গ্রন্থাগার তুলে ধরে মানব সমাজের হাজার বছরের চিন্তা ও অনুশীলনের মহাকল্লোল

গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি (ইংরেজি: Library) মানবজাতির সামনে তুলে ধরে মানব সমাজের হাজার বছরের চিন্তা ও অনুশীলনের মহাকল্লোল। জীব যেমন জীবাশ্ম হয়ে ভূ-ত্বকের স্তরে স্তরে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে নিজেদের অস্তিত্বকে চিহ্নিত করে রেখেছে, তেমনি মানুষের কর্মপ্রেরণার সকল চিহ্ন আটকা পড়ে আছে গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরিতে। এখানে অক্ষরের বুকে আঁকা আছে মানবসৃষ্ট সকল জ্ঞান, সকল ভাবনা, তাদের আশা আর স্বপ্ন। যেইমাত্র মানুষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেকে বদলাতে শিখল, বদলে দিতে শিখল তার পার্শ্ববর্তি পরিবেশকে, সেইমাত্র সে নিজের জ্ঞান ও ভাবকে জানাতে চাইল অন্যের কাছে। নিজের ভাবকে অন্যের কাছে জানাতে গিয়েই প্রয়োজন পড়লো কথা, সংগীত, শব্দকে অক্ষরের চিহ্নে ধরে রাখবার। মানুষের লক্ষ বছরের ভাবনার কোলাহল তাই রূপ পেয়েছে শত কোটি পুস্তকের অন্তরে। মানুষের হাজার হাজার বছরের লিখিত অলিখিত সব ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে একেকটি গ্রন্থাগারের ছোট ছোট তাকে। মহাজগতের মানবহৃদয়ের সমস্ত আনন্দ-বেদনা সাফল্য-ব্যর্থতার কল্লোল ছড়িয়ে আছে গ্রন্থাগারের আলো-আঁধারিতে কালো অক্ষরের প্রতীকে।

একেকটি জ্ঞানগর্ভ বই যেন আমাদের একেকজনের কাছে মহাসমুদ্রের একেকটি ঢেউ বা সুর্যের এক-চিলতে আলো। আমরা গ্রন্থাগারের প্রতিটি বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে মহাজগতের মানবহৃদয়ের ছোটবড় ইতিহাস অনবরত পাঠ করছি। এখানে মানবসৃষ্ট সত্য মঙ্গল ও সুন্দরের আরাধনা কালো অক্ষরের জাদুতে কোলাহলমুখর রয়েছে। যে অতীত মানুষকে শিক্ষা দেয়, অতীতের যে অভিজ্ঞতাসমূহ হতে মানুষ শিক্ষা নেয়, যে বর্তমানে মানুষ জ্ঞানকে অনুশীলনের কষ্টিপাথরে যাচাই করে; যে ভবিষ্যত মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার আশা যোগায় তার মূলে ত্রিকালদর্শির ভূমিকা পালন করে আসছে গ্রন্থাগার।

গ্রন্থাগার মানুষের প্রথম জ্ঞানভাণ্ডার, প্রথম আলোকসভা, প্রথম স্বপ্নকণা। মৃতের সাথে জীবিতের যোগাযোগের প্রথম বাহন। যে মানব হারিয়ে গেছে কালের অতলে তার সাথে কথা বলার পবিত্র অলৌকিক স্থান এই গ্রন্থাগার। অভিজ্ঞতা আর আকাঙ্খাকে শত বছর পরবর্তি প্রজন্মের কাছে পৌঁছানোর অমোঘ স্থান এই গ্রন্থাগার। এখানে মানুষের লক্ষ বছর আগুনে পুড়ে খাঁটি হওয়া জীবন জীবন্ত আছে, শত পরিশ্রমে অর্জিত প্রকৃতির নিয়মের সূত্রসমূহ অনবরত নাচছে, কালের বদলে যাওয়া চিহ্ন কাগজের বুকে জেগে আছে আর দিন মাস-বছর-যুগ-শতাব্দী-সহস্রাব্দ নিজেদের মূল্যকে কালের আগ্রাসন থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নতুবা হয়ত কবে সেই অমূল্য সময় নিস্তব্ধতা, শব্দহীনতা আর চিহ্নহীনতায় হারিয়ে যেত।

গ্রন্থাগার চিহ্নের জাদুঘর, মানবের মহান কর্মসমূহকে চিহ্নে ধারণ করে রেখেছে গ্রন্থাগার। শিলালিপি থেকে শুরু করে সমস্ত প্রাচিন ও আধুনিক লিপির গ্রন্থিক স্থান এই গ্রন্থাগার। এখানে মানুষের চিন্তা, ভাবনা, কর্ম, প্রেরণা, শব্দ, সুর, সংগীত, সাধনা, সত্য মঙ্গল ও সুন্দরের পাঠ নবজাগরণের আকাঙ্খায় ঘুমিয়ে আছে। তাকে মানব হৃদয়ের জিয়ন কাঠি দিয়ে জাগিয়ে দিলেই হলো। সেই জাগরিত শব্দেরা সশব্দে সহস্র ভাষায় প্রতিধ্বনিত হয়ে জলে স্থলে নির্মাণে সৃষ্টিতে নিয়োজিত করবে। পুস্তক পাঠের প্রণোদনায় জাগরিত উদ্দীপনা মানুষকে এগিয়ে নেবে প্রগতির পথে।

