ছন্দ চিরকালই স্বীকৃত ও চর্চিত বিষয় কবিতার রূপ বিচারে

ছন্দ (ইংরেজি: Meter) চিরকালই স্বীকৃত ও চর্চিত বিষয় কবিতার রূপ বিচারের ক্ষেত্রে। কেননা, কবিতার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপাদান হলো ছন্দ। কবিতার ছন্দ হয়ে উঠেছে বিধৃত চেতনার অনিবার্য রূপকলা। একমাত্র কাব্যধর্মী নাটক ছাড়া সাহিত্যের অন্যসব রূপ (Form) থেকে কবিতাকে পৃথক করে এই ছন্দ।

ছন্দ সংস্কৃতে লঘু ও গুরু অক্ষরের নিয়মানুসারী বিন্যাস। আচ্ছাদন করে তাকেই ছন্দ বলা হয়, ‘ছন্দাংসি ছাদনাৎ’ (‘নিরুক্তি’, যাস্ক)। যা হৃদয়ে আনন্দ সঞ্চার করে তাকেই ছন্দ বলা হয়, ‘ছন্দয়তি হলাদয়তী ছন্দ’ (পাণিনি, ব্যাকরণ)। ‘রোমানি ছন্দাংসি’ অর্থাৎ ছন্দ রসাত্মক কাব্যদেহের রোমস্বরূপ (রাজশেখর)। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘মানবের জীর্ণ বাক্যে মোর ছন্দ দিবে নব সুর/ অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তাকে যাবে কতদূর/ ভাবের স্বাধীন লোকে (‘ভাষা ও ছন্দ’)।[১]

কবিতার প্রকরণ বা শিল্পরূপ অনুধাবনের জন্য অলঙ্কার, চিত্রকল্প, ছন্দ এবং ছদস্পন্দ সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। অলঙ্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ (অলম-কৃ (করা)+ঘঞণ] আভরণ বা ভূষণ। অর্থাৎ যে সকল উপাদান কবিতার অবয়বকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে সাধারণ অর্থে তাই অলঙ্কার।

ছন্দের উদ্দেশ্য হলো কবিতায় গতিসঞ্চার করা। আর ছন্দের মূল উপাদান হলো ধ্বনি। ইংরেজিতে শ্বাসাঘাতযুক্ত (সবল, accented) এবং স্বাসাঘাতহীন (দুর্বল, unaccented) এই দু-ধরনের অক্ষর (syllable)-এর নিয়মানুসারী সমন্বয়ে ছন্দঃস্পন্দের সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। সংস্কৃতে পদান্তৰ্গত লঘু ও গুরু অক্ষরের নিয়মানুসারী বিন্যাসে ছন্দঃস্পন্দ সৃষ্টি হয়। বাংলায় ছন্দে ধ্বনির দৈর্ঘ্য বা উচ্চারণের কুলপরিমাণকে বলা হয় মাত্রা।

অক্ষর এবং মাত্রা—এই দুই-এর ভিত্তিতে ছন্দের প্রকার নির্ণয় করা হয়ে থাকে। বাংলা ছন্দের গঠনে পর্বই প্রধান। সংস্কৃত ছন্দের প্রধান দুইটি শ্রেণি হলো-‘বৃত্ত’ এবং ‘জাতি’। ‘বৃত্ত’ ছন্দে স্তবকের প্রতি চরনের অক্ষরসংখ্যা সমান থাকে। ‘জাতি’ ছন্দে প্রতি চরণের অক্ষরসংখ্যা সমান থাকে না কিন্তু মাত্রাসংখ্যা সমান থাকে।

ছন্দ এবং এর প্রকারভেদ

সাধারণভাবে ছন্দ (Meter) এবং ছন্দস্পন্দ (Rhythm)-কে আলাদাভাবে দেখানো হলেও সার্থক কবিতার ছন্দ গড়ে ওঠে দুটিরই আশ্রয়ে। ছন্দস্পন্দের সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনিরূপতি রূপই হলো ছন্দ। বাংলা কবিতায় তিন ধরনের ছন্দের প্রচলন রয়েছে।

১. অক্ষরবৃত্ত 
২. মাত্রাবৃত্ত
৩. স্বরবৃত্ত 

যুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষরের মাত্রাবৈচিত্র্য এবং ঝোঁক (Stress)-এর প্রবণতা অনুযায়ী ছন্দের এই শ্রেণিকরণ করা হয়েছে। কিন্তু ছন্দবিচারে এগুলোই শেষ কথা নয়। কবিতায় অর্থ ও ধ্বনির মেলবন্ধনে গভীরতর ব্যঞ্জনা সৃষ্টির জন্য ছন্দের প্রয়োগকে অনিবার্য হতে হয়। আধুনিক কবিরা জীবনের পরিবর্তন ধর্মকে কবিতায় রূপদান করতে গিয়ে ছন্দ নিয়ে বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ছন্দ হয়ে উঠেছে কবিতায় বিধৃত চেতনার অনিবার্য রূপকলা ।

ছন্দকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘মিটার’ (metre)। ছন্দ হচ্ছে ঝোঁক দেওয়া এবং ঝোঁক না-দেওয়া শব্দপাপড়ির বিন্যাস। ছান্দিক বিন্যাস বিভিন্ন ধরনের হতে পারে- (১) পরিমাণ-ভিত্তিক ছন্দ (quantitative metre), যেটি সাধারণত গ্রিক ও লাতিন কবিতায় ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, (২) দল ভিত্তিক ছন্দ (syllabic metre), ফরাসি ও জাপানি কবিতায় দেখা যায়, (৩) ঝোঁক ভিত্তিক ছন্দ (accentual metre)—প্রাচীন ইংরেজি এবং পরবর্তীকালে জনপ্রিয় ইংরেজি কবিতায় ব্যবহৃত হয়, (৪) ঝোঁক ও শব্দপাপড়ি ভিত্তিক (accentual syllabic metre) ছন্দ। [অন্বেষিয়া দশদিশা যেন ধরণীর তৃষা’ ]।

বস্তুসংক্ষেপ: আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন, কল্পনা প্রভৃতি ব্যক্তিমানসের সাধারণ প্রবণতার অংশ; এগুলোর সঙ্গে যখন সৃষ্টিশীলতা যুক্ত হয়, অনিবার্য শব্দের তাৎপর্যময় বিন্যাস তাকে করে তোলে ব্যঞ্জনাময়। তখনই একটি কবিতার জন্ম সম্ভব। সাধারণভাবে বলা যায়, কবির স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি শব্দ ও ছন্দের অনিবার্য বিন্যাসে জীবনের গভীর এবং স্থায়ী আবেদন সৃষ্টির উপযোগী যে শব্দসৌধ সৃষ্টি করে, তাই কবিতা। 

তথ্যসূত্র

১.  সুরভী বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যের শব্দার্থকোষ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯, কলকাতা, পৃষ্ঠা-৫০-৫১

Leave a Comment

error: Content is protected !!