অভিবাসন-এর মাধ্যমে মানিক সমাজের অর্থনীতিকে তুলে ধরেছেন

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (মে ১৯, ১৯০৮ – ডিসেম্বর ৩, ১৯৫৬) তাঁর কথাসাহিত্যে পূর্ব বাংলার নদীনালা, খালবিল, প্রকৃতির মধ্যেই বেঁচে থাকা সাধারণ মানুষের কথা, জীবন ও পারিপার্শ্বিক ছবিগুলো নিখুঁতভাবে তুলে ধরতে গিয়ে তাদের অভিবাসন ও স্থানান্তরকেও তুলে ধরেছেন। লেখক জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে একত্রিত করেছেন নিজের সাহিত্যে যা ধারণাতীতভাবে অতিরিক্ত রকম স্বীকারোক্তিমূলক’ ও ‘আত্মজৈবনিক’ [১]।

তাঁর উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো বহুভাবে সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন ও অসঙ্গতির শিকার হন। যন্ত্রণাদগ্ধ চরিত্রগুলো নিজেদের অবস্থার উন্নতির জন্য ছুটে চলে গ্রাম থেকে নগরে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। মানুষের এই অভিবাসন যে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আনতে পারে সেটাই লেখক দেখিয়েছেন তাঁর উপন্যাসে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের কর্মমুখর জীবনের ছবি তুলে ধরার সাথে সাথে তাদের আদিম অন্ধকার জীবনের অলিগলিকে খুঁজে ফিরেছেন। তিনি মানুষের জীবন ও সমস্যাকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, তার সমাধানের পথ বাতলে দিতে সচেষ্ট থেকেছেন। বাস্তবের নর-নারীর প্রেম ও কামের বিভিন্ন দিক তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর লেখায় আদিম জীবনের বিবরণ হয়েছিল কিছুটা বেপরোয়া প্রকৃতির।

মানবজীবনের সংকটকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য রোমান্টিকতা, আবেগ ও ভাববাদকে পরিত্যাগ করে তিনি বস্তুবাদ, বিজ্ঞান ও মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে প্রকাশ করেছেন। মানিক কথাসাহিত্যে অভিবাসন দেখাতে চেয়েছেন দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করতে গিয়ে মানুষ পরাজিত হয়, কিন্তু তাই বলে সংগ্রাম থেমে থাকে না।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৫ সাল থেকেই তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু করেন। সাহিত্য জগতে প্রবেশের শুরুটা ছিলো ফ্রয়েডীয় মনোবিকার তত্ত্বের ভেতর দিয়ে। এজন্য সাহিত্যিক মহলে খুব জনপ্রিয়তা পান। পরবর্তীকালে তাঁর সমাজচেতনা তাঁকে ‘ক্রমশ তীব্রভাবে রাজনীতি সচেতন করে’[২] তুলেছিল।

এছাড়াও তাঁর লেখনির বলিষ্ঠতা আর রক্তের উষ্ণ স্রোত টের পাওয়া যায় তাঁর গল্প উপন্যাসের চরিত্রসমূহের পেশা, কাজকর্ম ও বর্ণনায়। লেখকের সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশটা ছিলো অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫) গল্পগ্রন্থ দিয়ে, এরপরে চমক দিতে থাকলেন দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), জননী (১৯৩৫), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), অহিংসা (১৯৪৮), চতুষ্কোণ (১৯৪৩) প্রভৃতি গ্রন্থের মাধ্যমে।

মানিক কথাসাহিত্যে অভিবাসন কেন্দ্রিক উপন্যাস পদ্মানদীর মাঝিতে জেলে পরিবারগুলোতে অভাব-অভিযোগ, শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনার মাঝেই জন্ম নেয় নতুন প্রজন্ম। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কুবের হচ্ছে তখনকার শোষিত মানুষের প্রতিনিধি। সে মহাজনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করতে না পারায় অতি কষ্টে অন্যায়গুলোকে মেনে নেয়। সংসারে প্রতিবন্ধী বউ, পাড়া প্রতিবেশীর অভাব, মহাজনের অত্যাচার ইত্যাদি মিলে জীবনের রিক্ত অবস্থায় একটু ভিন্নতা আনতে কপিলার প্রেমে পড়ে সে।

জীবনের পরাজয় ও দরিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করতে করতে ক্লান্ত কুবের বের হওয়ার পথ খোঁজে। দুঃখ থেকে মুক্তি পাবার জন্য মানুষের ভেতর যে সহজাত প্রবৃত্তি ক্রিয়া করে তারই প্রকাশ ঘটেছে এই উপন্যাসে। তাই গ্রামের যন্ত্রণা দগ্ধ পরিবেশ থেকে প্রশান্তি পাবার আশায় হোসেন মিয়ার প্রস্তাবে কুবের ময়না দ্বীপে অভিবাসনে রাজি হয়। নিজের জীবনকে নতুন করে সাজাতে কপিলাও কুবেরের সঙ্গী হতে চায়। 