নানা জাতির বহু সংস্কৃতির আধার ও আধেয় জমা আছে গ্রন্থাগারের পরতে পরতে। প্রাগৈতিহাসিক থেকে ঐতিহাসিক — সকল কালের মানুষের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির সৃষ্টিপ্রক্রিয়া লিপিবদ্ধ আছে এই গ্রন্থাগারে। তাই মানবজীবনের গঠন প্রক্রিয়ায় গ্রন্থাগারের ভূমিকা অসীম।

গ্রন্থাগার সমস্ত জ্ঞানের ধারক ও পাঠকের জ্ঞানের উৎস। আধুনিক গ্রন্থাগারে আছে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা ও শ্রেণিবিন্যাস। পুস্তক আমাদের পড়তে হয় ঠিকই কিন্তু পুস্তকই আমাদের সব কিছু নয়। পুস্তক ও গ্রন্থাগার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাই অনুশীলনের মাধ্যমে নতুন জ্ঞানে পরিণত হয়। তাই গ্রন্থাগারই হয়ে উঠেছে সুদূর অতীতকাল থেকে সমসাময়িককালের মানবের প্রধান সেতুবন্ধন। হাজার বছর আগের হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির সাথে সাক্ষাতের এমন অপূর্ব সুযোগ গ্রন্থাগার ছাড়া আর কে কবে করে দিতে পেরেছে!

আমাদেরকে বাঁচতে হলে গ্রন্থাগারের কাছে যেতেই হয়। প্রগতির পথে, শুভবোধের পথে, পুরোনো নৈতিকতার সীমাবদ্ধতাকে দূর করে নতুন নৈতিকতা সৃষ্টির পথে এগোতে হলে গ্রন্থাগারের কাছে যেতেই হয়। আমরা যেমন ভবিষ্যতে ভাষাহীন কোনো সমাজ ভাবতে পারি না তেমনি ভাবতে পারি না গ্রন্থাগারহীন কোনো সমাজ। নিত্য নতুন গবেষণার মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান ও বস্তুবাদের যে আবিষ্কারগুলো ঘটছে তার প্রধান প্রভাবকের ভূমিকা যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে লাইব্রেরি। তাই গ্রন্থাগারহীন ও গ্রন্থাগারের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে অনিচ্ছুক সমাজ স্থির ও নিশ্চল হতে বাধ্য।

গ্রন্থাগার গণআলোচনাকে গতিশীল রাখে, গণবিতর্ক চালাতে সহায়তা করে, তর্ক-বিতর্কে তথ্যের সরবরাহ করে, কোনো মতের বিরুদ্ধ মতের যোগান দেয়, নানামুখি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে ধারাবাহিক প্রগতি-অভিমূখি গণমত তৈরি করে। অর্থাৎ গ্রন্থাগার গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। জোর-জবরদস্তি নয়, পারস্পরিক আলোচনার অভয়স্থল হতে পারে এই গ্রন্থাগার। এখানে, আমরা চাইলেই, বাঙালির বিতর্কের ঐতিহ্যটিকে গতিশীল করতে পারি। নানা মতের মানুষের মিলনে গ্রন্থাগারটি মহত্তর অভিধা অর্জন করতে পারে; এটি হতে পারে আমাদের জাগতিক সমস্যা সমাধানের পুণ্যভূমি।

গ্রন্থাগার আমাদের সাহসী হতে শেখায়, এখানে পাঠের মাধ্যমে জানা যায় কীভাবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে হয় অন্যায়ের। মানবের সংগ্রামি ইতিহাসের দলিল এই গ্রন্থাগার। এখানে কালো অক্ষরে বর্ণিত আছে প্রগতির লড়াই, ন্যায় যুদ্ধ, সংগ্রাম মহত্ব আর শ্রেষ্ঠত্বের মানবীয় ইতিহাস। আছে সমাজ-প্রগতি এবং মানবের বদলে যাওয়ার, বদলে দেয়ার ইতিহাস। যুক্তির সাথে বুদ্ধি, বুদ্ধির সাথে আবেগ, আবেগের সাথে কর্ম ও কর্মফলের সমন্বয়ের ইতিহাস ধরা আছে পুস্তকের পাতায় পাতায়। লাইব্রেরি ধরে রেখেছে অশুভ পরিণতিকে এড়িয়ে শুভপথে চলার ক্রমাগত সংগ্রামের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার ইতিহাস। বিধি ও নীতির সমন্বয়ের ইতিহাসও ধরা আছে এই গ্রন্থাগারে। মানবের চিন্তায় যত রকমের বৈপরীত্ব ও দ্বান্দ্বিকতা থাকে, মানবের সাথে তার চারপাশের পরিবেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যত প্রকারের দ্বন্দ্ব থাকে সেসব দ্বন্দ্বের থেকে উন্নত প্রগতিপন্থি সম্পর্ক নির্ধারণের চেষ্টায় গ্রন্থাগার পালন করে আসছে এক অগ্রণী ভুমিকা ।

