কঙ্ক ছিলেন মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি

মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি কঙ্ক কেন্দুয়া উপজেলার, বিপ্রগ্রাম [প্রাচীন বিপ্রবর্গ] জন্মগ্রহণ করেন। পিতা- গুণরাজ ।

জন্ম ও শৈশব

কবি কংকই বাংলা সাহিত্যে ‘সত্যপীরের পাঁচালি’ কাব্যের আদি রচয়িতা। রাজেশ্বরী নদীর তীরে কেন্দুয়ার নিকটবর্তী বিপ্রগ্রামের ব্রাহ্মণ বংশ-জাত কবি কংক মাত্র ছয় মাস বয়সে পিতৃমাতৃহীন হয়ে মুরারি ও কৌশল্য নামক এক চণ্ডাল দম্পতির ঘরে লালিত-পালিত হন এবং তাদেরই প্রদত্ত কংকধর বা কংক নামে পরিচিত হন । চণ্ডালিনী কৌশল্যার স্তন্যরসে বড় হয়ে ওঠা কবি কংকের বয়স যখন মাত্র পাঁচ বৎসর, তখন আকস্মিকভাবে তাঁর পালক পিতা-মাতা মুরারি ও কৌশল্য মৃত্যুবরণ করেন । তখন গর্গ নামের এক মহাপণ্ডিত ব্রাহ্মণ চণ্ডালিনী কৌশল্যার শ্মশান হতে কংককে নিজ গৃহে নিয়ে আসেন। পণ্ডিত গর্গের স্ত্রী পুত্রহীনা গায়ত্রী দেবী কংককে পেয়ে খুব খুশি হন । এই ব্রাহ্মণ দম্পতির গৃহে আশ্রয় লাভের পর কংক মাঠে গর্গের ধেনু চরাতেন ।

পড়াশুনা ও প্রতিভার বিকাশ

বাল্যকাল থেকেই কংকের মধ্যে কবি প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। কোমল স্বভাব, সুদর্শন ও বুদ্ধিমান কংক মুখে মুখে শ্লোক রচনা করতে পারতেন। শিশুটির এরূপ অনন্য সাধারণ প্রতিভার পরিচয় পেয়ে গর্গ তাঁকে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন। দশ বৎসর বয়স থেকেই কংক লেখাপড়া করেন। গর্গের ঔরসজাত কন্যা লীলা এবং তাঁর আশ্রিত ব্রাহ্মণপুত্র কংক এক সঙ্গে বড় হন এবং এর ফলে উভয়ের মধ্যে গভীর অনুরাগ ও নিবিড় প্রণয় গড়ে ওঠে। কাব্যপ্রতিভার পাশাপাশি কংক ছিলেন চমৎকার বংশীবাদক। তাঁর বাঁশির মধুর সুরের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন গর্গকন্যা লীলা । মাঠে গরু চরাতে চরাতে কঙ্ক যখন বাঁশি বাজাতেন বাড়িতে বসে মুগ্ধ লীলা তা তন্ময় হয়ে শুনতেন । এভাবে যখন তাঁদের মধ্যে নিবিড় নৈকট্য গড়ে ওঠে।

কঙ্ক-এর সাহিত্যকর্ম

তাঁর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থ ১. বিদ্যাসুন্দর, ২. মলুয়ার বারমাসী। ‘বিদ্যাসুন্দর’ চৈতন্য-সমকালীন রচনা বলে অনেকে মনে করেন। বিদ্যাসুন্দর একটি ছোটখাট সত্যনারায়ণের পাঁচালি । শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক কবি কংকের বিদ্যাসুন্দরই বাংলা বিদ্যাসুন্দর কাব্যের প্রথম গ্রন্থ । কবি কংক রচিত ‘বিদ্যাসুন্দর’ তৎকালীন কাব্যধারার ব্যতিক্রম বলে সাহিত্য-ইতিহাসে স্বীকৃত। এই কাব্যে কালিকার পরিবর্তে সত্যনারায়ণের মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে এবং বহু স্থানে চৈতন্যদেবের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশিত হয়েছে।

