নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ গ্রন্থের আলোচনা

অনাবিলা অনা
অনাবিলা অনা, লেখক ও আলোচক

বইয়ের নাম – নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ
লেখক: অনুপ সাদি
ধরন- প্রবন্ধ
প্রকাশনা- শোভাপ্রকাশ
প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারী ২০১৫
প্রচ্ছদ – আইয়ুব আল আমিনের স্কেচ অবলম্বনে
পৃষ্ঠা – ১২৮
মূল্য- ২০০ টাকা মাত্র

নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ হচ্ছে অনুপ সাদি রচিত একটি গ্রন্থ।  গ্রন্থটি রচিত হয়েছে হুমায়ুন আজাদ নামক আরেক পরিচিত লেখককে নিয়ে; যিনি বাংলাদেশের প্রভাবশালী লেখকদের মধ্যে অন্যতম স্পষ্টভাষী ও প্রাজ্ঞ ছিলেন। হুমায়ুন আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন এবং একই সাথে একজন বড় মাপের সৃষ্টিশীল মানুষও ছিলেন বটে।

হুমায়ুন আজাদ সরাসরি কথা বলতেন। আমাদের দেশে সত্য বলার মতো সাহসী বুদ্ধিজীবী সংখ্যালঘু। যারাই সত্য বলেছেন তারাই পদে পদে সম্মুখীন হয়েছেন নানান বাধা বিপত্তির। কাজেই বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীরা অযথা সত্য প্রকাশ করে ক্ষমতাশালী বা উগ্রবাদীদের চক্ষুশূল হতে চান না। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ ছিলেন একেবারেই ভিন্ন। তিনি শাসক, ঘৃণ্য সমাজ অথবা ধর্মান্ধদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সত্যটি বলেই গেছেন প্রতিনিয়ত। তিনি জানতেন সত্য কথাটি বললে বাধা আসবে। বাধা এসেছেও। উগ্রবাদীরা হামলাও করেছে হুমায়ুন আজাদের উপর। কিন্তু তিনি টলে পড়েননি। তিনি স্রোতের প্রতিকূলে সত্য কথাটি বলে গেছেন।

সেই সত্য ভাষ্যের এক অনন্য পথিক, বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী লেখক হুমায়ুন আজাদ; যাকে নিয়ে, অথবা যার জীবনের ভিন্ন কিছু দিক লেখক অনুপ সাদি তাঁর লেখা নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। অনুপ সাদি, যিনি বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর থানার দামোল গ্রামে ১৯৭৭ সালের ১৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন।

অনুপ সাদির একটি সাক্ষাতকার দেখুন

লেখক অনুপ সাদি রচিত নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধটি লিখেছেনই মূলত বাংলা ভাষার এক নিরন্তর সংগ্রামী অভিযাত্রী তথা হুমায়ুন আজাদকে কেন্দ্র করে। এই গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে হুমায়ুন আজাদের জীবনের ভিন্ন কিছু দিক যা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। বইটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাঁর জীবনবোধ, কর্মপদ্ধতি ও চিন্তাধারা; এসব কিছুর আলোচনা বইটির শুরুতেই ‘হুমায়ুন আজাদ আমাদের কালের কর্মমুখর নায়ক’ প্রবন্ধে করা হয়েছে। সত্যি হুমায়ুন আজাদ আমাদের কালের কর্মমুখর নায়ক ছিলেন। যার চিন্তাভাবনা, চলাফেরা, সকল কিছুই এ যুগের তরুণদের প্রভাবিত করেছিলো। তিনি যে শুধুই লিখে গেছেন তাই নয়, হুমায়ুন আজাদ এ যুগের তরুণদের দেখিয়ে বা শিখিয়ে গেছেন কি লিখতে হবে অথবা কীভাবে লিখতে হবে। তেমনি শিখিয়ে গেছেন কীভাবে জীবনকে গড়তে হবে।

হুমায়ুন আজাদের ভাবনাতে ছিলো কীভাবে প্রকৃত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা যায়, কিভাবে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ত্বরান্বিত করা যায়। হুমায়ুন আজাদ ধর্মান্ধতা বা কুসংস্কার বা প্রথার বিরুদ্ধে কলম হাতে নিয়েছিলেন। যেমনটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখরা করেছিলেন। এতে করে অনেক বাধার সম্মুখীনও হয়েছেন সেসব মুক্তির পথের পথিকরা। হুমায়ুন আজাদ মনেপ্রাণে ধারণ করেছিলেন যে নৈতিক মনোবল থাকলে মানুষ সত্যকে সত্য বলে ঘোষণা দিতে পারে, যা হুমায়ুন আজাদকে সাহসীকতার বলয়ে পৌঁছে দিয়েছে। হুমায়ুন আজাদ চাইলেই পারতেন অন্যান্য সুবিধাবাদী বা ভন্ড আঁতেল লেখকদের মতো নিজেকে মিথ্যার সাথে সমর্পণ করতে কিন্তু তিনি তা না করে বরং সর্বদা সত্যের পিছুই ছুটেছেন।

