সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রসঙ্গে লেনিনবাদ বা লেনিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (ইংরেজি: Leninism on Cultural Revolution) হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির সাংস্কৃতিক কাজের আলোচনা। নতুন সমাজ নির্মাণে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভূমিকা নির্ধারণে এই আলোচনা হয়ে থাকে। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন সংস্কৃতি ও বিপ্লবী সংস্কৃতি প্রসঙ্গে যেসব মতামত প্রদান করেছেন তা থেকেই এই আলোচনার উদ্ভব হয়েছে।
সাংস্কৃতিক বিপ্লব হচ্ছে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্যে বহুমাত্রিক আলোচিত বিষয় যা পুরনো চিন্তাধারা বর্জিত নতুন সমাজ নির্মাণের শক্তি। এছাড়াও তিনি সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে প্রলেতারিয় সংস্কৃতি নির্মাণের কাজে লাগাতে চেয়েছেন। লেনিনের নিকট সাংস্কৃতিক বিপ্লব একটি রাজনৈতিক বিপ্লব, একটি রাজনৈতিক ঘটনা। তিনি এই বিপ্লবকে দেখেছিলেন মতাদর্শগত পুনর্গঠনের উপায় হিসেবে।
সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রসঙ্গে লেনিন
লেনিনের কাছে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের কাজ ছিল একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এজন্য তিনি সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজানোর কথা বলেছেন যা তার কাছে ছিল বিপ্লবী সংস্কৃতি। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন প্রলেতারিয় সংস্কৃতি আকাশ থেকে পড়ে না। সমাজতন্ত্র গড়তে হলে আমাদের বিভিন্ন উপাদান নিতে হবে যা পুঁজিবাদী সমাজে তৈরি হয়েছে। লেনিনের মতে প্রলেতারিয় সংস্কৃতি শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো কিছু নয়, এটি মানবজাতির জ্ঞানের ধারাবাহিক বিকাশ।[১]
লেনিনের কাছে বিপ্লবে সংস্কৃতির ভূমিকা হচ্ছে ‘স্বদেশের মেহনতি জনগণকে … গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উন্নীত করার জন্য’[২] আপ্রাণ চেষ্টা। রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও পুঁজিপতিদের চাপিয়ে দেয়া জুলুম, নিপীড়ন আর লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালায় সাংস্কৃতিক বিপ্লব।
এই বিপ্লবে সংস্কৃতি জড়িত সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের সাথে। লেনিন সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের জন্য কেবল প্রলেতারিয়েতের অগ্রবাহিনীর উপর নির্মাণ করার কথা বলেছেন। তিনি বুদ্ধিজীবীদের উপর কখনোই নির্ভর করতে বলেননি। লেনিন যখন বলেন, ‘আমরা জানি যে সমাজতন্ত্রের নির্মাণ সম্ভব কেবল বৃহৎ পুঁজিবাদী সংস্কৃতির উপাদান নিয়ে, আর বুদ্ধিজীবীরা হলো সেই রকম একটি উপাদান’; তখন তিনি পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের প্রতি মনোভাবের প্রশ্নে দ্বান্দ্বিকভাবে দেখতে চান। তিনি আরো বলেন,
“পুঁজিবাদ যাদের রেখে গেছে তেমন সব উপাদান নিয়ে আমরা রাষ্ট্রক্ষমতা গড়ে তুলছি। বুদ্ধিজীবীদের মতো পুঁজিবাদী সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে কাজে না লাগালে আমরা রাষ্ট্রক্ষমতা গড়ে তুলতে পারব না। বর্তমানে পেটি-বুর্জোয়ার সংগে আমরা এমন আচরণ করতে পারি যেন তারা রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণাধীন এক সৎ প্রতিবেশী।”[৩]
বিপ্লবে সংস্কৃতির ভূমিকা হচ্ছে আমলাতন্ত্রবিরোধী এক মহান সংগ্রাম। লেনিন এই বিষয়ে বারবার প্যারিস কমিউনের কথা বলেছেন। রুশ বলশেভিক পার্টির অষ্টম কংগ্রেসে প্রদত্ত পার্টি কর্মসূচির প্রতিবেদন থেকেও আমলাতন্ত্রের ক্ষতিকর দিক কীভাবে সোভিয়েত রাষ্ট্রকে অবনত করছে তা উল্লেখ করেন।
তথ্যসূত্র
১. এ বিষয়ে পড়ুন আমার সমাজতন্ত্র গ্রন্থের নিবন্ধ সাংস্কৃতিক বিপ্লব, ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৫, পৃষ্ঠা ৬১-৬৪
২. ভি আই লেনিন, ১২ ডিসেম্বর ১৯১৪, “বড় রুশীদের জাতীয় গর্ববোধ”, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, পৃষ্ঠা ২০।
৩. ভি আই লেনিন, ২৭ নভেম্বর ১৯১৮, “মস্কোর পার্টি কর্মীদের সভায় পেটি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের প্রতি প্রলেতারিয়েতের মনোভাবের প্রশ্নে রিপোর্ট থেকে”, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, পৃষ্ঠা ৩৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।