সংস্কৃতি সম্পর্কে লেনিনবাদ হচ্ছে বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের প্রগতিশীল সংস্কৃতি

সংস্কৃতি সম্পর্কে লেনিনবাদ বা সংস্কৃতি সম্পর্কে লেনিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (ইংরেজি: Leninism on Culture) হচ্ছে প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রসঙ্গে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সামগ্রিক মূল্যায়ন। সংস্কৃতি সম্পর্কে মত প্রদান করতে গিয়ে প্রলেতারিয় সংস্কৃতি এবং তার গড়বার প্রক্রিয়া নিয়ে লেনিন আলোচনা করেছেন।

লেনিন সংস্কৃতিকে শান্ত জীবনের উপাদান হিসেবে দেখেননি। তিনি তলস্তয়ের মতো ‘অপরিণত স্বপ্ন দেখা, রাজনীতির অনভিজ্ঞতা, বৈপ্লবিক শিথিলতা, জনগণের বৈপ্লবিক সংগ্রামের জন্য অপ্রস্তুতি, অমঙ্গলের প্রতি না-প্রতিরোধ, কান্নাকাটি নীতিবাদ আর প্রার্থনা’[১] হিসেবে সংস্কৃতিকে দেখেননি। তাঁর কাছে প্রলেতারিয় সংস্কৃতি হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রাম, প্রতিরোধ ও বিপ্লবের ধারাবাহিক কর্মকাণ্ড। তাঁর মন্তব্য এরকমের যে, মার্কসের হাতে ঢেলে সাজানো অর্থশাস্ত্র যেমন সাম্যবাদীদেরকে দেখিয়েছে মানবসমাজকে কোথায় যেতে হবে, অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে শ্রেণিসংগ্রামে উত্তরণে, প্রলেতারিয় বিপ্লব শুরুর দিকে; ঠিক তেমনিভাবেই এই সমস্ত পথ ও রাস্তা পৌঁছিয়েছে, পৌঁছয় এবং পৌঁছচ্ছে প্রলেতারিয় সংস্কৃতিতে।[২] 

সংস্কৃতি সম্পর্কে লেনিনবাদ

সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তোলার জন্য বুর্জোয়াদের থেকে ক্ষমতা নিজেদের কাছে নেওয়া দরকার। এজন্য বিশেষজ্ঞদের কাছে টানতে হবে। সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা আমাদের এক উচ্চতর প্রলেতারিয় গণতন্ত্র দিতে পারে কিন্তু এর ফলে আমলাতন্ত্র দৃঢ় হয়। ক্ষমতা মেহনতি মানুষের থাকে না। এজন্য আইনই যথেষ্ট নয় প্রয়োজন কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন, যা চট করে তৈরি হয় না, এর জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদী কাজ। বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে কিন্তু তাঁদেরকে পুঁজিবাদের থেকেও উন্নত পরিস্থিতি দিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের সম্পর্কে লেনিন বলেছেন,

“বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রে আমাদের তুচ্ছ ছিদ্রান্বেষণের নীতি অনুসরণ করা উচিত নয়। এই বিশেষজ্ঞরা শোষকদের ভৃত্য নয়, এরা সাংস্কৃতিক কর্মী, বুর্জোয়া সমাজে এরা বুর্জোয়ার কাজ করেছে, এবং সারা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিকরা এদের সম্পর্কে বলে এসেছে যে, প্রলেতারীয় সমাজে এরা আমাদের কাজ করবে।”[৩]

সমাজতন্ত্র নির্মাণে বৃহৎ পুঁজিবাদী সংস্কৃতি যেমন উপাদান তেমনি বুদ্ধিজীবীরাও। পুঁজিবাদী সমাজে সব বুদ্ধিজীবীরা সমাজতন্ত্রী ভাবাপন্ন হবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের উচিত সেই বুদ্ধিজীবীদের যারা প্রলেতারিয়েতের অগ্রবাহিনী হিসেবে সাম্যবাদী দলকে মেনে নেবে এবং সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পুঁজিবাদী সমাজে গড়ে ওঠা বুদ্ধিজীবীদের আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এজন্য তাঁদের গ্রহণ করতে হবে, সুনির্দিষ্ট কাজ দিতে হবে, যাচাই করতে হবে। পুঁজিবাদের তৈরি করা উপাদান দিয়েই সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার কাজে হাত লাগাতে হবে। এক্ষত্রে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন বলেছেন

“বুদ্ধিজীবীদের ওপর আমরা কদাচ নির্ভর করব না, নির্ভর করব কেবল প্রলেতারিয়েতের অগ্রবাহিনীর ওপর যারা সমস্ত প্রলেতারিয়দের, সমস্ত গ্রাম্য গরিবদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে।”[৪]