হুমায়ুন আজাদ সর্বদাই কল্পনা করতেন আগামীর সমাজ বা রাষ্ট্র হয় এগিয়ে যাবে নয়তো পিছিয়ে যাবে; যা বর্তমান সমাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো। অনুপ সাদি রচিত নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ বইটিতে হুমায়ুন আজাদ রচিত গ্রন্থাদি থেকে তাঁর লেখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে লিখেছেন বা বিভিন্ন বই প্রকাশ করেছেন এমন লেখকের জুড়ি মেলা ভার। তবে হুমায়ুন আজাদের মেয়ে মৌলি আজাদসহ কিছু লেখক আছেন যারা হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে লিখেছেন। তাদের মধ্যে লেখক অনুপ সাদির প্রকাশিত বই নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ বইটি অন্যতম।

হুমায়ুন আজাদ এতোটাই উচ্চ পর্যায়ের লেখক বা জ্ঞানী ছিলেন যে উনাকে নিয়ে চর্চা বা ভালোভাবে গবেষণা না করে বই লিখাটা মূর্খতার পরিচয়ই দেবে। কিন্তু নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধটি পড়লেই বুঝা যায় যে লেখক অনুপ সাদি হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে কতটা নিখুঁতভাবে চর্চা করেছেন। প্রয়োজনে উনার সান্নিধ্যে গিয়ে হুমায়ুন আজাদের সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। ২০০০ সালের হুমায়ুন আজাদের তৎকালীন অফিসকক্ষে নেয়া সাক্ষাৎকারটি লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে এই বইয়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে হুমায়ুন আজাদের এই সাক্ষাৎকারটি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করতে লেখক অনুপ সাদিকে অনেক বেগ পেতে হয়। শেষে ভোরের ডাক নামে একটি পত্রিকায় এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। ততদিনে হুমায়ুন আজাদ আর জীবিত ছিলেন না। যা লেখক অনুপ সাদি সাক্ষাতকারটির তথ্যসূত্র ও টীকাতে উল্লেখ করে দিয়েছেন।

আগেই বলা হয়েছে যে হুমায়ুন আজাদ স্পষ্টভাষী। উনি হাসির ছলে অথবা কৌতুক পরিহাসের ছলে অনেককে আক্রমণাত্মক কথা বলতেন। উনার কথাবার্তায় বা মন্তব্যে অনেকে কষ্ট পেয়েছেন, আবার অনেকে আনন্দ পেয়েছেন, আবার অনেকে ভুলও বুঝেছেন। আর সেই কথাগুলোই অনেকসময় হয়ে উঠেছে রম্য গল্প বা কৌতুক। এসবের মধ্যে আবার খুঁজে পাওয়া যাবে হুমায়ুন আজাদের জীবনদর্শন ও চিন্তাধারা। আর সেইসব গল্পের‍ই কিছু কিছুর সংগ্রহ লেখক অনুপ সাদি গ্রন্থটিতে উল্লেখ করেছেন। তবে হুমায়ুন আজাদের রম্য গল্প বা কৌতুক অথবা বিভিন্ন মন্তব্যগুলির মধ্যে উনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বিভিন্ন কথাই উঠে এসেছে।

নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ বইটির উপস্থাপনও সুন্দর। হুমায়ুন আজাদকে আমরা যতটুকু জানি বা জানতে পেরেছি তার পরিধিটা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে যদি লেখক অনুপ সাদির রচিত এই বইটি অধ্যয়ন করা হয়। হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে বিস্তর খুঁটিনাটি বিষয় সুন্দর ও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই গ্রন্থটিতে। শুধু তাই নয় বইটির শেষের দিকে তুলে ধরা হয়েছে হুমায়ুন আজাদের লেখা সকল গ্রন্থের তালিকা এবং জীবনপঞ্জি। গ্রন্থটি পড়ে যে পাঠকসমাজ হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে এক অজানার সন্ধান পাবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

আরো পড়ুন

Leave a Comment

error: Content is protected !!