‘অন্ধ হয়ে আসা চোখ’ ও ‘সিমন দ্য বোভেয়া: ব্রিজিত বার্দো এবং ললিতা সিনড্রোম’ (Lolita Syndrome)বই দুটির লেখক সৈকত দে। লেখকের কবিতা, গল্প, সিনেমা-এর উপর লেখা আরো ছয়টি বই আছে। তবে আমি কিছু কথা লিখবো লেখকের এই দুটি বইয়ের উপর।
লেখক ব্যক্তিজীবনে ইন্দিয়গুলোর মধ্যে চোখকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন ও ভালোবেসেছেন। তাই বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘অন্ধ হয়ে আসা চোখ’। এই বইয়ের প্রথমেই তিনি বলেছেন,
‘নানা অনিয়মে চোখের আলো ফুরিয়ে আসছে। এই চোখ আমায় গভীর আনন্দ দিয়েছে, তোমায় সম্পূর্ণভাবে দেখার আনন্দ, তোমার চোখে আমার ছবি দেখার চকিত সুখ’।
চমৎকার এক ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিজের বইয়ের নামকরণের কথা তুলে ধরেছেন। নাম দেখে অনেকেই প্রথমে ভাবতে পারে এটা গল্প বা কবিতার বই। বাস্তবে এই বইটিতে বিষয় ভেদে ৪টি ভাগ আছে। সিনেমা, অনুবাদ, গল্প ও কবিতা। পাঠক এই বই পাঠের মাধ্যমে লেখকের চারটি বিষয়ের দক্ষতা, পূর্ণতা বা অপূর্ণতার বিচার করতে পারবেন। এই বইয়ের সিনেমার অংশটি আমাকে বেশী আকর্ষণ করেছে। সত্যজিৎ রায়, বুদ্ধদেব বসু, ফেদেরিকো ফেলিনি ও আন্দ্রে মুঙ্ক- এই চার চলচ্চিত্র নির্মাতা সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখেছেন। যেগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিলো। প্রবন্ধগুলোতে লেখক খুব সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন এই গুণীদের ব্যক্তিত্বকে। এই অংশে তত্ত্বের কোনো জটিলতা নেই। যেকোন বয়স ও মেধার ব্যক্তিকেই আকর্ষণ করবে লেখাগুলো।
এই বইয়ে প্রকাশিত ৫টি কবিতা আমাদের বাস্তব জীবন ও আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে নিয়ে লেখা। অনেকে বলে ‘ আমি তো কবিতা বুঝি না’ সেইসব ব্যক্তিদের জন্য এই কবিতা বুঝতে সমস্যা হবে না। সহজ, সরল শব্দকে কাব্যিক রূপে আনা হয়েছে এখানে। তবে গল্পে ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা এনেছেন লেখক। কিছু কঠিন সত্য, ঘটনাকে এক করতে ও তার কারণকে একত্রিত করে উপস্থাপন করতে গিয়ে ঘটনার রেশের বিচ্যুতি ঘটেছে বলে আমার মনে হয়েছে। তবে লেখক যা বলতে চেয়েছেন সেটা ঠিকঠাক বলতে পেরেছেন। গল্পগুলোতে নাগরিক জীবনের প্রেম, বিচ্ছেদ, আড্ডা, না পাওয়া অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। গল্প পড়তে পড়তে মনে হবে আপনি যে কফি শপে আড্ডা দিয়েছিলেন তারই পাশের টেবিলের কোনো কাহিনী বলছেন লেখক।
কয়েকটি নাচ দেখুন
