রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বুননের বিদ্রুপ কবিতাগ্রন্থ ‘উন্মাদনামা’

রণো সরকার, লেখক ও গবেষক

অনুপ সাদির কবিতাগ্রন্থ ‘আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প’ লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারলে– ‘পড়তে পারলে’ বলছি কারণ, কোনো কিছু পড়তে গেলে রচনার সাধারণ যেসব বৈশিষ্ট্য: এর বাচনভঙ্গি এর ভাষা, বক্তব্যের স্বচ্ছতা;– সহজবোধ্য অথচ সুদূর ইঙ্গিতবহ তাৎপর্য– যা পাঠক আশা করে, এতে অনুপস্থিত মনে হবে। তারপরও যারা পড়তে পারবেন শেষ পর্যন্ত, দেখবেন যে, লেখাটি তীব্র বিদ্রুপ ও শ্লেষধর্মী– বিশেষ করে এটি লেখা রাজনীতিকে উদ্দেশ্য করে। আর রাজনীতির প্রতি সংখ্যাগুরু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই সুবিধার নয়। ‘ইহা একটি অরাজনৈতিক সংগঠন’ কথাটি যদি কোনো সংগঠনের প্রচারপত্রে বা মুখপত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দৃষ্টিগ্রাহ্য না করা হয়, সাধারণ জনগণ তখন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। বাবা-মা’রা সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে বারবারই রাজনীতি-টাজনীতিতে, মিছিল মিটিং-এ না জড়াতেই নির্দেশ দেয়। আর সন্তানেরা, বাবা-মার অন্য শত নির্দেশ-উপদেশ অমান্য করলেও, এটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে। ফলে বাবা-মার গর্বে বুক উঁচু হয়– তাদের গর্বে সন্তানেরাও কিছুটা বুক ফুলিয়ে তৃপ্তি অর্জন করে– ভালো চাকুরি জোটে– রূপসী ধর্মাসক্ত নারী কথামতো অপেক্ষা করে।

লেখক অনুপ সাদি যে পরিস্থিতিতে এবং নিজের যে বয়সের মাঝে থেকে রাজনীতির কথা বলছেন– মোবাইল সেট, রিংটোন, লোগো, ওয়াল পেপার, সহপাঠির ক্রমবর্ধমান বা বিলীয়মান স্তনের কথা না বলে, কিংবা পাশ্চাত্যে কোন ফ্যাশনটি দেশে হালনাগাদ আছে, এলিফ্যান্ট রোডে কোন রেস্টুরেন্টটিতে বা কোন পোষাকের দোকানে পঞ্চাশ বা সত্তর পার্সেন্ট মূল্য ছাড় দিলো বা রাশিয়ান বা জার্মান কালচারাল সেন্টারে বা অঁলিয়স ফ্রঁসেজে কিংবা বৃটিশ কাউন্সিলে কোন ছবিটির মূল্যবান বা মূল্যহীন প্রদর্শনী চললো– যে ছবিটি দেখালো তার শ্রেষ্ঠ গানটি কী চমৎকার বৈচিত্র্য আনলো, অসাধারণ কম্পোজিশন আনলো– তা না বলে। তবে এমন নয় যে লেখক কখনো এসব কথা বলেন না, কোনো নারীর উদ্ধত স্তন তার দৃষ্টিতে স্থায়ী দাগ হয়ে থাকে না, অবসরের মাঝে হঠাৎ ঝলক দিয়ে বলে না ‘এই তো আমি, আর কিছু জানি না’– বা ছুটে যান না কোনো পোশাকের দোকানে পঞ্চাশ বা ততোধিক ছাড়ের কথা শুনে, বা সিনেমা হলে কোনো আলেচিত, অ-আলোচিত ছবি দেখতে টিকেট কাউন্টারে ভিড় জমান না– বরং তাঁর দৃষ্টি তাদের চেয়ে গভীর, তাঁর আগ্রহ ততোধিক চঞ্চল, তাঁর অনুভূতি তাদের চেয়ে ঢের জাগ্রত– তাঁর চোখেও জল আসে, তাঁর শরীরে শিহরণ দোলা দেয়, বিপদ ভীত করে– কিন্তু পার্থক্য এই যে, তিনি এগুলোকে জীবনের একটি অংশ মনে করেন, সমগ্র নয়; এবং এ-অংশ থেকে বড় অংশটি তাঁর কাছে থাকে সব সময়ই তার কল্যাণ-আকাঙ্ক্ষা, তাঁর বিবেচনা, রাষ্ট্রে তাঁর কার্যকর ভূমিকা, প্রেম–যে প্রেম শুধু নারীর বুকে আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে না বরং জেগেও ওঠে, সম্প্রসারিত হয় বৃহত্তর সমষ্টিতে–কোনো প্রত্যাশা না করে নিজের জন্য, বা যতটুকু প্রত্যাশা করে নিজের জন্য, তার চেয়ে লক্ষ গুণ অপরের জন্য করে। আর এই অপরের মঙ্গলের চিন্তা–অন্তত পরোক্ষভাবে নিজের মঙ্গলের জন্যই– করার সংখ্যা যখন ক্রমশ হ্রাস পায়– সে সময় রাজনীতি যে বৃহত্তর মানুষের মধ্যে সবচেয়ে অনালোচিত বিষয়–বলার অপক্ষা রাখে না। তাই বলছিলাম যে পরিস্থিতিতে লেখক রাজনীতির প্রসঙ্গ আনলেন তা আমাদের কম পাঠকেরই আগ্রহ ধরে রাখবে– তারপরও এ প্রতিকূলতা পার হয়ে যেসব পাঠকগণ রচনাটি পড়তে সক্ষম হবেন–কারণ তাদের সেই ক্ষমতাটুকু এখনো বিলুপ্ত হয়ে যায় নি–দেখতে পাবেন লেখকের লেখায় উঠে এসেছে পূর্ব বাঙলার, পূর্ব পাকিস্তানের ও বাংলাদেশের রূপ– যে রূপটি মোটেই মোহনীয় নয়! কাজেই পাঠকের জন্য আর কোনো মোহ অবশিষ্ট রইলো না।

