কুবলা খান বা স্বপ্নে একটি দৃষ্টি: একটি খণ্ড (ইংরেজি: Kubla Khan বা A Vision in a Dream: A Fragment) হচ্ছে স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ রচিত একটি কবিতা যেটি একটি অসমাপ্ত কবিতা বলে পরিচিত। কবিতাটি ইংরেজি কবিতায় রোমান্টিকতাবাদের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে ঘনঘন সংকলিত কবিতাগুলির মধ্যে একটি। কবিতাটির পাণ্ডুলিপির একটি অনুলিপি লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে স্থায়ীভাবে প্রদর্শিত হয়।
কুবলা খান সম্ভবত ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে লেখা হয়েছিল, যদিও সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষ প্রমাণের কারণে কুবলা খানের প্রথম রচনার সুনির্দিষ্ট তারিখ এবং পরিস্থিতি কিছুটা অস্পষ্ট। কোলরিজ সাধারণত তার কবিতার তারিখ রাখতেন, কিন্তু কুবলা খান কবিতায় তারিখ দেননি, এবং কবিতাটি সম্পর্কে সরাসরি তার বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠিতেও উল্লেখ করেননি।
কুবলা খান কবিতার সারমর্ম
অনেকে মনে করেন যে, তিনি Purchas, his Pilgrimage নামের একটি বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখার সময় তার বন্ধু বা কারো ডাকে ঘুম থেকে অসমাপ্ত একটি স্বপ্ন দেখে জাগ্রত হন। এরপরে তিনি সেই স্বপ্নের উপর ভিত্তি করে এই কবিতাটি রচনা করেন। যা হোক, এই কবিতার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো কুবলা খান নামের এক মোঙ্গলীয় সম্রাটের কাল্পনিক একটি প্রমোদ ভবন নির্মানের পরিকল্পনা।
কবিতাটিতে দেখা যায় জানাডুর সম্রাট কুবলা খান এমন একটি প্রমোদ ভবন বানাতে চান যা হবে একদম অদ্ভুত ও বিচিত্র। ফলে তিনি তাঁর জন্য একটি প্রমোদ ভবন নির্মাণ করার নির্দেশ দিলেন। তিনি তা করার জন্য দশ মাইল জায়গা নিতে বলেন। সেই জায়গাটা দেয়াল ও দূর্গ দিয়ে ঘেরাও করা থাকবে।
সেই দশ বর্গমাইল জায়গার মধ্যে থাকবে পবিত্র আল্ফ নদী প্রবাহিত। এই পাতাল নদীটি মাটির নিচ দিয়ে বয়ে চলে গিয়ে সাগরের যে জায়গায় সূর্যের আলো প্রবেশ করে না সেই জায়গার সাথে মিলিত হবে। এই দশ বর্গ মাইল এলাকায় থাকবে পাহাড়, থাকবে সমতল ঘাসবিস্তৃত ভূমি, থাকবে সুগন্ধি ফুলে নূয়ে পড়া গাছ-গাছালী। আরও থাকবে প্রচুর পরিমাণে সবুজ গাছ যে গাছগুলোর উপরে শেওলা পড়ে থাকবে। এগুলো দেখে মনে হবে কোনো পাহাড়ের মতো প্রাচীনকালে জন্ম নিয়েছিল এই গাছগুলো।
সবুজ বনানীর মাঝ দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেয়ে নামবে অনেকগুলো আঁকাবাকা ছোট ঝর্ণা। এই পাহাড়িয়া জায়গাটি দেবদারু বা সিডার গাছে আচ্ছাদিত থাকবে। সিডার গাছে ঢাকা পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসবে একটি আকর্ষণীয় ঝর্ণা। এই মোহনীয় স্থানটিতে ভয়ানক পরিবেশও বিরাজ করবে। এখানে পাহাড়িয়া বনের মাঝে এক নারীর বিলাপের