষণ লুণ্ঠন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। নানান রকম চতুর্মূখী সমস্যা রাষ্ট্রের জনগণকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে জীবনকে অসহ্য করে তুলেছে। চারদিকে লুণ্ঠন ও হতাশা। এসব থেকে মুক্তির জন্য কিছু মানুষ চেষ্ঠা করছেন, বিশ্বের অন্যান্য সফল রাষ্ট্রগুলোকে বিশ্লেষণ করছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কী কী নীতি কৌশল প্রয়োগ করলে সফলতা আসতে পারে এসব বিষয় নিয়ে ভাবনাগুলো প্রস্তাব করছেন। এই কবিতার বইও এসবের অংশ। দীর্ঘদিন শোষক নিপীড়ক লুন্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম যুদ্ধ করেছে এবং সফলতা পেয়েছে। রাশিয়া চীন কিউবা ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলো নিজস্ব পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে এবং ওখনাকার নাগরিকরা তুলনামূলক উচ্চ শিক্ষা সংস্কৃতি মৌলিক চাহিদা জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করছেন।
বইটি আঁকারে ছোট হলেও চিন্তার উদ্রেগ করে কিন্তু বর্তমান কবিও পুঁজিবাদের বিরাট খাঁচা ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে পারেননি। কবিতাগুলোতে দেশীয় অগোছালো রাজনীতির বিপরীতে সম্প্রসারণবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর পরিকল্পিত আগ্রাসন থেকে মুক্তির পথ বের হয়ে আসেনি। ‘পাবলিক হারায়া ফেলে হুশ জ্ঞান বুদ্ধি বিবেক’ এটা সত্য কারণ জ্ঞানটা প্রথমে সাধারণ মানুষের মাথায় আসে না, যারা জ্ঞান বুদ্ধি রাষ্ট্র ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিনিয়ত চর্চা করেন, স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের চিন্তায় জ্ঞানটা আসে। কবিতাগুলোতে সমাজ রাষ্ট্রের দুরবস্থা, দর্শন থাকলেও সময় এসেছে ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’র মতো লক্ষ্য নির্ধারণ করা। ইশতেহার স্পষ্ট করে শ্রেণি সংগ্রামকে একমাত্র মুক্তির উপায় হিসাবে নির্ধারণ করেছিলো যার গন্তব্য হচ্ছে সমাজতন্ত্রের মাধ্য দিয়ে সাম্যবাদ। বর্তমান কবি একটি আধুনিক শোষণহীন শ্রেণিহীন সমাজের কথা বলেছেন কিন্তু শ্রেণি হিসাবে শোষিত নিপীড়িতদেরকে সংগঠিত করার উপায় উল্লেখ করেননি। বর্তমান চলমান সমাজ রাষ্ট্র ব্যবস্থার অসারতা তুলে ধরেছেন কিন্তু উত্তোরণের উপায় বলেননি। অর্থ কেন্দ্রিক ব্যবস্থায়, দৃঢ় লক্ষ্য উদ্দেশ্য পরিকল্পনা মাফিক না হলে, জ্ঞান চর্চা গবেষণা এমনকি শ্রেণি সংগ্রামটা মূল্যহীন অথবা পুঁজিবাদের কাছে বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে যায়, গত একশো বছরের কথিত প্রগতিশীলদের আন্দোলনবাদী কর্মকান্ডগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বেশিরভাগ মানুষ মনে করে ব্যক্তিগত সম্পদই একমাত্র স্বাচ্ছন্দে বেঁচে থাকার প্রধান হাতিয়ার, পরবর্তী প্রজন্ম সুখ শান্তিতে বাঁচবে নতুবা ভবিষ্যৎ হবে অনিশ্চিত, অন্ধকার। এই তত্ত্বের বিপরীতে উচ্চতর সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদী জীবন ব্যবস্থা থাকলেও, প্রতিষ্ঠিত করার পূর্ব পর্যন্ত এত তত্ত্ব সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে তোলা কঠিন। তত্ত্ব হলো গবেষণার ফসল। সকল মানুষ গবেষক নন। দীর্ঘ সময় যাবত গবেষণার ফলে তত্ত্ব আসে। সর্বজনের পক্ষে সহজে তত্ত্ব উপলব্ধি করা কঠিন। যারা তত্ত্বটা উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁদেরই উচিৎ প্রয়োগের ব্যবস্থা করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, একবিংশ শতকের তাত্ত্বিকদের মাঝে এই প্রবণতা দেখা যায় না। এর কারণ হিসাবে দেখা যায় এইসব তাত্ত্বিকদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সদস্য। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভংকর মন্দ দিক হলো সুবিধাবাদীতা এবং এটাই মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী শ্রেণির নীতির মূল সমস্যা।