বুর্জোয়া সমাজ ভেঙ্গে প্রলেতারিয়েতের সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ নয়। বুর্জোয়ারা নিজেদের অবস্থান শক্ত করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করবে। এজন্য জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে শ্রমিককে জ্ঞানী করে তুলতে হবে। সে জ্ঞান সমাজতন্ত্রের কল্পলৌকিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, ইতিহাসের যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে করতে হবে। সবসময় মনে রাখতে হবে বুর্জোয়ারা বহু বহু গুণ প্রবল। তাদের সাথে লড়াই করতে হবে সামরিক পদ্ধতিতে। এজন্য জনগণকে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করতে হবে। তাদেরকে বিজয়ী করার জন্য আত্মস্থ করতে হবে সমস্ত বিদ্যা ও সংস্কৃতি। কারণ তাঁদের মাধ্যমেই সমাজতন্ত্র সম্ভব। লেনিন বলেছেন,

“সর্বোত্তম ক্ষেত্রে আমাদের আন্দোলক প্রচারকদের বিদ্যা, কারখানার শ্রমিক অথবা বুভুক্ষু কৃষকের দারুণ দুর্ভাগ্যে পোড় খাওয়া লোকটার বিদ্যা — এ বিদ্যা আমাদের শিখিয়েছে দীর্ঘকাল রুখে থাকতে, সংগ্রামে একরোখা হতে, এতদিন পর্যন্ত এটা আমাদের বাঁচিয়েছে; এটা একান্তই আবশ্যক; কিন্তু এই সব নয়, শুধু এই একটা বিদ্যাতে বিজয়লাভ সম্ভব নয়; বিজয়কে পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত হতে হলে পুঁজিবাদের মধ্যে যা কিছু মূল্যবান তা সবই নিতে হবে, আত্মস্থ করতে হবে সমস্ত বিদ্যা ও সংস্কৃতি।”[৫]

সংস্কৃতি সম্পর্কে লেনিনবাদ এই কথায় বলে এসেছে যে, আগামি যুগে শ্রমিক-কৃষকের সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সংস্কৃতিতেই জনমুক্তির মূল চাবিকাঠিটি নিহিত। এই চাবিকাঠিটি আমরা পেতে পারি বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে এবং জনগণের লড়াইয়ের অদম্য প্রেরণা থেকে। বিপ্লবী হওয়া ছাড়া, বিপ্লবের জন্য সব দিককে কেন্দ্র করে লড়াই করা ছাড়া, জনগণের নিঃস্বার্থ সেবক হওয়া ছাড়া, শ্রমিক-কৃষকের সাথে একাত্মতা ছাড়া বিপ্লবী সংস্কৃতির সেবা করা যায় না। বিপ্লবী মতাদর্শ ও রাজনৈতিক লাইনে শিক্ষিত হওয়া ছাড়া সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সেবা করা সম্ভব নয়। একজন বিপ্লবী সাংস্কৃতিক কর্মীই পারে বিপ্লবী সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে। বাস্তব বিপ্লবী সংগ্রাম ও বিপ্লবী সাংস্কৃতিক কাজের মধ্যে কোনো চীনের প্রাচীর নেই। বিপ্লবী সাংস্কৃতিক কর্মী বিপ্লবী সংগ্রামেও অংশ নেয়, সেই অভিজ্ঞতা ও শিক্ষায় সুপুষ্ট হয়েই গড়ে তোলে বিপ্লবী সংস্কৃতি। একজন বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মীও অনেক ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক কর্মীতে।[৬]

তথ্যসূত্র ও টিকা:

১. ভ ই লেনিন, লেভ তলস্তয়—রুশ বিপ্লবের দর্পণ, ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯০৮, সাহিত্য প্রসঙ্গে, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ১৬-১৭।
২. ভ ই লেনিন, যুব লীগের কর্তব্য, ২ অক্টোবর ১৯২০, রচনা সংকলন, চার ভাগে সম্পূর্ণ, চতুর্থ ভাগ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা ১৭৫-১৭৬
৩. ভ ই লেনিন, রুশ কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) অষ্টম কংগ্রেসে প্রদত্ত পার্টি কর্মসূচির রিপোর্ট থেকে, ১৯ মার্চ, ১৯১৯, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৬৮; পৃষ্ঠা ৫১-৫২
৪. ভ ই লেনিন, মস্কোর পার্টি কর্মীদের সভায় পেটি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের প্রতি প্রলেতারিয়েতের মনোভাবের প্রশ্নে রিপোর্ট থেকে, ২৭ নভেম্বর, ১৯১৮, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, মস্কো, ১৯৬৮; পৃষ্ঠা ৩০-৩১
৫. ভ ই লেনিন, সোভিয়েত রাজের সাফল্য ও বিঘ্ন, ১৯১৯, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, মস্কো, ১৯৬৮; পৃষ্ঠা ৪৬
৬. প্রবন্ধটির অংশবিশেষ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন কমিটির প্রকাশনা সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শতবর্ষ স্মারক সংকলন, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১১৫-১২০ গ্রন্থে প্রকাশিত।

Leave a Comment

error: Content is protected !!