লু স্যুনের ছোটগল্প-এর চরিত্রগুলো সামন্তবাদের বিরুদ্ধে লড়ায় করেছে

লু স্যুন (২৫ সেপ্টেম্বর ১৮৮১ – ১৯ অক্টোবর১৯৩৬) ছিলেন  একজন ছোটগল্প লেখক, প্রাবন্ধিক, কবি, অনুবাদক, সামাজিক সমালোচক, একজন শিক্ষক এবং একজন বিপ্লবী। চীনা জনগণের বিপ্লবের সঙ্গে তাঁর সাহিত্য ও মতাদর্শ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। লু স্যুনের সাহিত্য চীনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তার প্রতিফলন। লু স্যুনের গল্পে ১৯১১ সালের বিপ্লবের আগে থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত চীনের যে বাস্তব পরিস্থিতি তাই তিনি তুলে ধরেছেন।

ছিং রাজবংশ উৎখাত করে ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠা হয় প্রজাতন্ত্রী চীন। এর কয়েক বছর পড়ে ১৯১৯ সালে ৪ঠা মে শুরু হয় আন্দোলন। লু স্যুন মনে করেছিলেন রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটে প্রজাতন্ত্র এলে খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক সাধারণ মানুষের অবস্থার উন্নতি ঘটবে। তাদের উপর নিপীড়ন কমবে কিন্তু অচিরে তাঁর ধারণা ভুল প্রমানিত হয়। এদিকে ৪ঠা মে আন্দোলনে যে নব্য বুদ্ধিজীবীরা আশার আলো দেখিয়েছিল তাও কিছুদিনের মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এরপরে নিজের ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে ১৯১৮ সাল থেকে শুরু করেন গল্প লেখা। ১৯২১ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতা সর্বহারাদের হাতে আনবার জন্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। তখন লু স্যুন ‘একটি ছোট ঘটনা’ গল্পের মাধ্যমে শ্রমিকদের কথা বলেন। এছাড়া তাঁর লেখার বিষয় ছিলও শ্রমিক, কৃষক, নারীর প্রতি সমাজের যে অন্যায়, শোষণ, নিপীড়ন তার বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা।[১]

লু স্যুনের ছোটগল্প-এ শ্রমিকের চেয়ে বুদ্ধিজীবী, কৃষক এবং নারীর জীবনের করুন চিত্র চিত্রায়িত করেছেন। তিনি ছোটবেলায় কৃষকের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং খুব কাছ থেকে তাঁদের জীবন দেখেছিলেন। তিনি তাঁর গল্প ‘গ্রাম্য অপেরা’, ‘জন্মভূমি’তে দেখিয়েছেন কৃষক জীবনের পরিণতি। ‘গ্রাম্য অপেরা’ গল্পে এক কৃষক পরিবারের সাথে মেলামেশা, অপেরাতে যাওয়া, তাদের জীবন যুদ্ধের যে বনর্না পাওয়া যায় তা থেকে বুঝা যায় এটা লু স্যুনের নিজের জীবনের একটি অংশ।[২]

‘আ কিউ’র সত্য ঘটনা’ গল্পটিতে আ কিউ লু স্যুনের এক অমর সৃষ্টি। আ কিউ ছিলও এক ভূমিহীন কৃষক। তাঁর নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। গ্রামের সবাই তাকে বিদ্রূপ করে। তিনি অনেকের কাছে চড় থাপ্পড় খায়েছেন কিন্তু কখনও মনোবল হারান নি। অন্যের কাছে মার খেয়ে পরে নিজের গালে চড় মেরে মনকে বুঝাতেন তিনি অন্যকেই মেরে শোধ নিয়েছে। ১৯১১ সালে বিপ্লবের সময় আ কিউ প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছেন। গ্রামের মানুষকে বুঝিয়েছেন বিপ্লবীরা খারাপ না, গ্রামের সবার মঙ্গলের জন্যই এসেছে তারা। শেষে দেখা যায় সামন্তবাদী ও মেকী বিদেশি শয়তানরা বিপ্লবী হয়ে যায় আর আ কিউ হয়ে যায় শত্রু। আ কিউর শেষ পরিণতি হয় ফাঁসি।[৩]