‘বিদ্যাসুন্দর’ ড. দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদিত বিখ্যাত ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র একুশটি পালাগানের অন্যতম । কবি কংকের ‘মলুয়ার বারমাসী’ও একটি সুন্দর ও অনবদ্য রচনা। গর্গকন্যা লীলা ও কবি কংকের জীবনকাহিনী ও তাঁদের প্রণয়-আখ্যান অবলম্বন করে স্থানীয় কবি রঘুদাস, দামোদর, শ্রীনাথ বানিয়া ও নয়নচাঁদ ঘোষ যৌথভাবে ‘কংক ও লীলা’ নামে একটি পালা রচনা করেন । কবি কংক ও তাঁর প্রেমিকা লীলার মর্মন্তুদ কাহিনী নিয়ে রচিত এই ‘কংক ও লীলা’ পালাগানটিও ড. দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদিত ময়মনসিংহ গীতিকার অন্যতম পালাগান ।

কবিত্বের প্রকাশ

এর মাঝেই হঠাৎ করে কংকের জীবনে এক আকস্মিক পরিবর্তন আসে । এক মুসলমান সাধক-ফকির কংকের কণ্ঠে সুমধুর গীত শুনে চমকে ওঠেন। কংকও সাধক-ফকিরের মাহাত্ম্য দেখে তাঁর সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই পীর-ফকিরই কংককে সত্যপীরের পাঁচালি রচনা করার নির্দেশ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান । কংক তাঁর গুরুর আদেশে ‘সত্যপীরেরপাঁচালি’ রচনা করেন। এর পর পরই রাখাল কংক খুব দ্রুত ‘কবি কংক’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। চারদিকে কবি কংকের গুণের কথা ছড়িয়ে পড়ে।

কঙ্ক-এর ভবঘুরে জীবন

এদিকে মুসলমান পীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে ঈর্ষাপরায়ণ ব্রাহ্মণেরা তাঁর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এমনকি তাঁর আশ্রয়দাতা গর্গও তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হন। বিষ প্রয়োগে অথবা অন্য কোন উপায়ে কবি কংককে মেরে ফেলার জন্যেও ব্রাহ্মণগণ বড়যন্ত্র করেন। গর্গ নিজেও এই ষড়যন্ত্রে জড়িত হন। তাঁর প্রণয়ী গর্গকন্যা লীলার কাছে তাঁকে হত্যা করার এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে কবি কংক সেখান থেকে পালিয়ে যান। প্রতিহিংসা পরায়ণ ব্রাহ্মণগণ কংকের সন্ধানে বিভিন্ন স্থানে লোক প্রেরণ করেও তাকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন।

এদিকে দেশে দেশে ঘুরে ঘুরে কবি কংক সত্যপীরের পাঁচালি কীর্তন করেন। তাঁর সত্যপীরের পাঁচালি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। ময়মনসিংহ অঞ্চলে এ গ্রন্থ যুগ যুগ ধরে খুবই জনপ্রিয় ছিল । কথিত আছে যে, প্রেমিক কংকের অবর্তমানে গর্গকন্যা লীলা শোকে দুঃখে মৃত্যুবরণ করেন। এও কথিত আছে যে, লীলাকে দাহ করার সময় আকস্মিকভাবে কংকের আবির্ভাব ঘটে।

আরো পড়ুন

শেষ জীবনে কংক পুরীধামে গিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। উড়িয়া হরফে বাংলা ভাষায় লেখা কবি কর্ণের ‘সত্যপীরের পাঁচালি’ নামে একখানি পুঁথি পাওয়া যায়। এই কবি কর্ণ ও কবি কংক একই ব্যক্তি বলে অনেকে মনে করেন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!