উন্নত জীবনের পূর্বশর্ত হলো দ্বান্দিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দ্বারা যাচাইকৃত চালিত জীবন। জ্ঞানার্জন ও শিক্ষা অর্জনের বিকল্প নেই। শিক্ষা কেবলমাত্র প্রাতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নয়, নানান উপায়ে উন্নত শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করা যায়। প্রচলিত বুর্জোয়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেলেও যখন সারা বিশ্বের সর্বজনের মধ্যে সমতা আনতে পারছে না বা প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না, তখন বোঝা যায় এই শিক্ষাব্যবস্থা সর্ব জনের স্বার্থে নয় বরং সমাজ রাষ্ট্রের বাছাইকৃত কিছু মানুষকে সুবিধা দেয়। এইসব কথিত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিতরা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে রাষ্ট্রীয় শোষণ নিপীড়নের হাতিয়ার বনে যায়, হতে বাধ্য হয়! এ বিষয়ে কমরেড মাও সেতুঙয়ের নির্ভুল চিন্তাধারা বিষয়ক একটা উক্তি দেখতে পারি। মাও বলেন,
“মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে? সেগুলো কি আকাশ থেকে পড়ে? __ না। সেগুলো কি মনের মধ্যে সহজাত? __ তা নয়। মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কেবলমাত্র সামাজিক অনুশীলন থেকেই আসে; সমাজের উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণিসংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরিক্ষা-নিরীক্ষা __ এই তিনটি অনুশীলন থেকেই সেগুলো আসে”।[১]
অনুপ সাদি মূলত প্রাবন্ধিক। চিন্তায় ধ্যানে মানসিকতায় এমনকি কর্মে পোষণ করেন সমাজতন্ত্র। আমাদের দেশের বাম ধারার চর্চা, সংস্কৃতিতে তাঁর লেখায় একটি নতুন সত্যের সন্ধান মেলে, তা হল “তারা আধা বাম আধা ডানপন্থী”। সে বিচারে এখানে প্রকৃত বাম রাজনীতির চর্চা নেই। মার্কসের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে সংশোধনের, কাটছাঁটের বা মধ্যম পন্থার কোনো সুযোগ নেই কিন্তু এখানকার অবস্থা হচ্ছে উপরি কাঠামোতে বুদ্ধিজীবীর প্রলেপ দেওয়া, কথিত বুদ্ধিজীবী সাজা বা বুদ্ধিজীবী সাজার ভান করা।
মার্কসবাদ না বুঝে, উপলব্ধিতে না এনে যে চর্চা অত্র অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত চলে আসছে, এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তি কোনদিনও আসার সম্ভাবনা নেই। এই কাব্যগ্রন্থের কবি এই কথাটি প্রতিটি শব্দে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প কাব্যগ্রন্থে সতেরটি কবিতা স্থান পেয়েছে। খুব সহজেই যে কোনো পাঠক বুঝে নিতে পারবেন কবির মানসিকতা। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা এখানে নেই। আছে সরাসরি বিপ্লবের কথা। মানব মুক্তির কথা। উইলিয়াম শেক্সপিয়র যথার্থই বলেছিলেন, “Justice delayed, justice denied.” তিনি কবিতা বলেন ক্ষোভের সাথে। তাঁর ক্ষোভ নিপীড়িতের শোষিতের নির্যাতিতের সামষ্টিক ক্ষোভের একক প্রকাশ। সমাজের নষ্ট মানুষগুলোর বেহায়াপনা মিথ্যাবাদিতা প্রতারণা মোসাহেবীপনা ভণ্ডামি এভাবে ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজ রাষ্ট্র পেরিয়ে বিশ্ব মোড়ল সবই তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে।