লেখক এখানে একজন কথকের স্থান নিয়েছেন, যে ২০০৫ সালে কোনো এক মাঠের কাছে দাঁড়িয়ে এ-কথাগুলো বলে যায়– বোঝা যায় উন্মাদ সে, সে অর্থে তার বক্তব্য স্পষ্ট। ‘কিন্তু পাগলে কীনা বলে’–কথাটুকু লেখকের অজানা নয়– অথচ তারপরও বিভিন্ন উপশিরোনামে বক্তব্য এগোয়!

শুরু হয় বর্তমান থেকে– বর্তমানের রাজনীতি, রাজনীতবিদ, নির্বাচন পদ্ধতি, সাধারণ মানুষের নির্বাচন-উৎসব– নিজের সর্বনাশের পথ সৃষ্টি করতে নিজেরাই কত আগ্রহে চা-বিড়ির বিনিময়ে বিলিয়ে চলে নিজেদের। কীভাবে নিজেদের প্রতারণার বিনিময়ে করে চলে আরো বড় প্রতারণার ব্যবস্থা–তা উঠে এসেছে; অতঃপর অতীত-রাজনীতির প্রসঙ্গ এসেছে। নিজেদের ভ্রান্ত নীতির কারণে, বা নিজেদের ছলনাপূর্তির পরিণামস্বরূপ এই বাঙলা কীভাবে বারবার লাঞ্ছিত হয়েছে ও বাঙালির উন্নতি কীভাবে বিলম্বিত ও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে ও বর্তমান পরিস্থিতিতে অবতীর্ণ হয়েছে– এসব তাতে পাওয়া যায়। কিন্তু সমালোচকের দৃঢ় ভাষার তীর্যকতা যতটুকু থাকে এতে তা পাওয়া যাবে আরো ভরপুররূপে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মনে হবে লেখকের বক্তব্য ছাড়িয়ে গেছে গালাগালিকেও। অবশ্য গালাগালি লেখক দেননি, দিয়েছে তাঁর চরিত্র– যে কথক– তার কথা আপনারা শুনতে পারেন, ফেলে দিয়ে অবজ্ঞায় চলে যেতে পারেন, বা বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন, আবার নাও পারেন– যেহেতু বক্তব্যটি কথকের!

