ছিন্নপত্রে কবিত্ব হচ্ছে কবি রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক গদ্যের চিঠির সংকলন

ছিন্নপত্রে কবিত্ব বা ছিন্নপত্রের কাব্যিক মূল্যায়ন হচ্ছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যিক গদ্যের চিঠির সংকলন। এই গ্রন্থটি গদ্যভাষায় লেখা হলেও এর মধ্যে কবিত্ব দুর্লক্ষ্য নয়। ছিন্নপত্র নামের চিঠির এই সংকলন গ্রন্থটি হচ্ছে উনিশ শতকের শেষ দশকের বাঙলাদেশের পরিবেশ ও প্রকৃতিকে তুলে ধরা এক আয়না, যেখান থেকে দেখা যায় বাংলার উনিশ শতকের কাব্যিক রূপ। ছিন্নপত্র হচ্ছে এক কথায় উনিশ শতকের শেষ দশকের বাংলাদেশ। ১৮৮৫ থেকে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের বাঙলা দেশ। ছিন্নপত্র হচ্ছে উনিশ শতকের বাঙলাদেশের অপরূপ মোহনীয় প্রকৃতির বিবরণ। জীবনানন্দের রূপসী বাংলা যেমন বিশ শতকের বাংলাদেশের রূপ তুলে ধরেছে, তেমনি উনিশ শতকের বাংলাদেশকে তুলে ধরেছে ছিন্নপত্র। 

ছিন্নপত্রে আছে অনেক কিছু, নেইও অনেক কিছু, থাকতে পারতোও অনেক কিছু। এক চব্বিশ বছরের তরুণ পত্রগুলো লিখতে শুরু করেছেন, লিখেছেন চৌত্রিশ বছরের তারুণ্য পর্যন্ত। তারুণ্যের চোখে দেখা সুন্দর বাঙলাদেশের রূপটি ধরা আছে ছিন্নপত্রে, অবশ্যই এক রোম্যান্টিকের দৃষ্টিতে। কিন্তু ছিন্নপত্রে নেই এক বাস্তববাদীদের দৃষ্টিতে দেখা অভাব-যন্ত্রণা-ক্লান্তি ও রাজনীতির উত্থানপতন সামাজিক টানাপোড়েন। নেই সব শ্রেণির মানুষের জীবনের কথা, জীবনের সর্বদিকের বর্ণনা; যা আছে তা খুবই যৎসামান্য। সে হিসেবে ছিন্নপত্রকে বলা যায় জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার পূর্ববর্তী চিঠির সংস্করণ। ছিন্নপত্রে আছে বাঙলাদেশের প্রকৃতি, নেই বাঙলাদেশের মানুষের জীবন-মরণের সংগে সম্পৃক্ত টানাপড়েন।

ছিন্নপত্রে কবিত্ব

ছিন্নপত্রে আছে প্রকৃতির বর্ণনার ঠাসবুনন, রয়েছে অজস্র উপমা রূপকের ব্যবহার, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়বস্তু, প্রাণি-উদ্ভিদের নিখুঁত বর্ণনা; মনে হবে কবির চোখে কিছুই এড়ায়নি; ছোট্ট তৃণটি থেকে বৃহদাকার হাতি, বর্ষার পদ্মার স্রোত থেকে ঝিলের এক টুকরো নিস্তব্ধ জল, কোলকাতার কোলাহল থেকে শিলাইদহের চরের নির্জনতা-সব কিছুর অনুপঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায় ছিন্নপত্রে। আরো পাওয়া যায় মনের অবস্থা, হৃদয়ের ব্যাকুলতা, ভালোবাসার আধিক্য, হৃদপিণ্ডের গান, দৃশ্যের সৌন্দর্য, কবিতার প্রাবল্য, প্রকৃতির ঘাত-প্রতিঘাত যাকে এক কথায় বলা যায় ছিন্নপত্রে কবিত্ব আধিক্য নিয়েই বিরাজমান।

