বইয়ের নাম: সাহিত্য প্রসঙ্গে,
লেখক: ভি. আই. লেনিন;
ভূমিকা সম্পাদনা ও টিকা: অনুপ সাদি;
ধরণ- সম্পাদিত প্রবন্ধ;
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম: টাঙ্গন।
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২০;
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১০৪;
মূল্য: ২৮০ টাকা মাত্র।
ভি. আই. লেনিন রচিত সাহিত্য প্রসঙ্গে গ্রন্থটি লেখক অনুপ সাদি নতুন করে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন। প্রবন্ধের এই বইটিতে সংকলিত হয়েছে লেনিনের মোট সতেরোটি প্রবন্ধ। যে প্রবন্ধগুলোর প্রত্যেকটিতে প্রস্ফুটিত হয়েছে সাহিত্য সৃষ্টির মূল লক্ষ ও উদ্দেশ্য। সেই সাথে রয়েছে মানব সভ্যতার সাথে সাহিত্যের নিগুঢ় সম্পর্কের বর্ণনা। সাহিত্যের সাথে রাজনীতি ও অর্থনীতির কী সম্পর্ক এবং বুর্জোয়া সাহিত্য ও প্রলেতারিয়েত শ্রেণির সাহিত্যের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্বের বিশদ ব্যাখ্যা। সাহিত্যের উদ্দেশ্য কি ও কেনো তার আলোচনা।
সাহিত্য প্রসঙ্গে বইটির মূল লেখক ভি. আই. লেনিন। যার পূর্ণ নাম ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন। যিনি বিংশ শতাব্দীর আলোচিত দর্শন বিপ্লবী মতাদর্শ মার্কসবাদের প্রভাবশালী উত্তরসূরি, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্মাতা ও বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা। তিনি রাষ্ট্র, সমাজ দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাহিত্য সম্পর্কে অসংখ্য বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে ভাবনা ও সাহিত্য সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রবন্ধগুলো একত্রে বাংলাভাষী মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্যে সর্বপ্রথম প্রগতি প্রকাশন ১৯৭৬ সালে মস্কো থেকে সাহিত্য প্রসঙ্গে শিরোনামে প্রকাশ করে। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর প্রগতি প্রকাশন বন্ধ হয়ে যায় এবং সেই সাথে থেমে যায় এধরণের গ্রন্থের প্রচার।
তাই দীর্ঘ ২৮ বছর পর মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও প্রাবন্ধিক অনুপ সাদির নিজ উদ্যোগে সম্পাদিত ১০৪ পৃষ্ঠার সাহিত্য প্রসঙ্গে বইটি নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যে নতুন প্রজন্মের লেখকদের জন্য একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। বইয়ের সূচিপত্রের পরের পৃষ্ঠায় পূর্বকথা শিরোনাম অনুপ সাদি লিখেছেন, “বাংলা সাহিত্যে সাহিত্যিক, লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী ও মনীষীদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাতপদ উপাদানগুলো মুছে ফেলতে এই বই সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে দৃঢ়ভাবে বোঝা যায়। বাংলা সাহিত্যের প্রগতিশীল গতিপথে এই বই আরও গতি সঞ্চার করবে আমার বিশ্বাস।” আমিও লেখকের সাথে সহমত পোষণ করি এবং নির্দ্বিধায় বলতে পারি সাহিত্যের প্রগতির ধারায় এই বই অমোচনীয় চিহ্ন রাখবে।