ভূতুড়ে আওয়াজ শোনা যাবে যে নারী কোনো দানবের সাথে প্রেম করেছিল এবং সেই দানব তাকে একা ফেলে চলে গেছে। আর পাহাড়ি ঐ ঝর্ণাটি এঁকেবেঁকে চলবে। কোথাও পাহাড়ি ঢালে থেমে গিয়ে জল নিচে গড়িয়ে পড়বে আবার সেখান থেকে বয়ে চলবে তা। যেখানে পাহাড়ের উপর থেকে ঝর্ণার জল নিচে ছিটকে পড়বে সেখানে জলের সাথে গুড়ো গুড়ো, বড় বড় পাথরও ছিটকে পড়বে। যেভাবে শস্য মাড়াই করার সময় শস্য দানা ছিটকে পড়ে বা কুলোর বাতাসে তুষ ছিটকে পড়ে। কখনো জোরে কখনো ধীরে ছিটকে পড়বে জল। এটা দেখে মনে হবে পৃথিবী যেন ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস চালাচ্ছে আর জলের প্রবাহে একটি ছন্দের সৃষ্টি হয়েছে।
অবশেষে ঐ ঝর্ণার জল পাহাড়ের উপর থেকে জলপ্রপাতের সাথে একটি পবিত্র নদীতে গিয়ে পড়বে। আর এই নদীটি গিয়ে সাগরের এমন এক খাদের সাথে মিলিত হবে যে খাদের গভীরতা কেউ কখনো মাপতে পারবে না। ঐ নদীর জল দূর সাগরের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে। এরপর সাগর থেকে উঠে আসবে ঢেউ। সেই ঢেউয়ের শব্দে কুবলা খান তাঁর পূর্বপুরুষদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবেন। তারা তাকে ভবিষ্যদ্বাণীর মাধ্যমে ভবিষ্যতের যুদ্ধ সম্পর্কে সতর্ক করে দিবেন। আর তাঁর প্রমোদ ভবনের ছায়াটি গিয়ে পড়বে ঐ নদীর পবিত্র জলে। সেই নদীতে যে পবিত্র ঢেউ উৎপন্ন হবে তা পাহাড়ের গায়ে লেগে এক অদ্ভুত সুর সৃষ্টি করবে। তার ভবনটি নদীর কিনারেই থাকবে। আর এর মাঝে একটি কক্ষ থাকবে যা তুষারের মতো সাদা।
কুবলা খান কবিতা সম্পর্কে আলোচনা দেখুন ইউটিউবে
একদিন কবি স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ স্বপ্নে আবিসিনিয়ার একজন যুবতী নারীকে ডালসিমারে সুর তুলে গান গাই শুনেছিলেন। সে এবোরা পার্বত্য অঞ্চলের লোকগান গাইছিল। সেই গান ছিল মায়াবী ও মোহনীয়। কবি বলছেন যে, যদি তিনি সেই সুর শিখতে পারতেন তবে সেই সঙ্গীতের যাদুর পরশে তিনি এমন একটি প্রমোদভবন বাতাসের মাঝেই নির্মাণ করতে পারতেন, নির্মাণ করতে পারতেন সেই রৌদ্রোজ্জ্বল গম্বুজ, তুষার শুভ্র কক্ষটিও। আর তিনি যখন প্রমোদ ভবনটি নির্মাণের জন্য সে সুর বাজাতে শুরু করতেন তখন তার চোখ দুটা জ্বলজ্বল করত, চুলগুলো বাতাসে ভাসত। আর এই দৃশ্য দেখে সবাই ভয়ে কেঁপে উঠত। চিৎকার করে করে তারা একে অন্যকে সাবধান করত। পুরোহিতরা এসে বলত যে, হয়তো কবিকে ভূতে ধরেছে। তাই তারা মন্ত্রপুত করে কবির চারিদিকে তিনটি বৃত্ত আঁকত। ভয়ের সাথে সবাইকে চোখ বন্ধ করে থাকতে বলত। কারণ হয়তো কবি মধু-শিশির ও স্বর্গীয় সুধা পান করে থাকবেন।[১]
তথ্যসূত্র
১. কল্যাণী ব্যানার্জী সম্পাদিত ও সৈয়দ আহমেদ রুবেল অনূদিত, নির্বাচিত ইংরেজি রোমান্টিক কবিতা, দি বুক সেন্টার, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুলাই ২০১৬, পৃষ্ঠা ২১৭-২১৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।