সাদি খালি চোখের ধাধাগুলো অন্তর দৃষ্টি দিয়ে যাচাই করেন। তিনি মনে করেন বস্তুর ভেতরটাই প্রধান, উপরিকাঠামোটির প্রয়োজন আছে কিন্তু অপ্রধান। এভাবেই মার্কস বিচার করতে বলেছিলেন। তিনি মনে করেন বাংলাদেশের সর্বত্র উল্টো অবস্থা, তাই পুরাতন সব নষ্ট দিয়ে ভরা। কাঙ্খিত সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার সব পরিবর্তন করে নতুন করে সাজাতে হবে “পৃথিবীর সারা শরীরে ব্যথা/ মলম দেবে কে, কষ্টের কাজ পৃথিবীকে মাথায় বহন, এটিকে কোনো ভাগাড়ে ফেলে দিলে”। যেখানেই সমস্যা সেখানেই বিজ্ঞানসম্মত পরিবর্তন করতে হবে, মায়া করে, দরদ দেখিয়ে অবৈজ্ঞানিক, অসাড়তা যতদিন টিকিয়ে রাখা হবে ততদিন সত্য উন্মোচিত হবেনা।
তিনি ভাষায় নতুনত্ব এনেছেন। প্রচিন যুগ থেকে যেমন, ‘ঙ’ ব্যবহার করেছেন ‘ং’ এর স্থলে। ‘ণ’ এর স্থলে ‘ন’, দীর্ঘ ‘ী’ এর স্থলে হ্রস্ব ‘ি’ এমন অনেক শব্দের নতুন বানানের প্রয়োগ করেছেন। তিনি মনে করেন ফালতু, অপ্রয়োজনীয়, আবেদনহীন, ক্ষতিকারক, ধ্বংসাত্বক, ব্যক্তিবাদি, অপ্রয়োজনীয় ভাববাদী, নষ্ট রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ভীরুতা, কাপুরুষতা, মেরুদণ্ডহীন ব্যক্তি, ভঙ্গুর চিন্তক, প্রতারক, রাষ্ট্র পরিচালকের প্রয়োজন নেই। এদেরকে উৎখাত করতে হবে এবং এখনই। একজন সচেতন মানুষের তাঁর চিন্তার সাথে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি দালালী মোসাহেবি লোক বা চিন্তাকে প্রশ্রয় দেন না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পেঁচিয়ে কিছুই বলেন না। ভাষার ক্ষেত্রেও শোধন করেননি, সাধারণ কৃষকের, মজুরের, কাঙালের মনের কথাই সরাসরি তাঁর লেখনিতে ফুটে উঠেছে। তাঁর ভাষা হয়ে উঠে সকলের ভাষা।
শ্রেণিহীন শোষণমুক্ত ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশকে সামনে রেখে, বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার গণবিরোধী কঠিন বাস্তবতা এই বইটিতে উপস্থাপিত হয়েছে। অপযৌক্তিক প্রতিক্রিয়াশীল শোষণ নিপীড়নমূলক সমাজ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনুন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো অধিকতর উপযুক্ত। কারণ, অনুন্নত ব্যবস্থায় প্রথমত মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয় না। খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ও চিকিৎসার ঘাটতি থাকলে মানুষকে প্রতিনিয়ত অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হয়। এমন জীবন যাপনে সমাজ রাষ্টের মানুষের পূর্ণ শারীরিক মানসিক বিকাশ ঘটে না। অপূর্ণাঙ্গ শারীরিক মানসিকতা পূর্ণাঙ্গ চিন্তা পরিকল্পনা কর্ম সম্পাদন এবং উচ্চ সমাজ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারে না। এমন সমাজ রাষ্ট্রের মানুষের ন্যায়-অন্যায়-অপরাধ-নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে খুব বেশি জ্ঞান করার সুযোগ থাকে না।
আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প’র সবগুলো কবিতা প্রধাণত রাজনৈতিক। বাংলাদেশের রাজনীতির পাশাপাশি কবিতাগুলোতে ভারতীয় উপমহাদেশের খণ্ডিত হয়ে যাওয়ার ফলে অসংখ্য মানুষের দুঃসহ দুঃখ কষ্ট দুর্দশার কথাও উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশার প্রধান কারণ হিসাবে এই কবিতার বইটিতে দেখানো হয়েছে,“এদেশের অসৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা”। এটা সাধারণ জনগণের কাছেও পরিষ্কার। কবির সূক্ষ অন্তদৃষ্টিতে এইসব বিষয়গুলোর পাশাপাশি দেশের মানুষের জীবন-যাপন অর্থনীতি শিল্প বাণিজ্য অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি বৈশ্যিক রাজনীতি সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদি স্পষ্ট হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
