উন্মাদনামা বাঙালির ব্যর্থতার ইতিহাসকে তুলে ধরে

অনুপ সাদির উন্মাদনামা বা আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে স্মরণীয়। এর ভাষা এবং ভাব স্বাতন্ত্র তাৎপর্যমণ্ডিত; বিষয় ও বৈচিত্র্যে উল্লেখযোগ্য।  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, কমলাকান্তের দপ্তর। কমলাকান্ত সমাজের অসঙ্গতিগুলোকে দেখতে পান আফিমের আশির্বাদে। কমলাকান্ত আদালতে মঙ্গলাকে বলেছিলেন গরু চোরকে দিয়ে দিতে কারণ দুধ যে খায় গরু মূলত তারই। মঙ্গলা গরু পালন করে, দুধ দোয় কিন্তু দুধ খায় অন্যে। এই শ্লেষ ও সত্য বচন ‘আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প’র মূল উপজীব্য। ‘আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প’র সূচনাংশে দেখা যায় নগ্ন গায়ের একটি লোককে যার শ্লেষ ও ক্ষুব্ধতায়, কখনো কখনো আশাবাদি বচনে পাঠক দেখতে পান হাজার বছরের বাঙালির ব্যর্থতার ইতিহাসকে।

“আমার দাদিরা ছড়া কাটে দেশি
আর বিদেশি কাকে খায় দুগ্ধবতি গাভীর কচি দুধের সর”

বাঙালির পূর্বজরা দেশি দেশি বুলিতে জীবনপাত করেছেন আর দুধের সরটুকু সব সময় খেয়ে গেছে বিদেশি কাকেরা। বিদেশি কাকেদের সেবা করে করে কেটেছে বাঙালির জীবন। এই একটি পঙক্তিতেই নিহিত রয়েছে সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থের বচনের সারকথা এবং আছে ভাব ও ভাষার মূর্ছনাও। লেখক অনুসরণ করেননি নান্দনিকতার প্রথাগত রীতি, বক্তব্যের ব্যাপকতা ও তাৎপর্যে সৃষ্টি হয়েছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা। শাহানামা আর আরব্য রজনীর মত বাঙালির দুঃখের রজনীও যেন শেষ হয় না হাজার বছরেও। বাঙালির দারিদ্র্য পেয়েছে কিংবদন্তীর রূপ। বাঙালির ব্যর্থতা আর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসগুলো হার মানিয়েছে ট্রয়ের ঘোড়ার বিস্ময়কেও। হতভাগ্য বাঙালির ব্যর্থ সেই সব দিবস রজনীর অল্পকিছু শোকগাথা স্থান পেয়েছে ‘আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প’ কাব্যগ্রন্থে। অর্ধ উলঙ্গ, ছিন্ন বস্ত্র, জীর্ণদেহ এক ব্যক্তি যে নিরন্ন পরিত্যক্ত বাঙালিরই প্রতিভু তারই ক্রুদ্ধ, হতাশা, ব্যর্থতা; কখনো কখনো আশার বাণীর রূপকে গ্রথিত হয়ে উঠেছে বাংলার ইতিহাস

শিল্পের নেই কোনো সার্বজনীন মাপকাঠি তাই যুগশ্রেষ্ঠ শিল্পগুলোকে চিনে নিতে কখনো কখনো বিলম্ব হয়ে যায়, আবার তুচ্ছ, তাৎপর্যহীন সৃষ্টি কোনো কোনো সময় আধিপত্য করে দশকের পর দশক। লেখক প্রথাগত অনেক নিয়মই মানেননি; মানেননি বানানের প্রচলিত বিধি, অনুসরণ করেননি শিল্প সৃজনের বহুল ব্যবহৃত পথ, আবার বক্তব্যের ক্ষেত্রেও নেই কৃত্রিমতা। কখনো কখনো হয়তো বোধ হয় শিল্পসৃজনের কোন প্রচেষ্টাই লেখক করেননি কিন্তু বক্তব্যের স্বচ্ছতা ও গতিময়তায় রয়েছে অভ্যন্তরীণ একটি ছন্দ যা কাব্যগ্রন্থটিকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এটি খণ্ড কাব্য নয়, নয় দীর্ঘ কবিতা। প্রবন্ধের বক্তব্য থাকলেও আঙ্গিগত দিক দিয়ে এটি প্রবন্ধ নয় কখনই।

