লোকসংস্কৃতি (ইংরেজি: Folklore) হচ্ছে মানুষের একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দ্বারা ভাগ করা সংস্কৃতির অভিব্যক্তিপূর্ণ অঙ্গ; যা সেই সংস্কৃতি, উপসংস্কৃতি বা গোষ্ঠীর সাধারণ ঐতিহ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে। লোক সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে মৌখিক ঐতিহ্য যেমন কাহিনি, প্রবাদ এবং কৌতুক। লোকসংস্কৃতি কোনো গোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত দালানের শৈলী থেকে হস্তনির্মিত খেলনা পর্যন্ত সাধারণ বৈষয়িক সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে।
লোক শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Folk. ঐতিহাসিকভাবেই লোকসংস্কৃতি সম্বন্ধে আগ্রহ ও চর্চার সূত্রপাত ঘটে ইউরোপ মহাদেশে। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইউরোপে লোক বলতে মনে করা হত মূলত গ্রামীণ নিরক্ষর কৃষকদের, যাদের সমাজব্যবস্থার নিয়মকানুন, রীতিনীতি, প্রথা, শিল্পকলা প্রভৃতি সমস্ত কিছুই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়ে এসেছে মৌখিক উত্তরাধিকারের মাধ্যমে, অর্থাৎ যাদের জীবনধারায় পুঁজিবাদী আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। সামাজিক স্তরবিন্যাসের মাপকাঠিতে এই লোকের সামাজিক অবস্থান ছিল একদিকে আদিম সমাজব্যবস্থার অ-সভ্য মানুষের ওপরে। পুঁজিবাদ ও শিল্পায়নের প্রভাব সঞ্জাত সভ্য সমাজে এরা ছিল অ-সভ্য’ ও ‘অ-সংস্কৃত’। নিজস্ব এলিট সংস্কৃতির উৎস অনুসন্ধানী ইউরোপীয় গবেষকরা তাদের আগ্রহকে কেন্দ্রীভূত করেছিলেন লোক-এর ওপর, যদিও তাদের যথেষ্ট কুণ্ঠা ছিল লোক-এর স্বাধীন অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিতে। তাঁদের আশঙ্কা ছিল যে শিল্পায়নের দ্রুত প্রসারের সঙ্গে গ্রাম ও শহরের পার্থক্য ক্ষীয়মাণ হতে হতে বিলুপ্ত হবে গ্রামিণ লোকসমাজ। অতএব এর যথাযথ সংরক্ষণ প্রয়োজন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এই সংক্রান্ত চিন্তাভাবনায় পরিবর্তনের সূচনা হয় এবং বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন লোকসংস্কৃতিবিদ Alan Dundes-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে লোক-এর বিলুপ্তি ঘটেনি, বরং সজীব রয়েছে লোকসংস্কৃতি। তার ধারণায় লোক বলতে যেকোনো গোষ্ঠীর মানুষকে বোঝায়, যাদের মধ্যে অন্তত একটা বিষয়ে ঐক্যচেতনা রয়েছে, যা পেশা, ভাষা কিংবা ধর্মের মতো যে কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো যে গোষ্ঠীভুক্ত সমস্ত সদস্য পরস্পর পরিচিত না হলেও তারা সকলেই এক পরম্পরার (Tradition) অধীন এবং এই পরম্পরাই নির্ধারণ করে তাঁদের আত্মিক অবস্থান। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রাম কিংবা শহর সর্বত্রই মেলে লোকের সন্ধান—কৃষক, নাপিত, কুমোর, জেলে, শ্রমিক, মালিক, বুদ্ধিজীবী কেরানি ইত্যাদি সকলেরই পরিচয় লোক। তাই কেবলমাত্র অতীতের সামন্তবাদী কৃষি সমাজের মানুষই নয়, বর্তমানের শিল্পোন্নত সমাজের মানুষও লোক পদবাচ্য।