পুতুলনাচের ইতিকথায় গ্রামীণ মানুষের জীবন থেকে কুসংস্কার, অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও গোঁড়ামি দূর করে আধুনিকতার প্রবাহ আনতে উদয় হয় শশী চরিত্রটি। পেশায় ডাক্তার শশীর এতোটাই আত্মবিশ্বাস ছিল যে গ্রামের পরিবর্তন তাঁরই হাতে হবে। গ্রামের এক প্রবীণ দম্পতি লোকচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে বিষ পানে নিজেদের স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করে গ্রামবাসীর কাছে মহৎ হলে; শশী তাঁদের ভণ্ডামীকে সবার সামনে তুলে ধরলেও অজ্ঞ গ্রামবাসী ডাক্তারকেই দোষী ভাবে।

অন্যদিকে শশীর বন্ধু মতি অনেক বাস্তববাদী। সে শশীর মতো করে জীবনকে দেখে না। তাঁর জীবন শশীর চেয়ে গতিশীল। এই উপন্যাসে মানিক দেখিয়েছেন একদিকে গ্রামের অজ্ঞতা, অশিক্ষায় দীর্ঘদিন বসবাস করা কুপমণ্ডুক মানুষ আর অন্যদিকে নগর সভ্যতার গতিশীলতা। মতির সাথে গ্রামের মেয়ে কুমুদের বিয়ে হয় এবং দুজনেই চলতে থাকে অজানার পথে যা আসলে ভবঘুরে জীবনের ঘুরপাক, অন্য কথায় অভিবাসন।

পদ্মানদীর মাঝি বা পুতুলনাচের ইতিকথার যে গ্রাম্য জীবন তা মূলত নিম্নবিত্তের জীবন যদিও এই উপন্যাস দুটিতে নাগরিকতার ছোঁয়াও আছে। কুবের ও মালার জীবন বিত্তহীনতায় শুরু হলেও তা থেকে বের হওয়ার জন্য নানা কিছু তাড়িত করতে থাকে দুজনকেই। উপন্যাসের শেষে চরিত্রগুলোর অনেককেই দেখা যায় ময়না দ্বীপে বসবাসের আকাঙ্ক্ষায় জীবনের পরিতৃপ্তি। ময়নাদ্বীপে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জীবনের নিরাপত্তা আসবে, কুবেরের মনে সেই আশা কাজ করে।

লেখক মানিক মতি ও কুমুদকেও তেমনি গ্রাম্য গোঁড়ামি থেকে বের করেছেন। তাঁর উপন্যাসের বেশ কিছু চরিত্র নিম্নবিত্তের গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে মধ্যবিত্ত জীবনের পথে এগিয়ে যায়। আমাদের দেশসহ সারা ভারতে ব্যক্তিজীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য গ্রামের লোকেরা শহরে যায়। ঠিক যেভাবে ঘটে ইংল্যান্ডে “১৫শ শতকের শেষ তৃতীয়াংশে এবং ১৬শ শতকের প্রথম দশকগুলিতে। একগাদা মুক্ত প্রলেতারীয়কে শ্রমবাজারে নিক্ষেপ করা হয়”[৩]; একইভাবে ভারতে বিশ শতকে নিম্নবিত্ত মানুষেরা নগরজীবনে যাওয়া শুরু করেছিলো।

এভাবেই অর্থনৈতিক এবং চিন্তার পরিবর্তনের সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক পরিবেশে মানুষ অভ্যস্ত হতে থাকে। এই দুই উপন্যাসেই লেখক দেখিয়েছেন মানুষের একস্থান থেকে অন্যস্থানে গিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের আধুনিক জীবনধারাকে। মানিক তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ধারা হিসেবে অভিবাসনকে দেখেছেন একটি কার্যকরী উপায় এবং সেটাই হবে আমাদের গবেষণার মূল বিষয়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন জগত ও সমাজ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক ও গভীর। তিনি সাহিত্য রচনার শুরুতে যেমন ফ্রয়েডীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তেমনি মানুষের জীবনের মুক্তি দেখেছিলেন মার্কসবাদে। মার্কসবাদী মতবাদের প্রেক্ষিতে তিনি জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যে বিশ্বাস পোষণ করেন শেষ জীবনের সাহিত্যে তিনি তারই সফল প্রয়োগ করেছেন। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে এবং বিশ ও একুশ শতকের মানব অভিবাসন সংক্রান্ত চিন্তাধারা ও মতবাদগুলোর প্রেক্ষিতে আমি মানিকের দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরতে ইচ্ছুক।[৪]

তথ্যসূত্র:

১. চক্রবর্তী যুগান্তর, অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়েরি ও চিঠিপত্র, প্রথম প্রকাশ, , অরুণা প্রকাশনী, আগস্ট ১৯৬১, পৃষ্ঠা ১৮।
২. সৈয়দ আবদুল মান্নান, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তর্বাস্তবতা বহির্বাস্তবতা, প্রথম প্রকাশ. , প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩০
৩. মার্কস কার্ল, পুঁজি . ১, প্রগতি প্রকাশন, তারিখহীন, পুঁজির উদ্ভব, অষ্টম অধ্যায়, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ।

৪. দোলন প্রভা, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ “মানিক কথাসাহিত্যে অভিবাসন হচ্ছে চরিত্রসমূহের আবাস স্থানান্তর”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/literature/migration-in-manik/

Leave a Comment

error: Content is protected !!