রচনা রীতিতে এটি কাব্য কিন্তু বিষয়ে এটিকে জবানবন্দী বলা চলে। কাজী নজরুল বা সক্রেটিসের জবানবন্দীর কথা সকলে জানেন। ‘আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প’ কবিতাটিও লেখকের জবানবন্দী ব্যতীত ভিন্ন কিছু নয়। এই সব ক্রোধান্বিত বক্তব্য কেবল লেখকের নয়, দেশের সব মানুষের। লেখক এখানে কৈফিয়ত দেননি, দিয়েছেন বক্তৃতা ও সিদ্ধান্ত। একজন রাগান্বিত ব্যক্তির ভাবনা আবদ্ধ হয়ে রয়েছে কাব্যের কোমলাতা ও বক্তব্যের কঠোরতায়। এই কাব্যগ্রন্থটির শিল্প মূলত গণশিল্পেরই মূর্তরূপ। কর্মক্লান্ত, হতাশ, বিপ্লব আকাঙ্ক্ষী, বিশ্বাসভঙ্গে ক্ষুব্ধ জনতা যে ভাষায় কথা বলে, জনতা যে ভাষায় দুর্বৃত্তদের মুণ্ডুপাত করে বা বিপ্লবে-সংগ্রামে জনতা যে ভাষায় একে অপরকে সাহস যোগায়; কবিতাগুলোর ভাষা সেই ভাষারই মূর্তরূপ।

“এসে গেছে গোটা দেশে ভারত মাতার সুবাদে টাটা সাহেব শিশ্ন নিয়ে,
লালন তোমার ছেউড়িয়ায় এখন প্রিন্স পুঁজিবাদ;
জমাও জন্মাও টাকা,
গর্তের মধ্যে জন্মাও তেল মধু আর সুন্দরী;”

এই ভাষা শ্রমিকের, কৃষকের। জীবন সংগ্রামে ক্লিষ্ট যারা, শ্রমের কড়িতে যাদের অন্ন যোটে; ভদ্র ভাষায় তাদের কাজ কী? এই মানুষেরা আরও আক্ষেপ করে বলে,

“আমরা যেন শুয়োপোকা তেলাপোকা ছারপোকা উইপোকা,
ছুঁচো আর ইঁদুর আর চামচিকার মতো কথা বলি,

গণশত্রুরা গামলা আমলা আর তেল ভালোবাসে
…. বেজন্মা বেইমানরা মীরজাফরের বন্ধু
দাঙ্গাবাজ, মতলববাজ, ভাঙল তেলের শিশি, ভাঙো বাঙলা,
গুলি চালা।

আধুরা পাবলিকেরা শুয়োরের মতো ঘেঁচু খোঁজে আর দিন দিন বাঁচে,
সৌন্দর্য সাবান নিরমা বা উপনিবেশিক সাবান জনসন চেনে না”

শিল্পের চিরাচরিত রূপ, নান্দনিকতা, কোমলতার সেই পরশও দুষ্প্রাপ্য নয়; কিন্তু লেখক যেন সচেতনভাবে বর্জন করেছেন নান্দনিকতা সৃজনের সেই ভদ্রপন্থাকে। শ্রেণি ঘৃণায় ক্রোধকম্পিত জনগণের উন্মাদ ভাষাই আধিপত্য করে গেছে পঙক্তিতে পঙক্তিতে। তবু কোনো কোনো ছত্র হয়ে উঠেছে নান্দনিকতায় অনন্য। নিচে তিনটি অনুচ্ছেদ থেকে উদাহরণ দেয়া গেল, আপনারা পড়ে দেখুন

“এই হাতে পাবি তুই প্রাচীন ভারতের ধূলিকণা
কালের আয়নায় দেখা স্নিগ্ধ আলো কণা
আসছে আগামিতে পাখির ঠোঁটে ফুল
গোপন সাধনা
নীল জল ………….. ”