সাহিত্য বলতে সাধারণ অর্থে আমরা কোনো লিখিত বিষয়বস্তুকে বুঝে থাকি। যেখানে একজন লেখক তার ইন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক বা মহাজাগতিক চিন্তা চেতনা, অনুভূতি, সৌন্দর্য অবলোকনের মধ্যদিয়ে প্রাপ্ত অনুভূতিকে অন্য সাধারণ লেখনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে পাঠক মহলের কাছে উপস্থাপন করেন। তার এই উত্থাপিত বিষয়বস্তুকে বলি সাহিত্য। ধরণ অনুযায়ী সাহিত্যকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় যেমন, কল্পকাহিনি বা বাস্তব কাহিনি। আবার গদ্য এবং পদ্য এই দুই ভাগেও বলা যায়। একজন শিল্পীর বা লেখকের কোনো কর্মকে ততক্ষণ পর্যন্ত সাহিত্য বলা যায় না যতক্ষণ না তা মানব মনে দাগ কেটে যায়। সেটা হতে পারে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা দ্বারা সৃষ্ট কাহিনি, কোনো রুপকথা কিংবা কোনো রোমান্টিক প্রেমের উপাখ্যান।
সাহিত্যের সাথে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির একটা নিগুঢ় সম্পর্ক রয়েছে। তাই সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক যতীন সরকার প্রায়শই সভা কিংবা সেমিনারে বলে থাকেন, “রাজনীতি একটি পথের নাম, সংস্কৃতি তার ধারক বাহক।” যতীন সরকারের এই কথার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, সংস্কৃতি যেমন রাজনীতির ধারক বাহক তেমনি উন্নত সাহিত্য উন্নত সংস্কৃতির পথ প্রদর্শক। মানব সভ্যতাকে ঘিরে এখন পর্যন্ত যতো মিথলজি বা লোককথা প্রচলিত রয়েছে সবকিছুই সাহিত্যের অন্তর্গত। প্রাচীন গ্রিক পৌরাণিক লোককথা থেকে শুরু করে ভারতবর্ষে বাল্মীকি রচিত রামায়ণ, মহাভারত, দৌলত উজির বাহারাম খাঁ’র লাইলী মজনু, চর্যাপদে লিপিবদ্ধ পদ সবকিছুই সাহিত্যের অন্তর্গত। আর এসবের মাঝে রয়েছে সে সময়কার মানুষের জীবনাচরণে প্রতিচ্ছবি। তাই সাহিত্যকে বাদ দিয়ে কেউ যদি মানব সভ্যতার ইতিহাস লিখতে চায় তবে তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আরেক বরপুত্র বাংলা গদ্যরীতির প্রবর্তক প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোট গল্পকার প্রমথ চৌধুরী সাহিত্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, “সাহিত্য জাতির দর্পণ স্বরূপ।” দর্পণের সামনে দাঁড়ালে যেমন নিজের পূর্ণ অবয়ব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটে ওঠে তেমনি একটি জাতির রচিত সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তার সময়কার মানুষের সমাজ জীবনের ভাবনা, রুচিবোধ, রাজনীতি ও অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র ফুটে ওঠে। তাই সাহিত্য মানব সভ্যতার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এজন্য সাহিত্যকে হতে হবে গণমানুষের সাহিত্য। যদি সংস্কৃতিবান লোকেরা বুর্জোয়াদের প্রভাব ও রাজনীতির সামনে নতি স্বীকার করে তবে বুঝতে হবে তারা নিজের সমস্ত সংস্কৃতি পেয়েছে বুর্জোয়া পরিস্থিতির কাছ থেকে এবং তার মাধ্যমে। আর তাদের সৃষ্ট সাহিত্যের দ্বারা সমগ্রজাতির জীবনের প্রতিফলন ঘটানো অসম্ভব।
