‘পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি’ কবিতাগ্রন্থ প্রসঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ

অমিত মণ্ডল,
লেখক ও আলোচক

বইয়ের নাম: পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি,
প্রকাশক: প্রজ্ঞা প্রকাশন,
প্রথম প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০০৪,
প্রচ্ছদ: শেফা,
মূল্য: ১০০ টাকা মাত্র

একজন কবি সমাজকে দেখেন অনুবীক্ষণ যন্ত্রের ভিতর দিয়ে, সমাজের অনেক ঘটনা তার মনকে নাড়া দেয়, তিনি তা প্রকাশও করতে পারেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। তাই তার কবিতায় উঠে আসে অনেক সাধারণ ও তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা। তেমনি, কবি অনুপ সাদি তার সাবলীল সৃষ্টিশৈলির মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন অনেক সাধারণ ও তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাকে। যেমন দেখা যায়, এই বইয়ের “বাঁশিঅলা” কবিতায়,

“আমি বাজাই বাঁশি
মনের আনন্দে নয়,
মনহরিনির মন হরন করার জন্যে নয়,
আমি বাঁশি বেচি,”

(বাঁশিঅলা)

এখানে কবি তুলে এনেছেন আমাদের সমাজের অত্যন্ত সাধারণ একজন বাঁশি বিক্রেতাকে, যে বাঁশি বিক্রি করে এবং বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে সে নিজেই বাঁশি বাজিয়ে শোনায়।

শুধু এই সাধারণ ঘটনাই নয়, তার কবিতায় সামাজিক দায়বদ্ধতাও প্রকাশ পেয়েছে। যেমন–

“তদুপরি আমি দেখছি মশাল হাতে কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ
লড়ছে
আমার জন্যে, তোমার জন্যে, আমাদের জন্যে;
আমরা এখনো নিঃস্ব বা নিশ্চিহ্ন হইনি
আমরা
আছি
আমরা
লড়ছি
এর চেয়ে বড় সত্য আর কোথাও নেই।”

(সহকর্মিদের প্রতি)

অথবা,

“পৃথিবীর সুন্দর কথাগুলোকে তারা
নদী ও সুমুদ্রগর্ভে বিলীন করতে চেয়েছে।
তারা বোঝেনি;
সুন্দর কথা সবকালে পাল্টে নিতে হয়।”

(সৌন্দর্য বিষয়ক কথা ও শত্রুরা)

তার কবিতায় আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাষ্ট্রের সফলতা ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রকাশ পেয়েছে; শধু তাই নয়, রাষ্ট্র নিয়ে যে তার খেদ, তা প্রকাশ পেয়েছে সুস্পষ্টভাবে। যেমন–

“কারাগারের বটগাছে অবিরত দুলছে প্রেমিকার ওড়না,
সেই ওড়না ভাগ করলো পাঁচ বছর করে শাসক দুজনা।”

(দেশ বিচিত্রা)

কিংবা

“বাঙলার সন্তানেরা
লাফায় ঝাঁপায় , সুর্য বারবার নিভে যায়, —–
ধ্বংসস্তুপের নিচে জাতির হাড়গোড় ”

(ব্যর্থ স্বদেশঃ রক্তের মতো স্বপ্নের মৃত্যু)

কিংবা,

“সবুজের দ্যাশ আজ এদুজন আধামানুষের কাছে ছোটখাট ভাগাড়ের লাশ;
তদুপরি তারা দুজন মধুর অন্বেষণে গুনগুন গান ধরেছে;
‘একটা কালো জামা আর দুটো কাকতাড়ুয়া আমাদের দাও’।”

(একদিন মার্কেটে কিছুক্ষণ)

তার কবিতায় উঠে এসেছে কঠিন কঠোর বাস্তবতা যা মানুষ পরিত্যাগ করতে বা ভুলতে চাইলেও পারে না। যেমন এই লাইনগুলোতে–