“আমরা কী অ্যাডাম আর ইভের মতো পতিত
আমরা কী ইউরো আমিরিকানদের মতো পতিত
আমরা কী মধ্যপ্রাচ্যীয়দের মতো পতিত
আমরা কী পচাগলা রক্তাক্ত ইতিহাসের মতো পতিত
আমরা কী পাশবিকতার কাছে পরাজিত ও পতিত
আমরা কী সগোত্রের মাংস পছন্দ করি”

“ভাষাই পরম প্রেম ভাষাই প্রতীক
তোমাকে ভেবেছে যারা সবাই লিখেছে ভাষা
ভাষাই সবার বেড়ে রাজদুলালি
ভাষাই সর্বশ্রেষ্ঠ সর্ব শক্তিশালি
ভাষাই তোমাকে ডাকে অভিজ্ঞতার ঘরে
ভাষাই তোমাকে নেয় রাতদুপুরে
ভাষাই শোনায় রাজপথের গল্প”

এই সব পঙক্তিতে রয়েছে শিল্পসৌন্দর্য সৃজনের প্রয়াস; পাঠ করতে করতে কোনো কোনো সময় ভ্রম হয় যেন পাঠ করছি চমৎকার সুন্দর একটি কাব্য যে কাব্য আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবে বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য ও মাটির শিহরণের সঙ্গে। কিন্তু তখনই আবেশ দূর করে তটস্থ হতে হয়, শোনা যায় অতীতের ভাঙন আর অগ্নিকাণ্ডের চিৎকার। কোটি কোটি মানুষের আত্মাহুতি, দীর্ঘশ্বাস ও অভিশাপের চিৎকার। নরপশু মরে যত, রেখে যায় তার দ্বিগুণ। পুরনো দিনের সেই সব বিশ্বাসভঙ্গেও কর্মফলে আজও বাংলার মাটি রক্তাক্ত হয় মাঝে মাঝে। তবু বিপ্লব চুরি হয়। বাংলার মানুষ শত্রু চিনতে ভুল করে বারবার। ১৭৫৭ সালে বাঙালিই বাংলাকে তুলে দিয়েছিল ক্লাইভের হাতে, একই নাটকের পুনঃমঞ্চায়ন চলছে আবার। আরও বেশি রঙ ও রূপে সজ্জিত হয়ে আসে রূপকথার সেই রাক্ষসীরা; তবু মানুষ চিনতে পারে না তাকে। গল্পের এই নায়ক একাকী চিৎকার করে চলে রাতভর;— কিন্তু ঘুম ভাঙে না বাঙালির। তবু মনে হয় সেদিন ছিল শুধু মিরজাফর, উমিচাঁদ, রায়বল্লভ, জগৎশেঠ; আজ যেন এরা জন্মেছে ঘরে ঘরে। এত এত জানোয়ার বাংলার মানুষ দেখেনি কোন দিন। হুমায়ুন আজাদ বলেন,

“যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধভরপুর-
সে তুমি কেমন ক’রে, বাঙলা, সে তুমি কেমন ক’রে
দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছো পালেপালে শুয়োরকুকুর।”

সামন্তীয় সেই প্রভুরা ফিরে এসেছেন রাজনীতিবিদের ছদ্মবেশে। নেতার এমন রূপ বাঙালি আর কোনো দিন দেখেনি। এই নেতারাই যুগে যুগে বাঙালির রক্তপ্লাবি সংগ্রাম ব্যর্থ করে দিয়েছে। হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, যে রাজনীতিবিদদের দেখলে গাছের ফুল ঝরে যায়, গর্ভের শিশুরা মরে যায়, নদী, মাঠ, ঘাট ঢেকে যায় ছাইয়ে। হুমায়ূন আজাদের সম্পূর্ণ কবিতাটি তুলে ধরে রাজনীতিবিদগণের রাক্ষসীয় কুকর্মের খতিয়ান, যখন রাজনীতিবিদগণ আবির্ভূত হয় “দেখি হঠাৎ আগুন লাগে চাষীদের মেয়েদের বিব্রত আঁচলে; সমস্ত শহর জুড়ে শুরু হয় খুন, লুঠ, সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ, ভেঙে পড়ে শিল্পকলা, গদ্যপদ্য; দাউদাউ পোড়ে পৃষ্ঠা সমস্ত গ্রন্থের; ডাল থেকে গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল, আর্তনাদ করে বাঁশি যখন ওঠেন মঞ্চে রাজনীতিবিদগণ”।