ধরা যাক ‘পুরুষালী নেতা ও ভাতার’ অংশটুকু। বলা হচ্ছে মন্ত্রি সাহেবের কথা ও নেত্রির কথা ও তৃতীয় শ্রেণির নারীদের ভাতার চিন্তার কথা। পাশাপাশিই এদের অবস্থান–কারণ ওদের শ্রেণিটি আলাদা নয়। তারপর ‘আমরা গণশত্রু  খুঁজছি’– এখানে গণশত্রুর কথা স্পষ্ট করে না থাকলেও এই সরকারের মন্ত্রির বক্তব্যর পর: নারী, কাম, শরীর, বলবর্ধক ওষুধ, তেজি ঘোড়ার প্রসঙ্গ উল্লেখে বোঝা যায় মন্ত্রিদের কর্মের প্রকৃতির কথা– হয়তো তা গণশত্রুর কথাই।

এরাই এদেশে আজ সর্বোচ্চ পদটি দখল করে নিজের ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গদের খোরাক পূর্ণমাত্রায় নিয়ে নিঃস্ব করছে কোটি মানুষের বেঁচে থাকার সম্বল। পরিণামে দেশের সম্পদ গুটিকতকের হাতে পুঞ্জিভুত হয়েছে আর অবশিষ্টরা হয়েছে উচ্ছিষ্ট–তাই ক্রমশ নিঃস্ব! এই নিঃস্ব হঠাৎ করে আজকের গড়ে ওঠা নয়, তার ক্রমবিকাশ আছে; আবার এই ক্রমবিকাশের আছে যথেষ্ট কার্যকারণ–অতীতের সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসকে এটি করিয়ে দেয় স্মরণ।

বর্তমান বাঙলাদেশ ’৭১ এর আগে ছিল পূর্ব পাকিস্তান, ’৪৭ এর আগে পূর্ব বাঙলা– জনসংখ্যায় মুসলিম অধ্যুষিত–সাংস্কৃতিকভাবে ঐতিহাসিক কাল থেকেই তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে সমসাময়িক হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে–অন্তত এদেশে। অজ্ঞতা, অর্থনৈতিক দৈন্য, অবস্থা পরিবর্তনে যৌক্তিক চেষ্টার অভাব তাদেরকে করে রেখেছিলো সব সময় রাজনৈতিক নেতাদের ব্যবহারের অসহায় উপকরণ–অনেকটা প্রাণহীন বস্তুর মতই! বস্তুজগতে এটাই নিয়ম যে উপকরণের শক্তি যত কম তার উপর অপরের আধিপত্য তত প্রবল; –শুধু ব্যবহার নয় অপব্যবহারও চলে– বরং এটাই বেশি চলে। চলেছে তা-ই। অবিভক্ত ভারতবর্ষে বাঙলার রাজনীতি চলেছে বিভক্ত নীতিতে। হিন্দুদের মাঝে প্রগতিমুখী একটা ধারা শুরু হয়েছিলো ১৯ শতকের গোড়ায়–সেটা ছিলো সাংস্কৃতিক ভাবমণ্ডলে–তারপর কেশবচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ ঢুকে করলো অনেকাংশে সর্বনাশ। যতটা তাঁরা দিলো বাঙালি ভাবমণ্ডলে, তার চেয়ে নিলো ঢের বেশি। এঁদের দ্বারা সাংস্কৃতিক জগত যখন প্রগতির পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়লো, জনগণের সহজাত আধ্যাত্মিকতা পেলো না মুক্তি, বরং নানারূপে বৃদ্ধিই পেলো। একের উপর বৃটিশ রাজনীতি, দ্বিতীয়ত সাংস্কৃতিক ভাবমণ্ডলে আধ্যাত্মিকতার প্রাবল্য, ধর্মীয় অন্ধতা ও নিজ জাতির ভেতরে ধর্মান্ধতার কারণে বিভক্তিবোধ তৈরি করলো রাজনৈতিক বিভক্তি। একদিকে কংগ্রেস, অন্যদিকে মুসলিম লিগ। মাঝখানে হিন্দু মুসলমানকে রেখে একদিকে গান্ধি নেহেরু অপরদিকে জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দি। একদিকে ধর্ম, অন্যদিকে ধার্মিকদের নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভেবে অপরকে তুচ্ছ ভাববার প্রবণতা–যা মানুষের ভেতর থেকে হারিয়ে যাওয়া ধর্মবোধকে খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিলো এবং কখনো শীতল বা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ পেতে শুরু করেছিলো। এসব রাজনীতি মানুষকে সবার আগে শিখিয়েছিলো হিন্দু হতে, মুসলমান হতে;–যেখানে আমরা দেখি মানুষ মাত্রই স্বাধীনতাকামি সেখানে তাদের ধার্মিক করার চেষ্টা ছিলো মূলত রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা ভোগের জ্বালানির রসদ! রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হলো কয়েকবার, ভারত বিভক্ত হলো, বাঙলা বিভক্ত হলো– বাঙলাদেশ হয়ে পড়লো তারই ’ভ্রাতৃবৃন্দে’র উপনিবেশ। ’ভ্রাতৃবৃন্দ’রা ঔপনিবেশিকতার সদ্ব্যবহার করতে ভুললো না– এগারোশ মাইল দূর থেকে জানালো ভ্রাতৃসম্মান! বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি না করলে ‘ভ্রাতৃবৃন্দে’র রাজত্ব এখনো চলতো আশা করি, কারণ এখনো বহু প্রীতি বহু ভ্রাতাদের অন্তরে থেকে সুযোগ সন্ধান করে লক্ষ লক্ষ প্রাণের মৃত্যুর পরও!