চীনের সামাজে নারীদের অসহায় অবস্থা সম্পর্কে প্রথম লু স্যুন তাঁর ছোটগল্পে তুলে ধরেছেন। তিনি নিজেও সেই সমাজে নারীর অবস্থান দেখে ব্যথিত ছিলেন। তাঁর কিছু গল্পে নারী চরিত্রের যে নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে সেই চিত্র বিরাজ করছিলো চীনের হাজার হাজার নারীর জীবনে। ‘আগামীকাল’, ‘নববর্ষের উৎসর্গ’, ‘তালাক’ গল্পে ফুঠিয়ে তুলেছেন নারীদের সামাজিক যন্ত্রণার মধ্যে ঠিকে থাকার লড়াই।

‘আগামীকাল’ গল্পটি বিধবা এবং তাঁর তিন বছরের ছেলে সম্পর্কে। গল্পের বিধবা নারী চরিত্রটি পরিচিত চার নম্বর শানের স্ত্রী নামে, তিনি ছিলেন একজন মেহনতি মহিলা। তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর, তিনি নিজের এবং তাঁর সন্তানকে বাঁচানোর জন্য কাপড় বুনেন। ঘরে তিন বছরের অসুস্থ ছেলে। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য জমানো সঞ্চয় খরচ করেন, উচ্চবিত্তের কাছে সহযোগিতা চেয়েও পান না। অবশেষে সন্তান হারিয়ে একা ঘরে চোখ বুজে আগামী দিনের অপেক্ষা করতে থাকেন। এ গল্পে মমতাময়ী মায়ের হাহাকার পাঠকের মনকে নাড়িয়ে তুলেছে। সে সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিধবা নারীর অসহায় অবস্থা এই গল্পে উপস্থাপন করেছেন লেখক।[৪]

অশিক্ষা, কুসংস্কারের প্রভাবে নারী জীবনের নির্যাতিত চিত্র ফুটে উঠেছে ‘নববর্ষের উৎসর্গ’ ছোটগল্পে। এ গল্পটি সিয়াং লিনের গ্রাম্য সরল বউের করুন পরিণতি নিয়ে। স্বামীর মৃত্যুর পরে তার পরিবার তাকে জোর করে দ্বিতীয়বার বিয়ে দেয়। দ্বিতীয় বিয়েতে সে রাজি ছিলো না। এজন্য মাথা ফাটিয়ে নিজেকে রক্তাক্ত করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো। সমাজে ছড়িয়ে থাকা তুচ্ছ নিয়মকে বেঁচে থাকার নিয়তি হিসাবে মেনে নিয়ে স্বামীর সংসারে সুখি হতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্য তার সাথে অবিচার করে দ্বিতীয় স্বামী মারা যাওয়ায় মধ্যে দিয়ে এক সন্তানকে নিয়ে জীবনে হয়ে পরে আরও অনিশ্চিত। তবুও এক সন্তানকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলন, শেষে এক আঁধারের রাতে সে সন্তানকে নেকড়ে নিয়ে যায়। জীবনে একের পর এক আঘাত এসে তাকে অনুভূতিহীন করে ফেলে। প্রচলিত সমাজ এক বিধবাকে নিয়ে যা করায় তেমনি কাজ করতে হয়েছে সিয়াং লিনের স্ত্রীর। দাসীর কাজ করেছেন এক বিত্তশালী পরিবারে। এরপরে এক তুষার পড়া রাতে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে তাঁর জীবন যন্ত্রণা শেষ হয়।[৫]      