বাঙালি দেখেছে অগণিত নৃপতি, গণপতি, শাসক কিন্তু নেতার এইরূপ দেখেনি কোন দিন যাদের দেখলে গাছের ফুল ঝরে যায়, মরে যায় গর্ভের শিশু। স্বপ্ন দেখে তবু এদেশের মানুষ। যদিও বাঙালির দুর্ভাগ্য, তাদের নেতারা বাংলাকে নিজের মনে করেনি। তাদের দৃষ্টিতে বাংলা হলো কামধেনু। তাদের কামনা পূরণ করাই যেন কামধেনুর একমাত্র কাজ। তারা যেন বাস করেন উপনিবেশিক শাসকের মতো। শোষণ করা সম্পদগুলো তারা পাচার করেন দূর দেশে। অথচ এই দেশটিকেই গড়ে তোলা যেত তিলোত্তমারূপে। বাঙালি ধনপতি নেতারা যথেষ্ট উদার, তারা নিজ স্ত্রীকে ত্যানা করে পরস্ত্রীকে সোনা যোগাতে ব্যস্ত। বাঙালির দুর্ভাগ্য তারা সৎ নেতা পায়নি বহুদিন। জনগণ যাদেরকে নেতারূপে তৈরি করার চেষ্টা করেছেন, তথাকথিত সেসব নেতাও পদ পদবী ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করতে পারেনি। মেফিস্টোফিলিসের মতো প্রায় সব নেতাই স্বীয় আত্মা বিক্রি করেছে শয়তানের কাছে। মানুষ তবু জাগতে চায়, তারা স্বপ্ন দেখা ত্যাগ করতে চায় না। পাখির ঠোঁট থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়া দূর্বা ঘাসের মতোই তারা আবার জেগে উঠতে চায়।

“টেকনাফ হতে তেতুলিয়ায়, এশিয়া হতে আফ্রিকায়
একটি কথাই শোনা যায়
আমরা আসছি, সমস্ত রাষ্ট্রীয় গোলামি খেদিয়ে
আমরা রক্ষা করবো আমার শ্রমিক আমার কৃষক,
বাঁচাবো আমার সোঁদা মাটি গন্ধ,
তুমিই আমাদের প্রথম ঝলকিত প্রেমের গন্তব্য,
আমরা পৌঁছাবোই তোমার মুক্তির বন্দরে।”

এই কাব্যগ্রন্থের কথকের এই আহ্বান নূরলদীনের কথা মনে করিয়ে দেয়; নূরলদীনও এভাবেই আহ্বান করেছিলেন শোষিত মানুষদের; —

“পাহাড়ি ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাষায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?”

যুগের দাবী জনদাবীর মধ্যদিয়েই প্রকাশিত হয়েছে বারবার, মহান কোনো নেতা বাঙালিকে পথ দেখাতে পারেনি কোনো দিন। জনদাবীর সাথে সাথে তারা শুধু নিজের মত ও দলকে চালিত করেছেন। বাঙালির সব আন্দোলন, সংগ্রামই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, বাঙালি প্রত্যাশা করেছিল মহান কোনো যুগশ্রেষ্ঠ নেতা বাঙালিকে মুক্তির পথ দেখিয়ে দেবে; বিলুপ্ত হবে হাজার বছরের ব্যর্থতার গ্লানি। কিন্তু বাঙালি নেতা তৈরি করতে পারেনি, যারা হতে পারতেন তারা ভণ্ড, চাটুকারদের দ্বারা বিপথে চালিত হয়েছেন। লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন,