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যতোগুলো সমাজ বিবর্তন হয়েছে, যতো বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে তার সমস্তকিছুর মধ্যে সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে। যদিও মানুষ সাহিত্য সম্পর্কিত উৎসাহ ও সাহিত্য মূল্যায়নের ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না তবুও সে চাইলে অনুশীলনের মাধ্যমে সাহিত্যের বিচার-ক্ষমতা আর্জন করতে পারে। একজন পাঠকের কাছে সাহিত্য কেবল আনন্দ আস্বাদনের উপকরণ নয়। পাঠকের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক আত্মিক ও মানবিক। সাহিত্যের কদর দিতে গিয়ে মার্কস বলেন, “উৎপাদনী-শক্তিগুলির (productive force) ভিত্তিতে উৎপাদন-সম্পর্কগুলি (production relation) গড়ে ওঠে। গোড়ায় এই সম্পর্কগুলি প্রভু-ক্রীতদাস, জমিদার-ভূমিদাস, বুর্জোয়া-শ্রমিকের চেহারায় আবির্ভূত হয় উৎপাদনী-শক্তিকে আরও এগিয়ে দিতে, সমাজ এবং ইতিহাসকে আরও এগিয়ে দিতে। কিন্তু কালক্রমে শ্রেণিবিন্যাসই হয়ে দাঁড়ায় উৎপাদন তথা সমাজের অগ্রগতির পথে বাধা স্বরূপ। তখন উৎপাদনী-শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ ঘটে এবং অবশেষে দেখা দেয় নতুন শ্রেণিবিন্যাসের। ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে উৎপাদনী-শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া তারই প্রতিফলন হয় সেই যুগের সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, আইনে, দর্শনে, ধর্মে, লোকাচারে, রাষ্ট্রে ও রাজনীতিতে।” মার্কসের বিশ্লেষণে মানবিক সত্তার সঙ্গে সৃজনশীল শ্রমের যে নিবিড় সম্পর্ক তা অনুধাবন করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মানুষের সৃজনীশক্তিকে মার্কস কী পরিমান কদর করতেন! মার্কস তাঁর অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপিতে আরও বলেন, “তুমি যদি সাহিত্য আস্বাদন করতে চাও, তাহলে তোমাকে শিল্পীসুলভ সংস্কৃতি নিয়ে গড়ে উঠতে হবে।” তাই মার্কসবাদী সাহিত্যতত্ত্ব সাহিত্য চর্চা, সাহিত্য বোঝা এবং সাহিত্যের সংস্কৃতি গড়ে তোলাকে অনুশীলন হিসেবে গণ্য করে।
যখন থেকে সাহিত্য রচনা শুরু হয়েছে, অর্থাৎ যে সময় কাল থেকে সাহিত্যের অস্তিত্ব অর্থাৎ ইতিহাসের খুঁজ পাওয়া গেছে সে-সময়কাল থেকে স্পষ্টতই সমাজে দুই শ্রেণির সাহিত্য সমভাবে অবস্থান করেছে। শ্রেণি-বিভক্ত সমাজে প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির জন্য আলাদা আলাদা সাহিত্য রচিত হয়েছে এবং বর্তমান সময়েও তাই হচ্ছে। বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শাসক শ্রেণিকে তুষ্ট করার জন্য বা নিজেদের খ্যাতির লোভে যে সাহিত্য রচিত হয় তা সাহিত্য নয়। পুঁজিবাদী সমাজে যেসব লেখক নিজেদের স্বাধীন ও মুক্তচিন্তক বলে দাবি করেন, যারা মনে করেন সাহিত্যিকদের প্রধান কাজ হচ্ছে একটি শ্রেণির মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য কাজ করা, তাদের তুষ্ট করা। তারা মুখোশধারী ছাড়া কিছুই না। তারা মূলত পুঁজিবাদের দাস। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের মেধাকে নিজের কায়েমি স্বার্থে ব্যবহার করছে। তারা যেমন নিজের সাথে প্রতারণা করছে তেমনি প্রতারণা করছে সাহিত্যের সাথে। তাই সাহিত্য প্রসঙ্গে বইয়ে লেনিন সাহিত্যিকদের উদ্দেশ্যে বলেন,
“সাহিত্য হতে হবে পার্টির সাহিত্য। বুর্জোয়া রীতির বিপরীতে, বুর্জোয়া অর্থকরী, ব্যবসাদারী সংবাদপত্রের বিপরীতে, বুর্জোয়া সাহিত্যিক পদান্বেষণ ও অহমিকা, ‘নবাবী নৈরাজ্য’ ও মুনাফা শিকারের বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক প্রলেতারিয়েতকে পেশ করতে হবে পার্টির সাহিত্য নীতি। বিকশিত করতে হবে তাকে এবং বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে।”