আধুনিক মানুষের জীবন রাজনীতির বাইরে কিছু নয় এটা রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জানেন। কিন্তু পুঁজিবাদী রাজনীতি সবসময়ই রাষ্ট্র ক্ষমতাকে দূর্বলের উপর অত্যাচার নিপীড়ন নির্যতন লুণ্ঠনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে।
কবিরা চিরকালই ব্যক্তিগতভাবে মানবতাবাদী ছিলেন, এখনো তা-ই দেখা যায়। মানবতার কবিদের অধিকাংশরাই কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বিশ্বকে সুখী সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন। ফলে, তাদের এই চাওয়ার ইচ্ছাটা হয়েছে ভাববাদী। কান্ডজ্ঞান দ্বারা পরিচালিত চিন্তা ব্যক্তি অবশেষে ভাববাদী হয়ে থাকেন যা শেষ বিচারে গণবিরোধী চিন্তা কর্মই হয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবী ঠাকুর সম্পর্কে অন্য আলোচনায় বিশদ বলার চেষ্টা থাকবে।
১৮৪৮ সালে মার্কস-এঙ্গেলস কর্তৃক ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ প্রকাশিত হওয়ার পরে যেসব কবি সাহিত্যিক লেখক বুদ্ধিজীবী সাবেক চিন্তার পূণর্মূল্যায়ন করেননি, তাঁদের সকলেই কোনো না কোনোভাবে চিন্তায় কর্মে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন। এমনকি এটাও বলা যায়, যতদিন পর্যন্ত মার্কসবাদী চিন্তাকে অতিক্রম করার মতো কোনো চিন্তা এ পৃথিবীর মানুষ না পাচ্ছে, ততোদিনই মার্কসীয় চিন্তা সর্বোচ্চ মানবতাবাদী চিন্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
কী আছে মার্কসবাদে বা মার্কসবাদ কী? এটা একটা দ্বান্দিক ও ঐতিহাসিক মতবাদ। চিন্তা ও কর্মকে যাচাইয়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেয়ার মতবাদ। বস্তুকে নানান দিক থেকে যাচাই বিচার বিশ্লেষণ করে এগিয়ে নেয়ার মতবাদ।
শ্রেণিহীন সমাজিক অবস্থান সৃষ্টিই বইটির গন্তব্য। আজেবাজে অযৌক্তিক পশ্চাদপদ সমাজ ব্যবস্থা পরিকল্পনা ব্যতিরেকেই অনায়াসে সৃষ্টি করা যায় কিন্তু বিজ্ঞান সম্মত, পরিকল্পিত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা একটি কষ্টসাধ্য ব্যপার। এর জন্য চাই প্রচুর মেধার চর্চা, ত্যাগ, নিরলস পরিশ্রম। পার্থক্য হচ্ছে তথাকথিত চালমান সমাজ ব্যবস্থার সুবিধার ভাগিদার সবাই হতে পারেনা, ব্যক্তিগত ভাবে খুব কম মানুষ এর সুবিধা উপভোগ করে।
অন্যদিকে কষ্টার্জিত সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের সুবিধা সার্বজনীন। তাই সকলেই এর সমান সুবিধা উপভোগ করতে পারে। একটি আদর্শ সমাজ গঠনে অনেকগুলো অন্তরায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে প্রধান হিসাবে পাঠক দেখবে একদল মুখোশদারী ব্যক্তি যারা প্রতি মুহূর্ত নিজেকে ব্যস্থ রাখে অন্যদেরকে ব্যস্ত রাখে এই বলে যে তারাই সমাজের সকল সুখ আনবে যদি জনগণ তাঁদেরকে ভোট দেয়, তারা তথাকথিত সমাজপতি, নেতা। বুর্জোয়া রাজনীতিবিদরা ব্যস্ত ভোট এবং লুটপাট নিয়ে। তারা সমাজের উন্নতির কথা বলে কিন্তু উন্নতি করে নিজের জন্য। অন্যকে ঠকিয়ে, অন্যেরটা ছিনিয়ে নিয়ে, লুট করে।