নেতাকে বুঝতে হয় যুগের দাবী, সুচিন্তিত ভাবনা, গভীর জ্ঞান, আন্তরিক দেশপ্রেম দ্বারা চালিত হয়ে নেতা জাতিকে যুগোপযোগি করে তুলবেন। নেতা স্বতস্ফূর্ত ঘটনা প্রবাহে বিচলিত হবেন না বরং ঘটনাকেই কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্যে চালিত হবেন। অপরপক্ষে নেতার গুণাবলি বিকাশে জনগণকেও সতর্ক হতে হবে। কেননা জনসমর্থনের অভাবে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে একটি ভাল নেতৃত্বও। বাংলার ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে নেতৃত্বকে ঘিরে জড় হয় স্বার্থান্ধ, ভণ্ড, নিশাচর, হীন ব্যক্তিরা। এরা যুগে যুগে নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করে এসেছে।

আমাদের আলোচ্য অনুপ সাদির ‘আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প’ সতেরটি অধ্যায়ে বিভক্ত। অধ্যায়গুলোর নাম দেখে অনুভব করা যায় এর ভেতরের বক্তব্যেও প্রকৃতি। নামকরণেও রয়েছে বিশেষত্ব। যেমন, একটি অধ্যায়ের নাম চা, ইলেকশন এবং ইতিহাস। আরেকটির নাম, পুরুষালী নেতা ও ভাতার, অন্যটির শিরোনাম দল ও পরাধীনতার ধারাবাহিকতা। এইরকমভাবে প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনামগুলো স্বতন্ত্র হয়েছে। কাব্যগ্রন্থের শিরোনামগুলোই বক্তব্যের প্রতিভূ। লেখক কখনো তাঁর বক্তব্যকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন, কখনো ইঙ্গিত করেছেন; বক্তব্যের পরিসর কখনো দেশ, কখনো বিদেশ। ছোট্ট পরিসরের লেখাটিতে এসেছে অতীত বর্তমানের অনেক প্রসঙ্গ সে সব পাঠ করে আমরা কোনো কবি বা সাধাররণ কোনো শিল্পসৃজন প্রয়াসী লেখককে দেখতে পাই না; দেখি একজন মার্কসবাদী চেতনার চিন্তাবিদকে যিনি বলেন মার্কসবাদের কথা, বলেন মাওবাদের কথাও। যেমন কবি ‘চা, ইলেকশন এবং ইতিহাস’ অংশে বলেন,

‘বংগভবনে দেখেন কাঁকড়ার সংগে কাস্তের মিতালি
সময়টা কাকা একাত্তরের আগে বা পরে
চলেন আর একটু জোরে
ঠেলা দেন কমরেড, আর একটু জোরে ঠেলা দেন
এইতো আসিল কচুখেতে বিপ্লব!’

একশত বছর থেকে বিপ্লবের কাস্তেতে ধার দিচ্ছে বামেরা কিন্তু তারা রণনীতি আর রণকৌশলই ঠিক করে উঠতে পারেনি কোন দিন। ভণ্ড ও নিশাচর এই বামেরাই বিনষ্ট করে এদেশে বিপ্লবের সম্ভাবনা; এমনকি তারা বিনষ্ট করেছে প্রগতিশীল শক্তির সম্ভাবনাকেও। তারা দল ভাঙে, জোট ভাঙে। ব্যাঙের মত এক ঝুড়িতে তারা কখনো থাকে না। আবার কোনো কোনো বাম দল বুর্জোয়া দলের ছায়া ছাড়া বাঁচে না। তারা কখনো হয়েছে ভণ্ড, কখনো নির্বোধ কখনো বা ভাঁড়। অবস্থা তারা এমনই তৈরি করেছেন যে বাম পরিচয় দেওয়াই হয়ে উঠেছে লজ্জাকর। এই ভণ্ডদের উদ্দেশ্য করেই লেখক উল্লেখিত চরণ কটি রচনা করেছেন। ‘দুর্বৃত্তরাই আজ বেশি জোটবদ্ধ আর সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ ব্যর্থ হয়নি এসব ভবিষ্যবাণী। প্রগতিশীলেরা যখন বিবাদ করেন তারিখ সাল নিয়ে তখন মন্ত্রীরা বলেন,

