সাহিত্যিক বাস্তববাদ বা সাহিত্যিক বাস্তবতাবাদ (ইংরেজি: Literary realism) হচ্ছে সাহিত্যের একটি ঘরানা, শিল্পকলার বিস্তৃত বাস্তববাদের অংশ, যা অনুমানমূলক কথাসাহিত্য এবং অতিপ্রাকৃত উপাদানগুলিকে এড়িয়ে সত্যদৃষ্টি দিয়ে বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে।[১] এটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফরাসি সাহিত্যে স্তাদাঁলের দ্বারা এবং রুশ সাহিত্যে আলেকজান্ডার পুশকিনকে দিয়ে বাস্তববাদী শিল্প আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। সাহিত্যিক বাস্তবতা পরিচিত জিনিসগুলি যেমন হয় তেমনিভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। বাস্তববাদী লেখকরা দৈনন্দিন ও মামুলী কার্যকলাপ এবং অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যে চিত্রিত করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন।
চিত্রকলায় বাস্তববাদ
চিত্রকলায় বাস্তববাদ বা রিয়ালিজম বলতে বোঝায় সমকালীন জীবনযাত্রার প্রায় হুবহু প্রতিচিত্রণ । কোনো বস্তুবিশেষের বাহ্যিক রূপকে নিবিড়ভাবে লক্ষ করে শিল্পী তার অন্তঃসৌন্দর্যকে নিজের সৃষ্টিতে ধরতে চাইলেও, রিয়ালিস্ট শিল্পীর লক্ষ্য তা নয়! বরং কত যথাযথভাবে বস্তুবিশ্বের বর্ণবৈচিত্র্য, আলোক প্রক্ষেপ আর ত্রিমাত্রিক অবস্থানগত গভীরতাকে দ্বিমাত্রিক সমতলে প্রতীতিযোগ্য করে তুলতে পারেন, সেদিকেই তিনি নজর দেবেন।
চারুকলায় বিভিন্ন বাস্তববাদী আন্দোলন হয়েছে, যেমন ভেরিজমোর অপেরা শৈলী, সাহিত্যিক বাস্তববাদ, নাট্য বাস্তববাদ এবং ইতালীয় নয়া বাস্তববাদী সিনেমা। চিত্রশিল্পে বাস্তববাদ শিল্প আন্দোলন ১৮৫০ সালের বছরগুলোতে, ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের পরে ফ্রান্সে শুরু হয়েছিল। বাস্তববাদী চিত্রশিল্পীরা রোমান্টিকতাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যে রোমান্টিকতাবাদ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফরাসি সাহিত্য এবং শিল্পকলায় প্রধান হয়েছিল।[২]
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ফরাসি চিত্রকলায় এর ধারাবাহিক চর্চা শুরু। তার আগে উনিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে বার্বিজোন শিল্পীগোষ্ঠী গ্রামীণ প্রকৃতি চিত্রণের ক্ষেত্রে এর সূচনা করে। ক্রমশ এরও অর্থান্তর ঘটে। সামাজিক হতাশা, ক্ষোভ প্রকাশেরও হাতিয়ার হয়ে ওঠে চিত্রকলা। সেইমত, ফ্রান্সে অনর দ্যুমিয়ে ফরাসি সমাজের অ-নৈতিক জীবনকে যখন তার টানা শক্তিশালী রেখায় ধরেন বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মোহমুক্তিকে জার্মান শিল্পীরা যখন আঁকেন তাদের ছবিতে ও চিত্রকলায় রিয়ালিজম চর্চারই অঙ্গ হয়ে ওঠে।
সাহিত্যে বাস্তববাদ
সাহিত্যের ক্ষেত্রে রিয়ালিজম চর্চা আর একটু অন্যরকম বিষয়। চিত্রকলার রিয়ালিজম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বা নতুন কিছু না হলেও, সাহিত্যে এর অর্থপ্রসার ঘটেছে অনেকখানি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফরাসি কথাসাহিত্যে সচেতনভাবে এই রিয়ালিজমের চর্চার আরম্ভ হয়। এর আগে অষ্টাদশ শতকে ড্যানিয়েল ডিফো, হেনরি ফিল্ডিংয়ের লেখায় ছিল এর পূর্বাভাস।
ঐতিহাসিক রোম্যান্স বা অন্যান্য রোম্যান্স রচয়িতাদের মতো এখানে পারিপার্শ্বিক থেকে সুদূরবর্তী কোনো স্থান কল্পনা করে এক বৃহত্তর মাত্রায় তার কাহিনিচিত্রণ রিয়ালিস্ট কথাকারের পথ নয়; আবার সমাজ পারিপার্শ্বিকে যে ধরনের পরিণতি কাঙ্ক্ষিত সেই ধরনের পরিণতির লক্ষ্যে কাহিনির সজ্জা নির্মাণও রিয়ালিস্ট কথাকারের লক্ষ্য নয়। পারিপার্শ্বিককে যেমন দেখছেন আর যেভাবে দেখছেন তারই উপস্থাপনা করবেন তিনি। দুটি শব্দই দরকারি–‘যেমন দেখছেন’ ও ‘যেভাবে দেখছেন’। ‘যেমন দেখছেন’ এর সঙ্গে যুক্ত দ্রষ্টার লক্ষ করার দক্ষতার প্রশ্ন আর ‘যেভাবে দেখছেন’-এর সঙ্গে যুক্ত দ্রষ্টার পরিলক্ষিত বস্তৃবিশ্বকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার প্রশ্ন।[৩]
