অনন্যা, আমি যোগাযোগ করতে পারছি না
আমি এখন বিচ্ছিন্ন, পৃথিবী থেকে নয়,
সভ্যতার অবশিষ্ট অংশ থেকে নয়,
আমি বিচ্ছিন্ন হয়েছি তোমার কাছ থেকে।
তোমাকে জানাচ্ছি, আজ চাঁদের তীব্রতম আলো
আমাকে বলেছে যৌথ সংগ্রাম আসবে আমাদের স্টেশনে,
তোমার কী খুব খারাপ লাগছে একাকী সন্ধ্যাগুলো,
আমি হারিয়েছি আমার অতীত,
হারিয়েছি সেই সে কাল যা তোমার আলোয় আলোকিত;
আমাদের শহরে টাকা আসছে,
ঘন কালো জমাটবদ্ধ টাকা, লোভ জাগানিয়া টাকা,
আমার সাহস নেই তাই তোমার কাছে আলো চাইছি না,
তুমি একবার চোখ তুলে তাকাও আমাদের শহরের দিকে
তোমাকে শীতের রাতগুলোতে আগুন জ্বালাতে হবে না,
তুমিই তো একমাত্র জীবন্ত সূর্য।
আমরা কয়েকদিন আগে সুবর্ণরেখায় আলো ফুটতে দেখেছি
আমরা এখন অজস্র মানুষ তোমাকে শস্য খেত বানাতে ডাকছি,
পাহাড়ের পাশে সংকীর্ণ পথ প্রশস্ত করতে ডাকছি,
নতুন বছরের লড়াকু পথে মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে যাবে,
কোনোদিন আমরা মাতৃভূমি ও মাকে অরক্ষিত রাখবো না,
আমরা ঘোষণা করেছি শ্রমিক কৃষকেরাই এ শতকের সূর্যসন্তান,
অনন্যা, এই যে দেখছো রাতের তারারা এক একটি কবিতা,
তারা মুক্ত করছে অজস্র বন্দি মানুষ, যারা একদা দাস ছিলো,
অনন্যা, আকাশের তারারা স্বপ্নের পাখায় গোটাদেশ ঘিরেছে।
আমরা অনেক পূর্বে দেখেছিলাম ধর্মপুস্তক ও সামন্তরাজা
আমরা এখন দেখছি শ্রেণিসংগ্রাম ও দিন বদলের ইশতেহার,
আমাদের হাতে হাতে আমাদের পুস্তিকা, আমাদের প্রত্যাশা,
আমরা জনগণকে শিখিয়েছি দিনরাত আর সাদাকালোর পার্থক্য,
লড়াই ছাড়া আমাদের কোনো অগ্রগতি নেই,
তুমি জানো কারা ধ্বংস করেছে সব শুভ আশা;
আর আমাদের লড়াই বারবার ব্যর্থ হয় যদি
তুমি হয়ো আগুনপাখি, আমি হবো আগুন নদী।
এদেশে ঘাসেরা সব সময় আশাবাদী, পাখিরা গায়ক
তুমি ভেবেছিলে আমাদের রণকৌশলের ভুলগুলো নিয়ে,
কিছু গাছ আমাদের পক্ষে ছিলো, কিছু ফুল আমাদের ছিলো,
রাজপথে আমরা তরবারি বিপ্লব আর সমুদ্র নিয়ে মেতেছিলাম।
অনন্যা, আমি তোমার হাতে দৃঢ়তাকে দেখেছিলাম,
আরেকদিন আমি তোমার জন্যে পথে বেরিয়ে খুঁজেছিলাম সত্য পথ,
কৈশোরকালে এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলে ঘুরেছি,
সেই হুলিয়ার দিনগুলো আর নির্বাসনের রাতগুলোয় ব্যস্ত ছিলাম,
সাঁতরে পেরিয়েছি গড়াই মধুমতি ইছামতি মহানন্দা নদী,
এশিয়া হতে আফ্রিকায় যে বাঘেরা ঘুরেছে তাদের মতো আমি
এক জীবনে এক লক্ষ মাইল পথ পেরিয়েছি,
ফসল বুনেছি, ফসল কেটেছি, তৈরি করেছি খেত খামার,
আসবাব হীন ঘরে আমাদের কাজ ছিলো পৃথিবীকে পরিষ্কার করবার।
অনন্যা, আমরা দুজন রাজধানীতে রাজতন্ত্রকে হটিয়েছিলাম,
আমরা উঠতি কিছু ব্যবসায়ীর বিত্তের লোভ দেখে ভীত হয়েছিলাম,
আমরা নিজেদের মুক্ত রাখতে পারিনি যন্ত্রের শক্তিতে,
আর সবাইকে মনোযোগ দিতে গিয়ে কিছুদিন তোমাকে ভুলেছিলাম,
আর ক্লান্তিহীনভাবে নিজের মনের নোঙর গণমানুষের বুকে রেখেছিলাম,
আমরা ছিলাম একেকজন আগ্নেয়শিলায় তৈরি নবীন ভাস্কর্য,
শত আঘাতেও দুর্দমনীয়, হিম, কঠিন অপরাজিত,
সেই সাম্যের লড়াইয়ের দিনগুলোতে তুমি গভীর প্রাণোচ্ছল,
সেই তোমাকে আমি পাথরে পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাতে দেখেছি,
তুমি সত্যিই অনেক তারার মতো আগুনের দ্বীপ গোটা দেশজুড়ে,
তুমি জ্বলতে পারো, জ্বালাতে পারো প্রেমময় যুগান্তের আলো,
যুদ্ধ আর মৃত্যুর পরে যে শান্তি থাকে তুমি তার শপথ,
আমি চেয়েছিলাম খ্যাতি ও মুক্তি, এক মুঠো ধানগাছ,
আমাদের বেদনা ছিলো আর ছিলো সমবায়ের ফসল,
হাতুড়ি, কোদাল, কাস্তে আর কলম ছিলো আমাদের শিশুদের,
আমাদের পোষা গরু মহিষ ও ভেড়া ছিলো,
আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে ছিলো চাষের স্বপ্ন,
পরিবহনের জন্য ছিলো রেলগাড়ি ট্রাক আর জাহাজ,
আমাদের গলায় গান ছিলো, গানে সুর ছিলো,
সুরে ছিলো দিন বদলের অমল প্রতিজ্ঞা,
আমরা টাকা, স্বর্ণমুদ্রা, শেয়ারবাজারের দলিল ত্যাগ করে
মানুষ হবো, প্রকৃত মানুষের ইতিহাস লিখবো।
আরো পড়ুন
- ৫৬,০০০ বর্গমাইল
- পরাজিত শ্রমিক
- স্বদেশ শ্মশান
- সমাজতন্ত্র আকাশ থেকে পড়ে না
- আমাদের আশাগুলোর বয়স বাড়ে না
- একটি নাটাবটের একটি তিতির হবে একটি সেতু
- ভিখারিনী থেকে জ্যান্ত পুঁজির দানব, কলকাতা
- হাজার বছর পরে মুক্তির উৎসব
- যৌথতার গান
- জীবনের নব সূর্যস্নান
- আমাদের অম্লান চেতনা
- আমার হৃদয় কোনো দেয়াল মানে না
- পিতৃভূমি, তোমার হৃদয়ে আলো জ্বেলে আমাদের ক্রমমুক্তি হবে
- তুমি আসবেই আমার শ্রেণিহীন রক্তে
- আমরা সেদিন, বহুদিন তারপর কিছুদিন জীবনের গল্প বলেছি
০৩ মার্চ ২০০৭;
গফরগাঁও, ময়মনসিংহ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।