মন্ত্রীসাব কহেন কোটি কোটি টাকা দেন,
এখন আর অল্পেতে পোষায় না,
যত পারেন দেন, ডাল ভাত খাবো,
প্রতিদিন মাছ গোস্ত ভালো লাগে না,
… …
নেত্রি শুধু মাঝদুপুরে ভাত ঘুম দেয়, উচ্চ লোভী ঘুম!’
অপরপক্ষে;—

‘আমাদের মেয়েদের মাথার চুলে বিলি কাটে এখন হিংসুটে সময়।’

একই দেশে মানুষ একইভাবে বাঁচে না। জিম করবেটের লেখায় পড়েছিলাম নরখাদক বাঘের নর মাংসে উদরপূর্তি করার পরে অরণ্যেও গহীনে গিয়ে ঘুম দেয়; নর মাংসাশী ওই সব প্রাণিদের মত এরাও শুষে নেয় মানুষের প্রাণ তারপর বিলাসী জীবনে এলিয়ে দেয় নধর দেহ। এদের মুখগুলোতে কেন জানি জিম করবেটের সেই সব নর খাদক বাঘের মুখই দেখতে পাই, মানুষের রক্ত মাংসে তৃপ্ত সে মুখ।

মানুষ পরাজিত হয়ে এসেছে যুগে যুগে, শতকে শতকে। ১৮৫৭, ১৯৪৭-৪৮, ১৯৭১ কত স্বপ্নই দেখিয়েছিল। চালু হয়েছে রাজনীতির নতুন নতুন প্যাকেজ, বামেরা ব্যস্ত নতুন নতুন তত্ত্ব নির্ধারণে, দলগুলো খুলেছে হ্যাচারি সেখানে উৎপাদন হচ্ছে পোনা। কেউ চায় মধ্যযুগের অন্ধকার, কেউ চায় মরুচারী হতে, কেউবা গুণগাণ করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের। মানুষ নিমজ্জিত হয়েছে তুচ্ছ ভোগে, যযাতির মত তাদের চাই সহস্র সহস্র বছরের যৌবন। মি. কুর্তৎস জন্ম নিচ্ছেন ঘরে। লেখক প্রসঙ্গ এনেছেন কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস-এর। মি. কুর্তৎস আইভরি কোস্টে গিয়েছেন হাতির দাঁতের খোঁজে। বনের গহীন থেকে আরও গহীনে, অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে থাকেন তিনি। দাঁত যোগাতে যোগাতে বিলুপ্ত হয়ে যায় হাতিরাই। কুর্তৎস খুন করেন অসংখ্য মানুষকে, পৃথিবীর সব ধন তার চাই। সব কিছুকেই তিনি বলেন, ‘আমার’। এই কুর্তৎস সমগ্র ইউরোপেরই সৃষ্টি। বাণিজ্যতরী ভাসিয়ে জাহাজ বোঝাই করে ধন আনা ছাড়া তারা আর কিছু ভাবতে চান না। এই কুর্তৎস আর মি. হাইডের ভূত পেয়ে বসেছে জনগণের একাংশকেও, বাণিজ্য জাহাজে কোন অংশই তারা পায় না তবু যেন কীসের প্রত্যাশায় তাদের জীবন কেটে যায়। ভোগ আর বিলাসের স্বপ্নে কেটে যায় এক একটি জীবন, দাসেরাও হতে চায় দাস মালিক।

মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ছে সহস্র কারণে। কেউ আত্ম স্বার্থে নিমগ্ন, কেউবা গোলামি করে। পৃথিবীতে বাঙালি একমাত্র জাতি হয়তো যারা ভুলতে পারেন না যে মানুষ সুদূর আদি কালে বনের কোনো প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছে। মিঃ কুর্তস আর মিঃ হাইডের ভূত তাই সদাই বাঙালি সমাজে দেখা যায়। তারা জঙ্গলের নিয়মের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না, হয়তো চায়ও না।