সংস্কৃতি-র সংজ্ঞা নিরূপণের ক্ষেত্রেও নানা সমস্যা রয়েছে। তবে আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে E. B. Tylor প্রদত্ত সংজ্ঞার উল্লেখ করা যায়—’that complex whole which includes knowledge, belief, art, morals, law, custom, any other capabilities and habits acquired by man as a member of society.’। আবার অন্যভাবেও বলা হয়েছে যে সংস্কৃতি হলো পরিবেশের মানব-নির্মিত অংশ। মার্কসবাদী অভিধায় তা হলো সমাজে অর্থনীতিক ভিত্তির উপরে নির্মিত উপরিকাঠামো। এই উপরিকাঠামোর প্রেরণাতেই মানুষ তরবারির শুধুমাত্র তীক্ষ্ণতাতেই সন্তুষ্ট থাকে না, তাকে করে তোলে মণিরত্নখচিত। সমাজ ও সংস্কৃতি পরস্পর এতই অন্তর্ভেদী যে এদের কাউকেই বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। আর্থ-সামাজিক কাঠামো নির্মাণ করে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, যা আবার প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে সমাজের জীবনধারাকে।
লোক ও সংস্কৃতি শব্দ দুটিকে যুক্ত করলে পাওয়া যায় লোকসংস্কৃতি শব্দসমষ্টি, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Folklore এবং শব্দটি ১৮৪৬ সালে ইংরেজিতে প্রথম ব্যবহার করেন William John Toms। ইউরোপে লোকসংস্কৃতি সংক্রান্ত আগ্রহের সূচনাকাল ষোড়শ শতক হলেও আধুনিক চর্চা শুরু হয় জার্মানিতে Grimm ভ্রাতৃদ্বয় কর্তৃক লোককথা সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে এবং তা প্রকাশিত হয় ১৮১২ সালে। একদিকে লোকসংস্কৃতি লোকসমাজের সামগ্রিক পরিচায়ক এবং অন্যদিকে তা অধ্যয়নযোগ্য শাস্ত্র। বাংলায় Folklore শব্দটির অনুবাদে লোককথাও চালু রয়েছে।
প্রথম অর্থে, Dan Ben-Amos-এর অভিব্যক্তি অনুযায়ী ‘Folklore is artistic communication in groups’ অর্থাৎ লোকসমাজের অভিজ্ঞতা, সৃজনশীল কল্পনা, রীতিনীতি, অতীত ও বর্তমানের পরম্পরার এক সুষমামণ্ডিত নান্দনিক বার্তা-বিনিময় ঘটে লোকসংস্কৃতির মধ্যে কুমোরের চাক যেমন কারিগরি জ্ঞানের নিদর্শন, তেমন এতেই কুশলী হাতের স্পর্শে তৈরি হয় শিল্পগুণসম্পন্ন মৃৎপাত্র। লোকউৎসব, ব্রত, পাঁচালি, কথকতা, সংগীত, শিল্প প্রভৃতি লোকসংস্কৃতির সমস্ত উপাদানই সমাজ-সম্পৃক্ত এবং এদের সংশ্লিষ্ট আচার-আচরণসমূহ কোন নির্দিষ্ট লোকসমাজের পরম্পরা অর্জিত জ্ঞানভাণ্ডারের পরিচয় বহন করে। জাতিগত ও আঞ্চলিক পার্থক্য প্রতিটি লোকসমাজের সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, বেশভূষা, খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরণ, এককথায়, সমগ্র জীবনধারাকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল করে তোলে। লক্ষণীয় যে একই দেশের একাধিক লোকসংস্কৃতির মধ্যে একটা সামগ্রিক ঐক্যচেতনার স্থান থাকলেও লৌকিক বা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য প্রত্যেকের অনন্যতার পরিচায়ক। তাই লোকসংস্কৃতির বিচার-বিশ্লেষণ করতে হলে স্থান-কালের প্রেক্ষিতেই তা করতে হয়। মার্ক্সীয় চিন্তাবিদদের মতে, লোকসংস্কৃতি শ্রমজীবী মানুষের সৃষ্টি ও তাঁদের সংগ্রামের হাতিয়ার।