লুটপাট চললো ’৭১ পর্যন্ত, অতঃপর চললো মুজিব আমলের লুটপাট–মুজিবের অসহায়ত্ব তাঁকে মৃত্যু দিলো বটে কিন্তু বাঙালির–অন্তত সেদিন থেকে বাঙলাদেশির–মৃত্যু না হয়েও মৃত্যুযন্ত্রণা চললো সামারিক শাসন ও তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়েও। আর এখন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব! হাড় নিয়ে মারামারি করা কুকুরের মতই ঘটানাটি আজ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। এসব তো বাঙলাদেশেরই কথা;–শোভন নয়–এগুলো যারা দেখে এসেছেন স্বচক্ষে এবং যারা না দেখলেও দেখার মতোই অনুভব করতে পারেন তাঁর পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব হয় না;–আমাদের লেখক যে কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন সেও সুস্থ থাকেনি–সেই হিসেবে প্রজন্মের ধারাবাহিক গল্প বলে যায় সে; শুধু ইতিহাস বলেই ক্ষান্ত থাকে না–সাথে যুক্ত করে প্রতিক্রিয়াও! বহুতল ভবনের উপর থেকে কাউকে ছুঁড়ে ফেলে যদি তাকে সাবলীল কথা বলার অনুরোধ জানানোও হয়, সেটি রক্ষা করা পতিতের পক্ষে সম্ভব হয় না। সে যদি মারা গিয়ে থাকে তাহলে সুস্থ থাকে, আর বেঁচে থাকলে উন্মাদ হয়, কোনো এক মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মানুষ মানুষ আর মানুষের কথা বলে অন্তত অভিযোগটি সারে। 

পুরো লেখাটিই বস্তুত বিদ্রুপের আধার; আর কালে কালে বিদ্রুপ ভাষা সেখানেই পায় যেখানে সহজ করে কথা বলাটা শঙ্কামুক্ত থাকে না। উনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় যথেষ্ট বিদ্রুপ ছিলো, কারণ তিনি পরাধীন দেশের নাগরিক ছিলেন, চিনে লু শুনের ছোট গল্পে রয়েছে প্রচণ্ড বিদ্রুপ, এমনকি ’৪৭ পরবর্তি বাঙলাদেশের কবি সিকান্দার আবু জাফরের লেখায়ও তার সন্ধান প্রচুর–তখনও দেশ পরাধীন। আবার স্বাধীন দেশে সামাজিক স্খলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতার মাঝে আত্মনিরাপত্তাহীন লেখক আশ্রয় নেন বিদ্রুপের। আমাদের বর্তমান লেখককেও তা করতে দেখা যায়। দেখা যায় তাঁর বিদ্রুপ স্পর্শ করে সামাজিক বুননকে যতটা, রাষ্ট্রীয় বুননকে তার চেয়ে অনেক বেশি। পুরো রাষ্ট্রটিকে তিনি সময়ে সময়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন;–প্রতিক্রিয়া যা সঞ্চয় করেছিলেন সবগুলোই উদগত করলেন এখানে–কেবল বর্তমানের বিরুদ্ধে নয়, অতীতের বিরুদ্ধে–বরং যতটা বর্তমানের বিরুদ্ধে তার চেয়ে বেশি অতীতকে। যে অতীতকে তিনি নিশ্চিত নিজ দৃষ্টিগ্রাহ্য অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করেননি–প্রামাণ্য তথ্য, বিশ্লেষণ ইত্যাদি তাঁকে সাহায্য করেছে, তবে ওইসব লেখার সিদ্ধান্ত তাঁকে তার বিবেচনা থেকে সরিয়ে নেয়নি–যে বিবেচনা, কল্যাণ-আকাঙ্ক্ষার, বর্তমান সমাজের উন্নতির, প্রগতির পথের।