আরো পড়ুন

এই বইটির নাম আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প। আধুনিক যুগের মানুষেরা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে যুক্ত। মানুষের মানুষ হয়ে উঠার সংগ্রাম দিন দিন হয়ে উঠছে আরো জটিল। পৃথিবীতে পুঁজিপতিরা তৈরি করছে হ্যাচারি, সেখান থেকে জন্ম নিচ্ছে যে মানুষেরা তারা মানবতাহীন জড় মানুষ। তাদের মানবীয় গুণগুলো বিলুপ্ত হয়ে চলছে দিন দিন। কিন্তু অনুপ সাদির এই বইটির কিছু বাক্য পড়ে বোধ হচ্ছে মানুষ শুধু অমানবিকই হয়নি, সে ফিরে যেতে চাইছে জঙ্গলের আদি পিতার স্তরে, যেখানে মানব সৃষ্ট বিধানের কোনো স্থান নেই, জঙ্গলে কেবল চলে জঙ্গলের আইন। শ্লেষ করে লেখক বলেন,

‘হে সাম্রাজ্যপতি, হে শাহেন শাহর বংশধরগন
কার্তিক মাসে কিছু উচ্ছিষ্টের ব্যবস্থা করো আমাদের জন্য,
হামরা বাঁচি থাকবার চাই’।

এইসব বিভ্রান্ত জনতাকে দেখে অনুপ সাদি বলেন, মাও সেতুং ৬০ কোটি মানুষকে একত্রিত করেছিলেন, আমরা ১৫ কোটিকেও পারিনি।

‘কী হতে কী করতে গিয়ে এখন চোরাবালি ও কাদায় নিজেরাই ডুবেছি বারবার
দল ভেঙে গোত্র, গোত্র ভেঙে বর্গ, বর্গ ভেঙে গোষ্ঠি, গোষ্ঠি ভেঙে ব্যক্তিতে’

‘আমি তুমি তোমরা বাঙলার পথে পথে ঘুরলাম
মানুষ খুঁজলাম
সেই মানুষ যারা একদা সঙগ্রামি
এবং এখনো এই দুই হাজার ছয় কী সাত কী দশ সালেও
ভেঙে যাওয়া কন্ঠে প্রতিবাদের গান গায়’

কিন্তু কবি অনুপ সাদি শেষ পর্যন্ত জঙ্গলের আইনের পক্ষে নন। তিনি হাজারো মানুষের সাম্যের আইনের পথেই নিয়ে যেতে চান মানুষকে। লেখক আরও বলেন,

‘যে নেতা এখনো আছে আমাদের অনুভবে,
যে বাড়েনি ভোরের আলোর মতো,
যে মিশেছে জনতার সাথে,
যে চিহ্ন রেখে চলে গেছে নিজের গন্তব্যে,
সেই তাকে আমি দেখতে চাই
হাজারো মানুষের ভিড়ে;’

লেখক উন্মাদনামা কাব্যগ্রন্থে মুক্তিদাতা একজন নেতার আবির্ভাব আকাঙ্ক্ষা করেছেন, কেমন হবেন তিনি, তিনি কি পারবেন বাঙালির দুর্বলতাগুলো থেকে মুক্ত থেকে বাঙালিকে একটি সম্মানীয় স্তরে উন্নীত করতে। বাঙালির চারিত্রিক দুর্বলতার কথা কেউই অস্বীকার করেননি। বাঙালিকে কেউ বলেছেন হুজুগে কেউবা রুগ্ন। কিন্তু যুগে যুগে দেখা এই সাধারণ বাঙালিরাই বড় বড় আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, জাতিকে টেনে নিয়ে গেছে স্বাধীনতার দিকে; তৎকালের নেতারা কেবল জনআকাঙ্ক্ষার ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন আর সুযোগ বুঝে সময় ও জনদাবীকে উপেক্ষা করে সমস্ত ত্যাগ, রক্তপাতকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন। কেন বারবার ব্যর্থ হয় এদেশের মানুষ? প্রগতির দিকে মানুষ তো সব সময়ই যেতে চেয়েছে তাহলে কী কারণে এই ব্যর্থতা।

Leave a Comment

error: Content is protected !!