‘সিমন দ্য বোভেয়া : ব্রিজিত বার্দো এবং ললিতা সিনড্রোম’ এটি অনুবাদ বই। একজন ফরাসি অভিনেত্রী, মডেল, সঙ্গীতশিল্পীকে নিয়ে লেখা। যিনি পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে এক উজ্জ্বল আবেদনময়ী তারকা ছিলেন। সিমন দ্য বোভেয়া শুধু যে ব্যক্তি হিসাবে বার্দোকে এই বইতে তুলে ধরেছেন তেমনটা না। সেই সময়ের শিল্পের বাজারটাকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। চলচ্চিত্র নারীকে নগ্ন সৌন্দর্যের প্রতিমা বানিয়ে উচ্চবিত্তের মহলে স্থাপন করা। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনের জন্য এমন অভিনেত্রীর ভূমিকা আছে। চলচ্চিত্রে বার্দোর কথা, চলা-ফেরা, তাকানোর ভঙ্গি, হাসির মধ্যে পুরুষকে আকর্ষণ করার যে শক্তি তা পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকেই শক্তিশালী করেছে। ‘ললিতা’ চল্লিশ বছরের এক পুরুষের সাথে বারো বছরের মেয়ের সম্পর্কের কাহিনী। এই ধরনের সম্পর্ক বা ঘটনা একপ্রকার রোগ যা ‘ললিতা সিনড্রোম’ নামেই অনেকের কাছে পরিচিত। মূলত একজন পুরুষ চায় শিশুসুলভ মেয়েকে। শিশুর বৈশিষ্ট্য যে মেয়ের আচরণে যত বেশী প্রকাশ পাবে পুরুষকে সে ততবেশী মনোযোগ করতে পারবে। বার্দো অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো পুঁজির বাজারে শিল্প বলে মুনাফা করতে পারে। হয়তো তারকিছু চলচ্চিত্রে তেমনটা আছে কিন্তু সারমর্ম টানলে দেখা যাবে মনোরঞ্জনের জন্যই এই অভিনেত্রী কাজ করেছেন। তার নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা, গুণ শেষ পর্যন্ত পুরুষ ও পুঁজিবাদের সমর্থন করেছে। আমি বর্তমান সময়ে এবং এশিয়ার একটি দেশে বসে, যখন নিজ দেশের চলচ্চিত্র বাজার ও সেখানে নারীর উপস্থিতকে মূল্যায়ন করব, তারজন্যেও অনুবাদ বইটির গুরুত্ব আছে। বইটি সম্পর্কে আরো আলোচনা করা দরকার। ভবিষতে এই বিষয়ে লিখবো বিস্তারিত।
লেখক সৈকত দে-এর এই দুটি বই আমার পড়া হলও। আমার মূল্যায়ন যদিও সংক্ষিপ্ত কিন্তু মতামত প্রকাশের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। লেখক বলেছেনই তিনি চলচ্চিত্র দেখতে ও সেই বিষয়ে আগ্রহ বেশী। সেই জায়গা থেকে এই দুটি বই একই বিষয়ে। যদিও প্রথম বইটিতে মিশ্রণ আছে। তারপরেও চলচ্চিত্রের লেখাই প্রধান।
আরো পড়ুন
- নারী-শ্রমিকদের প্রথম সারা রুশ কংগ্রেসে বক্তৃতা
- সিমন দ্য বোভেয়া: ব্রিজিত বার্দো এবং ললিতা সিনড্রোম ও অন্ধ হয়ে আসা চোখ গ্রন্থের আলোচনা
- মুক্তি প্রসঙ্গে মার্কসবাদ
- নারী বই দুই বাংলার লেখকদের নারী মুক্তি বিষয়ক বিভিন্ন রচনার সংকলন
- নারীমুক্তির প্রশ্নে লেনিনবাদ শোষণ ও অধীনতা থেকে মুক্তির কথা বলে
- সাম্যের নারীবাদী ভাবনা হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মালিকানা অর্জনে সমতা
- নারীমুক্তি প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাক্ষাৎকার
- সেলিনা হোসেনের সাক্ষাৎকার — আদর্শবিহীন রাজনীতি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়
- হাসনা বেগমের সাক্ষাৎকার — আমাদের শত্রু হলো রাষ্ট্র ব্যবস্থা
- নারীবাদ পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট একটি পুরুষতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন
- নারীমুক্তি হচ্ছে সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।