বুর্জোয়া ব্যবস্থা দ্বারা শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনতা প্রতিনিয়ত নিপীড়িত লাঞ্ছিত শোষিত হচ্ছেন। নির্লজ্জের মতো তথাকথিত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নাম করে লোক দেখানো ভোটবাজী করে থাকেন। এসব ভোটবাজির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো লুটপাট, এটা সকলেই বোঝেন কিন্তু কিছু করতে পারেন না। কারণ বুর্জোয়া রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য কখনোই মানবতাবাদ নয়, বরং লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা। লুটপাটতন্ত্র নামে কোনো মতবাদ নেই। এটি একটি অঘোষিত মতবাদ। একটা পদ্ধতি যা তুলনামূলক অসংগঠিত দূর্বলকে পেষণ করার পদ্ধতি।
লুটপাটতন্ত্রের আদর্শ আছে। এই ব্যবস্থায়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চারিত করে বল প্রয়োগের মাধ্যমে লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এই পদ্ধতি আদিম অপরিকল্পিত কিন্তু আবেগতাড়িত মমত্ববোধ থেকে প্রতিষ্ঠিত সাম্যবাদী ব্যবস্থার পরের ধাপ থেকেই চলে আসছে। স্থুল যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদ সময় অতিবাহিত করছে।
আরো পড়ুন
- উন্মাদনামা কাব্যগ্রন্থ
- অনুপ সাদির কবিতায় সবার উপরে তার রাজনৈতিক চেতনা স্থান পায়
- উন্মাদনামা হচ্ছে শ্রেণি বিভক্ত মানুষের কাব্যচিত্র
- উন্মাদনামা কবিতাগ্রন্থের পর্যালোচনা
- উন্মাদনামা বাঙালির ব্যর্থতার ইতিহাসকে তুলে ধরে
- রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বুননের বিদ্রুপ কবিতাগ্রন্থ ‘উন্মাদনামা’
মার্কসীয় সমাজ কী? মার্কসীয় সমাজ বলতে এখনো পর্যন্ত একটি সূত্র বা তত্ত্ব মাত্র। সোভিয়েত রাশিয়া চীন ভিয়েতনাম কিউবাসহ বিশ্বের বেশকিছু রাষ্ট্র এই মতবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে, বর্তমানেও কিছু রাষ্ট্র মার্কসীয় নীতির বাস্তবায়ন করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বিশ্বের কোথাও এর প্রকৃত বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এটা একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় যার ভিত্তি স্থাপন করে শ্রেণি সংগ্রাম এবং সমাজতন্ত্রের মধ্য দিয়ে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠাই এর প্রকৃত লক্ষ্য। শ্রেণি সংগ্রাম ব্যতীত সমাজতন্ত্র সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বেঁচে থাকার জন্য যে বাধ্যতামূলক শ্রমশক্তি বিক্রেতা শ্রেণিটা প্রতিনিয়ত জীবন যুদ্ধ করে সেই প্রলেতারিয়েত শ্রেণি কর্তৃক পরিচালিত রাষ্ট্র হচ্ছে মার্কসীয় রাষ্ট্র।
এখনই সময় বুর্জোয়া, সাম্রাজ্যবাদী, আগ্রাসী, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোকে পরিবর্তন করার, মডেলরূপে আনতে হবে একটি সমাজতান্ত্রিক আদর্শ রাষ্ট্র। মোটামুটি একটি বিষয় কবি অনুপ সাদি নিশ্চিত করেছেন, প্রায় স্পষ্ট করে বলেছেন প্রত্যেকটি সমাজে সমস্যা কারা সৃষ্টি করে। তিনি বলেছেন রাজনীতিকরা।
কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন এবং বলেছিলেন ‘আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না’। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সমাজকে শোষণ করে যে পরগাছা সকলের অগোচরে বৃদ্ধি পেয়েছে, এতদিন কেউ খেয়াল করেনি যে একটা বিষধর সাপ; এই সমাজ পুষেছে যাকে দুধ কলা দিয়ে, এখন সে ছোবল দিচ্ছে, সব নষ্ট করে দিচ্ছে, বিপদ আসন্ন।
তথ্যসূত্র
১. মাও সেতুঙের রচনাবলীর নির্বাচিত পাঠ; বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পিকিং, প্রথম সংস্করণ ১৯৭৯
রচনাকাল ১ মে ২০২০।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।