সাহিত্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী সাহিত্যিক ও প্রবন্ধিক হুমায়ুন আজাদ তাঁর বাংলাদেশের কবিতা ও প্রতগিবিরোধী ধারা প্রবন্ধে বলেন, “প্রগতিশীলতা হচ্ছে চেতনার বিবর্তন বা গতিশীলতা। যে কবিতা বুর্জোয়া আবেগ বিশ্বাস স্বপ্ন চিন্তার প্রকাশ, যে কবিতা ধর্মান্ধতামুক্ত, পশ্চাৎপদতাবিরোধী, গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের জন্যে কাতর, যে কবিতা কবিতা ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ ছাড়া আর কোনো স্বার্থান্বেষী নয়, সে কবিতাই প্রগতিশীল। যা-কিছু এর বিরোধী তাই প্রতগিবিরোধী।” প্রগতিরবিরোধী রাজনীতি ও সাহিত্য থেকে যে সাহিত্যতত্ত্ব জন্ম নেয়, তাকে কেবল প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যই বলা যায়। এরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শাসক শ্রেণির কায়েমি স্বার্থে নিজের মেধাকে ব্যবহার করে জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে সবসময় বদ্ধ পরিকর থাকে। তাই একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক সমাজ-রাষ্ট্র কায়েম করতে গেলে সেই সময়ের সাহিত্যিকদের এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। কৌম সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে অস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে সেই সমাজের কলম যোদ্ধাদের।
সাহিত্য প্রসঙ্গে গ্রন্থ সম্পর্কে একটি আলোচনা দেখুন
সমাজতত্ত্ববিদ, দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কসের সুযোগ্য উত্তরসূরী মহামতি লেনিন তাঁর সাহিত্য প্রসঙ্গে লিখিত প্রবন্ধের পাতায় পাতায় মার্কসের চিন্তাকে এক অনন্য রুপে উপস্থাপন করেছেন। শ্রেণির সংগ্রামের সাথে সাহিত্যের যে একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে তা ফুটিয়ে তুলেছেন প্রবন্ধের লাইনে লাইনে। তিনি সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রতি কতটা আন্তরিক ছিলেন সেটা তাঁর রাষ্ট্র ভাষার প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক প্রবন্ধ পড়লেই বুঝা যায়। যেখানে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল ও উদারপন্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন,
“তোমাদের সব কথাই সঠিক। তুর্গেনেভ, তলস্তয়, দব্রলিউভ এবং চের্নিশেভস্কির ভাষা মহান এবং শক্তিমান সেটা আমরা ভালো করেই জানি। আমরা চাই রাশিয়ায় অধিবাসী সমস্ত জাতির নিপীড়িত শ্রেণিগুলির মধ্যে যতখানি সম্ভব ঘনিষ্ঠ আদান-প্রদান এবং ভ্রাত্রোচিত ঐক্য স্থাপিত হোক কোনো প্রকার বৈষম্য ছাড়াই। তাই রাশিয়ায় কোনো আবশ্যিক রাষ্ট্রভাষা চলবে না। জনসাধারণের জন্য এমন বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করতে হবে যেখানে শিক্ষণ চলবে সমস্ত স্থানীয় ভাষায়, যে কোনো এক-জাতির সমস্ত বিশেষ অধিকার এবং সংখ্যালঘু জাতিগুলির সমস্ত রকমের অধিকার লঙ্ঘনকে বাতিল ঘোষণা করে সংবিধানে একটা বুনিয়াদি আইন ঢুকাতে হবে।”
বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনে যখন একে একে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন, তখন মূলধারার সাহিত্য চর্চার মধ্যদিয়ে বিজয়কে পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত করতে হলে পুঁজিবাদের মধ্যে যা-কিছু মূল্যবান তা সবই নিতে হবে, আত্তীকরণ করতে হবে সমস্ত বিদ্যা ও সংস্কৃতি। আর এই আত্তীকরণের ক্ষমতার কিভাবে অর্জন করা সম্ভব তা লেনিন খুব সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় তাঁর বইয়ে উপস্থাপন করেছেন। লেনিন মার্কসবাদী তত্ত্বকে বাস্তব ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে শুধু সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক শোষণ উৎপীড়নে বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেননি। তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি সকল ক্ষেত্রেই সমান অবদান রেখেন। যার জ্বলন্ত উদাহরণ তাঁর সাহিত্য প্রসঙ্গে বইটি।
সব সাহিত্য চিরকাল টিকে থাকেনি। টিকে থাকবেও না। কৃষক শ্রমিক তথা সমাজের অনগ্রসরমান খেটে খাওয়া মানুষের সেবায় নিয়োজিত সাহিত্য হচ্ছে প্রকৃত সাহিত্য। যেসব লেখকের সৃষ্টি তার সমকালকে অতিক্রম করে গিয়েছে তাদের সৃষ্টিকর্ম সাহিত্য বলে গণ্য হবে। তাইতো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শেকসপীয়র, হোমারের, লালন আপন কর্মে স্থান করে নিয়েছেন মহাকালে। আর অন্য সকল সাহিত্য হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য খুব আলোচিত হবে কিন্তু একটা সময় শেষে তা আবর্জনার স্তুপে স্থান পাবে। হারিয়ে যাবে মহাকালের অতল গহ্বরে। কিন্তু মূলধারার সাহিত্য বেঁচে থাকবে চিরকাল। আর সেজন্যই হয়তো লেখক অনুপ সাদি বলেছেন,
“সাহিত্য যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক কৃষকের কাজে না লাগে, তবে সেই সাহিত্য টিকবে না। সাহিত্যের প্রধান ধারা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক কৃষকের সেবায় নিয়োজিত সাহিত্য। অন্যান্য সব সাহিত্যই হচ্ছে সমাজের সেই আবর্জনা যা ধ্বংস হবার জন্য অপেক্ষা করছে।”
সুতরাং সাহিত্য মূল্যায়নের সময় সাহিত্য সৃষ্টির সমকালীন অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি-বিভক্ত সমাজে একজন লেখক নিজ মনের অজান্তেই তার শ্রেণি-চরিত্রকে লেখেনির মধ্যে প্রতিফলিত করেন এবং বিভিন্ন শ্রেণির প্রভাব তার মস্তিষ্কে গ্রহণ করেন। তাই যে সময়ে সাহিত্য লিপিবদ্ধ করা হবে সে সমাজের যে মূল বিরোধ, অসংখ্য ছোট-বড় ঘাত-প্রতিঘাত, টানাপোড়েন, সংঘর্ষ, তার সব কিছুরই প্রতিফলন ঘটতে বাধ্য। সাহিত্য সৃষ্টির এই জটিল প্রক্রিয়া এবং সাহিত্যের বিচার কোনো অবস্থাতেই মার্কসবাদী তত্ত্বকে অস্বীকার করতে পারে না। লেখক অনুপ সাদি তাঁর বইয়ের ভূমিকায় মার্কসবাদী তত্ত্বের উল্লেখ করেছেন। যেখানে মার্কস বলছেন,
“সাহিত্যিকের মস্তিষ্ক বা হৃদয় এমন কোনো নির্মল আয়না নয়, যেখানে এক বিশেষ কালের অর্থনীতি এবং কতকগুলি চরিত্রের আবেগ প্রকাশিত হওয়ার জন্যে উন্মুখ। সাহিত্যিক ইতিহাসের এক বিশেষ লগ্নের মানুষ এবং তার নিকটবর্তী পাঠকেরা ঐ একই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটের মানুষ।”
আরো পড়ুন
- সাহিত্য প্রসঙ্গে গ্রন্থ সম্পর্কে একটি আলোচনা
- নকশাল সাহিত্য বা নকশাল আন্দোলনের সাহিত্য অর্ধশতাধিক গ্রন্থের সমাহার