গ্রন্থাগার মানব জীবনকে পালটে দেয়। পৃথিবীর মহান মনীষীগণের প্রায় সকলেই শৈশব-কৈশোরেই কোনো না কোনোভাবে গ্রন্থাগারের সংস্পর্শে এসেছেন। হাজার হাজার ধ্রুপদী পুস্তক পড়েই তারা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছেন মানুষের সৃষ্টিসমূহও তার পরিণতিকে। একটি দেশের বা বিশ্বের সমাজ ও সংস্কৃতিকে উন্নত করতে হলে এই গ্রন্থাগারের উন্নতিবিধান অপরিহার্য। জ্ঞানের উন্নতি মানেই গ্রন্থাগারের উন্নতি। যে জ্ঞানী ব্যক্তিটি আজ বই পড়ে পড়ে বুঝতে চেষ্টা করছেন পরিবেশ-প্রকৃতি-সমাজ-রাষ্ট্র, তিনিই হয়তো একদিন তুলে ধরবেন সমাজ প্রগতির পথ। সেই অর্থে গ্রন্থাগার আমাদের মুক্তির দিশারি। গ্রন্থাগার মুক্ত করে মানব মনের সকল বাঁধন আর দূর করে কূপমণ্ডুকতা।

গ্রন্থাগার শুভবোধ আর শুভচিন্তায় আলোকিত করে মানবমন। এখানে আলোর ঝরণাধারায় উদ্ভাসিত হয় অন্ধকারের গহীন গহ্বর। আঁধার রাতের পথের দিশারী তাই এই গ্রন্থাগার। বারুদের মাঝে যেমন আলো বন্দি থাকে, তাকে জ্বালালেই দূর হয়ে যায় অন্ধকার, তেমনি গ্রন্থাগারে জ্ঞানের আলো পুস্তকের পাতায় থমকে আছে। মানব-কর্মের মহত্ত্বই এখানে যে সে পাঠের মাধ্যমে জ্ঞানের আলোকে দশদিগন্তে ছড়িয়ে দিতে চায়। লাইব্রেরি যেন একটি ক্ষুদ্র স্ফুলিংগ যে জ্ঞানের বিরাটকায় অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে পারে।

গ্রন্থাগারে জমা আছে জ্ঞানের সমস্ত শাখা-প্রশাখা। সেসব জ্ঞান মানব-হাতের জাদুকরি স্পর্শে বেরিয়ে পড়তে পারে সকল জাতির মুক্তি পথের সারথি হয়ে। সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি ইতিহাস রাজনীতি বিজ্ঞান চিকিৎসাবিদ্যা প্রযুক্তি—সব রকমের জ্ঞানের উৎস হতে পারে গ্রাম বা শহরের সাধারণ মানের একটি গ্রন্থাগার।

বই জ্ঞানদানে বৈষম্য করে না। পাঠকমাত্রই অনায়াসে পড়তে পারে বই। পাঠকের কাছে বই সহজলভ্য এক মাত্র গ্রন্থাগারে। গ্রন্থাগার মুক্তমনে দেয় উজাড় করে; গ্রহিষ্ণু মন নিয়ে যে গ্রহণ করে সেইতো সার্থক। গ্রন্থাগার ঝড়ের মধ্যে পথ দেখায় প্রদীপ হয়ে। এখানে মানবমন চিন্তা করতে শেখে, প্রশ্ন করতে শেখে, অজানাকে জানে, অদেখাকে দেখে, দুর্বোধ্যকে বোঝে; মানুষ তার প্রয়োজনে যেমন সৃষ্টি করে, তেমনি সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য প্রয়োজন সবার ঘরে একটি করে গ্রন্থাগার।

আমরা হয়তো একটি প্রতিক্রিয়াশীল বই ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি, কিন্তু একটি গ্রন্থাগারকে হারাতে পারি না। আর এই গ্রন্থাগার বা বই হচ্ছে প্রতিভা বসুর ভাষায় ‘শ্রেষ্ঠ আত্মীয় যার সংগে কোনোদিন ঝগড়া হয় না’।[১]

আরো পড়ুন

টিকা:

১. প্রবন্ধটি প্রথম “গ্রন্থাগার: মহাজগতের কল্লোল” শিরোনামে শফিকুল কাদির সম্পাদিত অর্ঘ্য ছোটকাগজে প্রকাশিত হয়। পরে এটি একই শিরোনামে ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে রোদ্দুরে ডট কম অনলাইনে প্রকাশিত হয়। ৩১ মার্চ ২০২১ তারিখে এটি ফুলকিবাজ ডট কমে প্রকাশিত হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ডিসেম্বর, ২০১২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!