লোকসংস্কৃতি কখনই স্থবির নয়। সমাজজীবনের জঙ্গমত্বই তার পরিবর্তনের সূচক। ফেলে-আসা সামন্ততন্ত্রী সমাজের প্রতি আবেগজনিত স্মৃতিমেদুরতার জন্যই গবেষক ও অনুরাগী মানুষ অতীত লোকসংস্কৃতিকে অবিকৃতভাবে ধরে রাখতে চান। সমাজ পরিবর্তনের অমোঘ গতির মুখে লোকসংস্কৃতিকে লক্ষ্মণরেখার গণ্ডিতে ধরে রাখা কোনো দেশেই সম্ভব হয়নি। লোক যেহেতু একটা প্রবহমান ধারা, লোকসংস্কৃতিও তাই বিলুপ্ত হতে পারে না, তার রূপান্তর ঘটে।
লোকসংস্কৃতির সঙ্গে প্রয়োগ শিল্প (Performing art) ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে অতি । লোকসংস্কৃতির অবস্তুনির্ভর উপাদানসমূহ, যেমন লোককথা, ছড়া, প্রবাদ, কথকতা, পাঁচালি প্রভৃতি সমস্তই রূপ লাভ করে অভিকরণ প্রক্রিয়ায় বা প্রয়োগশিল্পের মাধ্যমে জারিত হয়ে। এমনকি লোকশিল্প ও কারুকলার মতো বস্তুনির্ভর উপাদানও মূর্ত হয়ে ওঠে পরম্পরালব্ধ কৃৎকৌশলের মাধ্যমে, কিংবা নির্দিষ্ট আচার-আচরণের ছন্দোবদ্ধ পুনরাবৃত্তি সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলে প্রথা-ব্রত-উৎসব উদ্যাপনকে। লোকসংস্কৃতির গোষ্ঠীগত পরিচয়ের মধ্যেও ব্যক্তিবিশেষের নৈপুণ্য ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে অভিকরণের শিল্পকর্ম।
অধ্যয়নের বিষয়বস্তুরূপে লোকসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে একাধিক পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে, যেমন, তুলনামূলক, জাতীয়তাবাদী, নৃতাত্ত্বিক, মনঃসমীক্ষণিক, রূপতাত্ত্বিক, টাইপ মোটিফ ইনডেক্স। এছাড়াও যা কাজে লাগে তা হল সমাজতত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞান, চিহ্নবিজ্ঞান, শব্দার্থবিজ্ঞান, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা। কোনো বিশেষ পদ্ধতি বা বিশেষ সহায়ক শাস্ত্র এক্ষেত্রে একক ভূমিকা পালন করতে পারে না, কারণ তাতে অসম্পূর্ণতার আশঙ্কা থেকে যায়। বহুমাত্রিক লোকজীবনের প্রতিফলন ঘটে লোকসংস্কৃতিতে। তাই লোকসংস্কৃতি চর্চাকে আন্তর্বিদ্যাগত (Interdisciplinary) দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন বিজ্ঞানরূপে গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে।
ব্যবহৃত আলোকচিত্র: এই নিবন্ধে ব্যবহৃত চিত্রটি ১৩০০-১৩২৫ সালের মধ্যে আঁকা জনপ্রিয় লোককথাকে ভিত্তি করে অংকিত। চিত্রে শেয়াল মুরগিছানা ও হাঁসের সামনে ভাষণ দিচ্ছে যা দাস ও সামন্তীয় সমাজের ক্ষমতাকেন্দ্রিক কাঠামোকে তুলে ধরছে।[১]
তথ্যসূত্র:
১. বিকাশ চক্রবর্তী, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৭৭-৫৭৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।