“ছেলে বিক্রি করে রক্ত
কেনে মোহন লটারির টিকেট
মেয়ে চলে পথে পথে খদ্দেরের খোঁজে
সব খুব স্বাভাবিক ও সুন্দর।”(আহ কী চমৎকার)

অথবা

“শুরু হয় বিপ্লব বিপ্লব সবুজ বিপ্লব
গ্রামের ছেলে যাও সবুজ ঘরে ফিরে
ভিড় করো নাকো আর অদ্ভুত ঢাকা শহরে;
তিনটি পুরুষ প্রাচীন রীতিনীতি নিয়ে গল্প শোনায়,”

(বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের জীবনযাপনে জটলা)

কবি অনেক সুন্দর সুন্দর উপমার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন অনেক সামাজিক বৈপরীত্যকে। যেমন–

“শহরের চোখ দেখে কাদামাখা অসুখী সব মুখ
কঙকালের মতো দেহে চটা উঠা বিচ্ছিরি অসুখ”

(ঐতিহাসিক স্বপ্নপ্রাণ)

আবার

“তোমাদের সহকর্মি শ্রমিকেরা মাকড়ের মতো থিকথিক করা পোকামানুষের
জীবনযাপনে ক্লান্ত।”

(মৃত্যু এসে নিয়ে যাক শৃঙ্খলিত প্রাণ)

এছাড়া মানুষের চিরায়ত জৈবনিক প্রবৃত্তি, মানুষের আকাঙখা স্থান করে নিয়েছে তার কবিতায়। এর প্রমান পাওয়া যায় এই লাইনগুলোতে–

“মনে মনে ভাবি যদি বা হতাম এই সন্ধার আঁধার
গাঢ় হতে গাঢ়তর হতাম তোমার দশদিকে;
আলতো স্পর্শে ভুলে যেতাম আমার অস্তিত্ব সংকট। (সে ছিল আমার সন্ধাচারিনি )

এই বইয়ে কবি অনুপ সাদি কিছু ব্যতিক্রমধর্মী শব্দের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। যেমন– বংশবাতি, উপমানব, উত্তর আধুনিক ময়দা ইত্যাদি।

পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি বইয়ে অনেকগুলো ঐতিহাসিক মানব ব্যক্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন–নেরুদা, শেকসপিয়ার, গান্ধি, তিতুমীর, মোহনলাল, চে গ্যেভারা, চারু মজুমদার, নেতাজি, মেরিলিন মনরো, দারিয়ুস, র্কাল মার্কস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লক্ষন সেন, মীরজাফার, খিলজী, ম্যাক্সিম গোর্কি প্রমুখ। শুধু তাই নয় কবি এ বইয়ে অনেক গুলো পৌরানিক চরিত্রের প্রয়োগ করেছেন অত্যন্ত সার্থকতার সাথে। যেমন– দ্রৌপদি, রাধা-কৃষ্ণ, জিউস, হারকিউলিস, অর্ফিয়ুস ইত্যাদি।

পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি বইয়ে কবি প্রচলিত ধারার বিপরিতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন। তার কবিতার শিরোনামগুলোই তার প্রমান। যেমন– ‘পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি’, ‘শিরোনামহীন আগ্রাসন’, ‘নাবিকের আধুনিক বিতৃষ্ণার ব্যবচেছদ’, ‘আমি মৃত্যুকুপে, তুমি জোসনাস্নাত’, ‘পুরাতন পুরুষ’, ‘পৌরানিক প্রেম’, ‘তোমার ছন্দে জীবনানন্দে’ কিংবা ‘ফি বাৎসরিক ভুল ফল অথবা গন্ডার’। সর্বোপরি, “পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি” একটি বহুমাত্রিক আধুনিক কবিতার বই। আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন পাঠকদের অত্যন্ত আনন্দ দেবে এই কবিতাগুলি, যদি আমরা মনে রাখি কবির কবিতার একটি লাইন “সুন্দর কথা সবকালে পাল্টে নিতে হয়”।

Leave a Comment

error: Content is protected !!