হৃতসর্বস্ব প্রজন্ম ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের সামাজিক প্রজন্মের সমাহার

হৃতসর্বস্ব প্রজন্ম বা হারানো প্রজন্ম (ইংরেজি: The Lost Generation) ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের সামাজিক প্রজন্মের সমাহার। এই প্রসঙ্গে ইংরেজি “Lost” বা বাংলায় “হৃতসর্বস্ব” বলতে যুদ্ধোত্তর যুগের প্রথম দিকে যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া কিন্তু নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং অন্যান্য দিক থেকে অনেকের “বিচ্ছিন্ন, ভবঘুরে, দিশাহীন” মনোভাবকে বোঝায়।[১][২] শব্দটি বিশেষভাবে ১৯২০-এর দশকে প্যারিসে বসবাসরত মার্কিন প্রবাসী লেখকদের একদলকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।[৩] আরও সাধারণ অর্থে, হৃতসর্বস্ব প্রজন্মটি ১৮৮৩ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত বলে মনে করা হয়।

যুদ্ধদীর্ণ ইউরোপে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর নিদারুণ অভাব এবং তার জন্য জীবনযাত্রার মানের অবনমন, যুদ্ধে বিরাট সংখ্যক তরুণের আত্মাহুতিতে সমাজের বিরাট গহ্বর, যারা যুদ্ধসামগ্রি সরবরাহ ও বিক্রয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল তাদের বিপুল ঐশ্বর্য, এই সমস্তই মানুষের মনকে বিষাক্ত করিয়া তুলেছিল। যুদ্ধোত্তর ইউরোপে নৈতিক মানেরও বিশেষ অধোগতি হয়। স্বাভাবিকভাবেই সেই যুগের চিন্তাশীল লেখকদের লেখায় এই মোহভঙ্গ ও অবসন্নতার রূপটি করুণভাবে ফুটিয়া উঠেছিল।[৪]

সাহিত্যে হৃতসর্বস্ব প্রজন্ম শব্দটির ব্যবহার

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লস্ট জেনারেশন বা হৃতসর্বস্ব প্রজন্ম অভিধাটি নিয়মিত প্রযুক্ত হতো। কথাটির উদ্ভাবক সেই সময়ের ‘আভাঁ-গার্দ’ শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক গারট্রুড স্টেইন (১৮৭৪-১৯৪৬)। হৃতসর্বস্ব প্রজন্মের জীবনযাত্রা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার আচরণের চমৎকার চিত্র পাওয়া যায় কতিপয় মার্কিন উপন্যাসিকের সাহিত্যকর্মে, বিশেষভাবে স্কট ফিটজিরাল্ড ও আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাসে।[৫] পরবর্তীকালে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এটিকে জনপ্রিয় করেছিলেন এবং ১৯২৬ সালে সালে তাঁর উপন্যাস দ্য সান অলসো রাইজেস-এর এপিগ্রাফে: “তোমরা সকলেই একটি হৃতসর্বস্ব প্রজন্ম” হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।[৬]

হেমিংওয়ে এবং স্টেইনের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত তাঁর ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত এ মুভেবল ফিস্ট শিরোনামের স্মৃতিকথায়, হেমিংওয়ে লিখেছেন যে স্টেইন একটি ফরাসি গ্যারেজ মালিকের কাছ থেকে এই বাক্যটি শুনেছিলেন যিনি স্টেইনের গাড়ি পরিসেবা দিতেন। যখন একজন তরুণ মিস্ত্রি গাড়িটি দ্রুত মেরামত করতে ব্যর্থ হলো তখন গ্যারেজের মালিক তরুণটিকে চেঁচিয়ে বললেন, “তোরা সবাই “génération perdue.” হেমিংওয়েকে গল্পটি বলার সময়, স্টেইন যোগ করেছিলেন: “তুমিও সেইটাই। তোমরা সকলেই এটাই … তোমরা সব তরুণরাই যারা যুদ্ধে সেবা দিয়েছিলে। তোমরা হৃতসর্বস্ব প্রজন্ম।” হেমিংওয়ে এইভাবে স্টেইনকে এই বাক্যাংশটির কৃতিত্ব দিয়েছিলেন, যিনি তখন তাঁর পরামর্শদাতা ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।[৭]

সাহিত্যের বিষয়

হৃতসর্বস্ব প্রজন্ম সাহিত্যের লেখকদের লেখাগুলি প্রায়শই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী বছরগুলির অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত। বলা হয় যে এই লেখকদের কাজগুলো তাদের জীবনের পৌরাণিক সংস্করণকে ব্যবহার করে আত্মজীবনীম আকারে লেখা হয়েছিল। লেখকদের রচনায় সাধারণত যে বিষয়বস্তু দেখা যায় সেগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে অবক্ষয় এবং ধনাঢ্যদের অসার জীবনযাপন। হেমিংওয়ে এবং এফ স্কট ফিটজেরাল্ড উভয়ই এই বিষয়টিকে স্পর্শ করেছিলেন উপন্যাস দ্য সান অলসো রাইজেস এবং দ্য গ্রেট গ্যাটসবি জুড়ে। এই লেখকদের রচনায় সাধারণত পাওয়া যায় এমন আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমেরিকান স্বপ্নের মৃত্যু, যা তাদের কতিপয় উপন্যাসে প্রদর্শিত হয়। এটি দ্য গ্রেট গ্যাটসবিতে বিশেষভাবে বিশিষ্ট, যেখানে নিক কারাওয়ে চরিত্রটি তার চারপাশে থাকা দুর্নীতিগুলোকে বুঝতে পেরেছিল।[৮]

তথ্যসূত্র

১. Hynes, Samuel (1990). A War Imagined: The First World War and English Culture. London: Bodley Head. p. 386. ISBN 0 370 30451 9.
২. কবীর চৌধুরী, সাহিত্যকোষ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ৮৭।
৩. Fitch, Noel Riley (1983). Sylvia Beach and the Lost Generation: A History of Literary Paris in the Twenties and Thirties. WW Norton. ISBN 9780393302318.
৪. কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানী, কলকাতা, তৃতীয় সংস্করণ, ডিসেম্বর ১৯৬৭, পৃষ্ঠা ২৪৬।
৫. কবীর চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৭
৬. Monk, Craig (2004). Writing the Lost Generation: Expatriate Autobiography and American Modernism. Iowa City: University of Iowa. p. 1.
৭. Hemingway, Ernest (1994). A Moveable Feast. London: Arrow Books. ISBN 978-0-09-990940-8. p. 18.
৮. Aleksandra Kovrlija, “American Lost Generation”. InterestingArticles.com. Archived from the original on 10 April 2016. Retrieved 30 March 2016.

Leave a Comment

error: Content is protected !!