‘তালাক’ গল্পের নারী চরিত্র আই কুকে লু স্যুন ভিন্ন রূপে দেখিয়েছেন। সামন্তবাদী সমাজে শাসকেরা শোষণের প্রদীপের মতো টিপ টিপ করে যে নিয়ম জ্বলিয়ে রেখেছিল সেসবকে লাথি মেরে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ে যাওয়া এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আই কু। তিনি নিজের আধিকারের জন্য কারো সাথে তর্ক করতে ডরান না। সমাজে যারা প্রভাবশালী ছিল তাদের ক্ষমতাকে তুচ্ছ করে কথা বলতেন। এ কারণে সমাজের প্রতিপত্তিশালীরা নানাভাবে তাঁকে প্রতিহত করতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত আই কু পরাজিত হয়ে যায় সামন্তবাদী ও পুরুষশাসিত সমাজের কাছে। সেই সমাজ যে আই কুর মতো অধিকার সচেতন সংগ্রামী নারীর জন্য নয় সেটি স্পষ্ট করেছেন লু স্যুন এ গল্পে।[৬][৭]

লু স্যুন চাইলে প্রত্যেকটি নারী, কৃষক চরিত্রকে বিদ্রোহী করে তুলতে পারতেন, নিয়ে যেতে পারতেন অবাস্তবভাবে এক মুক্তির পথে কিন্তু তিনি তা করেন নি। কারণ সেটা করলে চরিত্রগুলো হয়ে পড়তো কাল্পনিক, তখন সমাজের ছড়িয়ে থাকা ক্ষতগুলো চীনা জনগণের সামনে উঠে আসতো না। তিনি প্রত্যেকটি গল্পে সামন্তবাদী সমাজের পচা গলা আবর্জনা স্তূপকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। লু স্যুন সেই সমাজকে ভাঙার জন্য লড়ায় চালিয়েছেন তার লেখায়। জনগনকে সচেতন করে গণ আন্দোলন গড়তে চেয়েছিলেন।

লু স্যুনের ছোটগল্প-এর চরিত্রেরা বাস্তব জগতেই বসবাস করা মানুষ। যারা প্রতিনিয়ত নানা ধরনে কুসংস্কারকে তুচ্ছ করে এগিয়ে চলে। সামন্তপ্রভুদের সাথে লড়ায় করে, নারী চরিত্রগুলো ক্ষমতাসীন লোলুপ চোখকে উপেক্ষা করে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য দৃঢ় চেষ্টা চালায়। লু স্যুনের গল্পের চরিত্রের জন্য কোনো কাল্পনিক দেব-দেবীর কাছে যাননি; ধুলাময় জগতে চলাচল করা বাস্তব ব্যক্তি। এইসব চরিত্ররা সামন্তবাদী সমাজের নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে। সেই চরিত্রগুলোর মাধ্যমে লু স্যুন তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার মৌলিক বিষয়কে তুলে ধরে পাঠকের ভেতর প্রশ্ন তৈরি করতে চেয়েছেন, এবং তিনি তা পেরেছেনও। এই জায়গায় লেখকের সার্থকতা। [৮]

১ সেন নালান: লু স্যুন জীবনী ও সাহিত্য, বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পেইচিং, প্রথম  সংস্করণ ১৯৮৬, পৃষ্ঠা, ২৯৫-২৯৭।   

২ সেন নালান: প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১১

সেন নালান: প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১২

৪  সেন নালান: প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৯

৫ সেন নালান: প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১০

৬ সেন নালান: প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১০

৭ আপনারা গল্পগুলো পড়তে পারেন মাহফুজ উল্লাহ অনূদিত লু স্যুনের নির্বাচিত গল্পসংকলন, বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, বেইজিং,চীন, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৮২ থেকে। 

৮. দোলন প্রভা, ১৯ অক্টোবর, ২০১৭, “লু স্যুন ও তাঁর গল্পের সংগ্রামী কয়েকটি চরিত্র”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/literature/lu-xun/

Leave a Comment

error: Content is protected !!