ছিন্নপত্রের নিসর্গ বর্ণনা আমাদের মুগ্ধ করে। ছিন্নপত্রে নিসর্গের বিবরণের সাথে আমরা পাই জনজীবনের রূপ যদিও সে রূপ একজন সমাজতাত্ত্বিক বা অর্থনীতিবিদের মতো পূর্ণাঙ্গ নয় তিনি শিলাইদহ, সাজাদপুর এবং পতিসর অঞ্চলের মানুষ ও নিসর্গকে দেখেছেন কবির কৌতূহল ও সহমর্মিতা নিয়ে। কলকাতা থেকে খুব স্বতন্ত্র পল্লীর কোলে এসে তাঁর মনে কৌতূহল জেগে উঠেছিলো।[১]   

রবীন্দ্রনাথ নিজে বাঙালি। রুদ্ধ জীবনে ঘরের কোণে বসে খুঁত খুঁত করবেন, বিচার তর্ক করবেন কিন্তু আরব বেদুইনদের মতো জীবনকে উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খলভাবে ছেড়ে দিতে পারবেন না, তদুপরি উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল জীবন তাকে টানে। তেমনি তিনি কবিতায় স্বাচ্ছন্দবোধ করেন, একটি কবিতা লিখে আনন্দ পান, হাজার গদ্য লিখেও তার তেমন আনন্দ হয় না তা তিনি আমাদের জানিয়ে দেন। তিনি কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে কবিতায় মনের ভাব সম্পন্নতা লাভ করে কিন্তু গদ্য একবস্তা আলগা জিনিস, এক জায়গা ধরলে সমস্তটি উঠে আসে না।

শহর ও গ্রামের তুলনামূলক আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ আমাদের জানান শহরে মনুষ্য সমাজ অত্যন্ত প্রধান, সেখানে নিজের সুখ-দুঃখ নিয়েই মানুষ ব্যস্ত, অন্য প্রাণির সুখ-দুঃখ গণনার মধ্যেই আনে না; আবার ইউরোপের মানুষের জীবন এতো জটিল যে তারা জন্তুকে কেবল জন্তু মনে করে; অন্যদিকে ভারতীয়রা মানুষ থেকে জন্তু এবং জন্তু থেকে মানুষ হওয়াটাকে কিছুই মনে করে না; কবিও তখন সর্বগ্রাসী রহস্যময়ি প্রকৃতির কাছে নিজের সংগে অন্য জীবের প্রভেদ দেখেন না। কখনো তিনি নিজেকে দেখেন সজীব পিয়ানো যন্ত্রের মতো; ভেতরে অন্ধকারের মধ্যে অনেকগুলো তার এবং কলবল আছে, কখন কে এসে তাকে বাজায় তিনি জানেন না, কেন বাজে তাও বোঝা শক্ত; কেবল তালে না বেতালে, সুখ না ব্যথা, কোমল না কড়া বাজে সেইটাই তিনি জানতে পারেন।

কবি রবীন্দ্রনাথের এই ছিন্নপত্রাবলী ব্যক্তিগত পত্রের সীমানা ছাড়িয়ে এক বিশেষ সার্বজনীনতায় পৌঁছে বাংলা পত্র সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যময় করেছে। ব্যক্তিগত চিঠিপত্র সাহিত্য হয়ে ওঠার পিছনে পত্র লেখকের বিশিষ্ট, মানসিকতার প্রমাণ থেকে যায়। রবীন্দ্রমানসলোক ও অন্তর্জীবনের অসামান্য রসভাষ্য এই পত্রগুচ্ছ। উপলব্ধির গভীরতা, আন্তরিকতা ও ছিন্নপত্রে কবিত্ব সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্যে দুর্লভ।[২]

তথ্যসূত্র

১. গোলাম মুরশিদ; রবীন্দ্রবিশ্বে পূর্ববঙ্গ, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রচর্চা; বাংলা একাডেমি, ঢাকা; প্রথম পুনর্মুদ্রণ, মার্চ, ১৯৯৩; পৃষ্ঠা-৩৮।
২. মীনাক্ষী সিংহ, বাংলা, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রয়োদশতম পুনর্মুদ্রণ, জানুয়ারি ২০২০, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!