আরো পড়ুন

এটা অত্যন্ত আশার যে, লেখক সে পথেই হেঁটেছেন যেটি প্রগতির– উন্নতি অন্তরায়ের নয়, বা নয় আবর্জনার মতো নষ্ট চিন্তার স্তুপের বা প্রগতি-পথে ভেক ধরে থাকা অপদার্থের!

আবার একই সঙ্গে হতাশার এই কারণে যে, লেখক সঠিক পথে হাঁটছেন বটে, কিন্তু হাঁটছেন অনেকটা মাতালের মতোই–মদ খেয়েছেন বলে নয়, বরং মাতলামির জন্য। যদিও জানি আমাদের সমাজে সুস্থ থাকাটা অস্বাভাবিক, মাতলামি না করে থাকাটা সহজ নয়! বা, সে যদি সুস্থ থাকে, আশ্রয় নিতে হয় বিদ্রুপের–একে ঘিরেই তাঁর জীবনবোধ ও ভাষা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে–অনেকটা অক্ষমের মতোই–দুর্বল নারীর মনঃপীড়ার মতোই অব্যক্ত–বা ব্যক্ত হলেও সর্বোচ্চ উষ্ণ অশ্রুর মধ্য দিয়ে, অসহায়ের মতো!

কিন্তু এ কথা ভুললে হবে না, প্রতিবাদের ভাষা আমরা যতটা সহজে সরল করে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পারি সেটা ততই স্বাভাবিক, আমাদের আত্মমর্যাদার সহায়ক। না হলে সেই চর্যাপদের সময় থেকে উনিশ শতকের কোলাহল পেরিয়ে ক্রমপরাধীনতার যন্ত্রণার মাঝে আমাদের যে প্রতিবাদ বাধ্যতামূলকভাবে বক্র হয়ে পড়েছে–সে আজ শুধু একটি অবলম্বনই নয়, বরং হয়ে পড়েছে অভ্যাস। আর এ-যখন অভ্যাসে পরিণত হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই ফলপ্রসু হয় না। শব্দের গতি ধীর, সে বাঁকা পথে চলে বটে; কিন্তু আলো দ্রুতগামী, আর তার জন্য চাই সরল পথ– তাই দ্রুতগামী আলোর জন্য সরল পথটাই সহজ। তাই, যদিও দুটো পথই কার্যকর, তারপর দ্বিতীয়টাই হওয়া উচিত আমাদের প্রতিবাদের ও নির্মাণের ভাষা। কেবল অবজ্ঞা করেই কাজ সমাপ্ত হয় না। পথের আবর্জনাকে নিন্দা করে সে পথ ত্যাগ করা বা ঘৃণায় শ্বাস বন্ধ করে চোখ ফিরিয়ে চলে যাওয়া তথাকথিত ভদ্র নাগরিকের কাজ হতে পারে বটে, তবে কর্মীর অমন করলে চলে না। ঘৃণা থাকবে, সাথে সাথে থাকার প্রয়োজন আছে আবজর্না সরানোর আকাঙ্ক্ষাও! দেশের সকলেই নাগরিক হতে চায়, তাই কর্মীদের কাঁধে চাপে ভার, ওদের অবসর-বিলাস-ব্যস্ততার!

রচনাকাল ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৬।
জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Comment

error: Content is protected !!