লেখক কী লক্ষ করেন? লক্ষ করেন শুধু রাজবৃত্তে বা সামন্তবৃত্তে নয়, কাহিনির অনিঃশেষ উপাদান প্রচ্ছন্ন রয়েছে লোকবৃত্তে। সেইসূত্রেই রিয়ালিস্ট কাহিনির নায়ক শুধুই রাজসিংহ আর আকবর, শিবাজি নন, এর নায়ক কুবের মাঝি, শশী ডাক্তারও। পেশা অনুযায়ী, সামাজিক অবস্থান ও আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী, ব্যক্তিগত রুচি ও অভিরুচি অনুসারে ব্যক্তিচরিত্রের বিশেষ প্রকৃতি বদলাবে। বদলাবে তার সংলাপ, চিন্তাপদ্ধতি, আবেগের প্রকাশ-পদ্ধতি, গৃহসজ্জা, পোশাক, পছন্দের বিষয়তালিকা সবই। এই বিশেষ সাধারণ মানুষকে নিয়েই রিয়ালিস্ট কথাকারের কারবার। কথাকার সেই অবস্থার সঙ্গেই লক্ষ করেন পরিস্থিতি।
মানবজীবনে ঠিক যেমন—যেমনটি হওয়া উচিত, তেমনটিই ব্যক্তিবিশেষের জীবনে ঘটবে এমন পরিস্থিতি দুর্লভ। অথচ এই রোম্যান্সের জগতে আর আইডিয়ালিস্ট কথাসাহিত্যিকের কলমে দুর্লভ পরিস্থিতিই রীতিমত সুলভ। রিয়ালিস্ট কথাকার যে ধরনের হতাশা, অসংগতি ও অবসাদ দেখবেন চারদিকে, তার প্রকাশে তিনি অকুণ্ঠ। সেইসূত্রেই এসে পড়ে পরিস্থিতির বিশ্লেষণ ও উৎস সন্ধানের প্রশ্ন।
এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে রিয়ালিস্ট কথাকারের জিজ্ঞাসা । একদল, মানবমনের গহীন অবচেতন ও নির্জ্ঞানের মধ্য থেকে মানবসত্তার মূল খুঁজতে চেয়েছেন। ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণে তাদের সহায়ক হয়েছে। অন্যদল মানবসমাজের শ্রেণিগত অবস্থানের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ও মানসিকতার মধ্যে মানবসমাজের পরিস্থিতিগত অসংগতির উত্তর খুঁজেছেন, মার্কসবাদী দর্শন এঁদের পথ দেখিয়েছে। সেইভাবেই রিয়ালিজমের চর্চা থেকেই উত্থিত হয়েছে একদিকে ন্যাচারলিজম অন্যদিকে সোশ্যাল রিয়ালিজম।
বাংলা সাহিত্যে বাস্তববাদ
বাংলায় রিয়ালিজমের চর্চা আর ন্যাচারালিজমের চর্চা যেন হাত ধরাধরি করে এসেছে। ফলত প্রায়শই এখানকার রিয়ালিস্ট গল্পে ন্যাচারালিস্ট উপাদান মিলে মিশে থাকে। শুধু তাই নয় বাংলায় একদা রিয়ালিজমের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘বস্তুতন্ত্র’ শব্দস্থাপনে বেশ গোলমালও হয়। কারণ ভারতীয় দর্শনের বস্তুতন্ত্র-র সঙ্গে প্রাগুক্ত আইডিয়ালিস্ট মতের কিছুটা মিল আছে, অথচ পশ্চিমে রিয়ালিজম, আইডিয়ালিজমের বিরোধিতা থেকেই জন্মেছে। আর রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র কেউই এই ধরনের রূঢ় বাস্তবতার সমর্থন করতে পারেননি। শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘প্রকৃতি বা স্বভাবের হুবহু নকল করা ফোটোগ্রাফি হতে পারে, কিন্তু সে কি ছবি?’ রবীন্দ্রনাথও জানিয়েছেন,
“…লেখনীর জাদুতে, কল্পনার পরশমণিস্পর্শে, মদের আড্ডাও বাস্তব হয়ে উঠতে পারে, ইন্দ্রের সুধাপান সভাও। কিন্তু সেটা হওয়া চাই। অথচ দিনক্ষণ এমন হয়েছে যে, ভাঙা ছন্দে মদের দোকানে মাতালের আড্ডার অবতারণা করলেই আধুনিকের মার্কা মিলিয়ে যাচনদার বলবে হাঁ কবি বটে’, বলবে ‘একেই তো বলে রিয়ালিজম’। আমি বলছি, বলে না। রিয়ালিজমের দোহাই দিয়ে এরকম সস্তা কবিত্ব অত্যন্ত বেশি চলিত হয়েছে। আর্ট এত সস্তা নয়।”
বাংলার রিয়ালিজম চর্চা তাই স্বতন্ত্র অনুধ্যানের বিষয়। তাতে পশ্চিমি হাওয়া যেমন আছে, তেমনই স্থানীয় মাটিও আছে।
তথ্যসূত্র
১. Champfleury, Jule-Français (1857). Le Realisme. Paris: Michel Lévy. p. 2.
২. Ross Finocchio, অক্টোবর ২০০৪, “Nineteenth-Century French Realism”, Heilbrunn Timeline of Art History, ইউআরএল: https://www.metmuseum.org/toah/hd/rlsm/hd_rlsm.htm সংগ্রহের তারিখ ১২ মে ২০২১।
৩. রাখী মিত্র, “রিয়ালিজম”, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত; বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৫২-৫৫৪
পেইন্টিঙয়ের ইতিহাস: নিবন্ধে ব্যবহৃত পেইন্টিংটি জ্যাঁ ফ্রাঙ্কোইস মিলেটের আঁকা সংগ্রাহক বা The Gleaners. তিনি ১৮৫৭ সালে বাস্তববাদী ধারার এই চিত্রটি অঙ্কন করেছিলেন।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।