- হৃতসর্বস্ব প্রজন্ম ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের সামাজিক প্রজন্মের সমাহার
- জাদু বাস্তববাদ হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের কথাসাহিত্যের একটি শৈলী ও সাহিত্য ধারা
- সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ তুলে ধরে সাম্যবাদ অভিমুখী পার্টির প্রতি শিল্পীর কর্তব্য
- সাহিত্যিক বাস্তববাদ সত্যদৃষ্টি দিয়ে বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে
- চেতনা প্রবাহ হচ্ছে সাহিত্য সমালোচনায় একটি বর্ণনামূলক উপায় বা পদ্ধতি
- রোমান্টিক কবিতা হচ্ছে রোমান্টিকতাবাদী সাহিত্য আন্দোলন থেকে উদ্ভূত কবিতা
- রোমান্টিকতাবাদ শৈল্পিক, সাহিত্যিক, সাংগীতিক এবং মনীষাগত আন্দোলন
সাহিত্য প্রসঙ্গে বইটি অধ্যয়নের ফলে একজন প্রগতিশীল লেখক নিজেকে এবং সাহিত্যকে নতুন করে জানার ও বুঝার সুযোগ পাবেন। তার মধ্যে জেগে থাকা পুরনো ও পশ্চাৎপদ চিন্তাধারা ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দিতে বাধ্য হবেন। নতুন করে সাহিত্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে মহৌষধের মতো কাজ করবে তার মধ্যে। একবার পড়ে হয়তো তিনি পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হবেন না। হয়তো তার একটু সময় লাগবে, তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় সাহিত্য সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেবে এই বই। গণমানুষের সাহিত্য রচনা তার মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে। শুধু এপার বাংলা কিংবা ওপার বাংলা নয়, পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যপ্রেমী কিংবা সাহিত্যকদের কাছে এই বই একটা মহৌষধ।
প্রগতি প্রকাশনের প্রকাশিত অনুবাদকে আবারও পুনর্মুদ্রণ করতে গিয়ে লেখক বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদে ব্যবহৃত ‘সামন্ততন্ত্র’, ‘পুঁজিতন্ত্র’, ‘ধ্যান’, ‘স্বপ্নরাজ্য’ ইত্যাদি তৎকালে প্রচলিত শব্দগুলোকে ইদানিংকালে প্রচলিত শব্দ দ্বারা পুনঃস্থাপন করেছেন। যেমন, ‘সামন্তবাদ’, ‘পুঁজিবাদ’, ‘দৃষ্টিভঙ্গি’, ‘কল্পলোক’ ইত্যাদি। এছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ যেটি নিয়েছেন সেটি হচ্ছে প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদে টিকা ও নামে সূচি ছিলো বইয়ের পেছনের অংশে। কিন্তু বর্তমান অনুবাদে লেখক প্রতিটি প্রবন্ধের শেষ টিকা ও নামের সূচি এবং দু’একটি ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র প্রদান করেছে। যাতেকরে একজন পাঠক সহজে প্রবন্ধটি পাঠ করার সাথে সাথে প্রয়োজন হলে সহজেই টিকা ও তথ্যসূত্র পেয়ে যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায় লেখক অনুপ সাদি সম্পাদিত সাহিত্য প্রসঙ্গে লেনিন বইটি বাংলা সাহিত্যের প্রগতিশীল আন্দোলনকে আরও বেশি গতিশীল করে তুলবে। লেনিনের সাহিত্যে সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলো নতুন প্রজন্মের মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের মনোজগকে নতুনভাবে আলোড়িত করবে। সাহিত্যের এই অন্ধকার সময়কে উপেক্ষা করে নতুন আলোর সন্ধানের দিশারি হবে।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।