পাশ্চাত্যে ও ভারতে নাটকের ইতিহাস শুরু হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব সময়ে

পাশ্চাত্যের নাটকের ইতিহাস (ইংরেজি: History of Drama) সম্পর্কে বলা যায় যে পাশ্চাত্য নাটকের উদ্ভব হয়েছে ধ্রুপদী গ্রিসে। ভারতীয় নাটকের প্রথম দিকে ছিল সংস্কৃত নাটক। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে ভারতের ইতিহাসে আপেক্ষিক শান্তির সময়কালে সেখানে শত শত নাটক লেখা হয়েছিল।

মানুষের জীবন সরল রেখায় শান্ত স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে প্রবাহিত হয় না। এ ধরনের জীবন থাকলেও তা নাটকীয়তা বর্জিত। মানুষের জীবনের ছন্দ ভাঙ্গা গড়ার মধ্য দিয়ে প্রবহমান। দুর্ভোগ, যন্ত্রণা, বিক্ষোভ, অশান্তি প্রভৃতির আকস্মিক আঘাতে মানুষের জীবনে গতি ও বৈচিত্র্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। জীবনের এই গতি ও বৈচিত্র্যকে শিল্পে ধারণ করার প্রয়োজন থেকেই নাটকের উদ্ভব।

সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিক বা রূপের মধ্যে নাটক কবিতার মতোই প্রাচীন। ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রে নাটককে কবিতারই একটি ‘দৃশ্য কাব্য’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সেখানে কবিতাকে বলা হয়েছে ‘শ্রাব্য কাব্য’। সংস্কৃত আলংকারিকগণ নাটককে সব রকম কাব্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করে বলেছেন — ‘কাব্যেষু নাটকং রম্যাম’। প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যতাত্ত্বিক এরিস্টটলের পোয়েটিকস বা কাব্যতত্ত্ব গ্রন্থে প্রধানত নাটকেরই বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। সময়ের বিবর্তনের সংগে সংগে মানুষের রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নাটকের রূপ ও রীতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন অনিবার্য করে তুলেছে। কিন্তু নাটকের মৌলিক উপকরণ — অভিনেতা, অভিনেত্রী, মঞ্চ এবং দর্শক শ্রোতা অভিন্নই রয়ে গেছে।[১]

বাংলা নাটকের ইতিহাস 

উপন্যাস ও ছোটগল্পের মতো বাংলা নাটকেরও সূত্রপাত উনবিংশ শতাব্দীতে। কিন্তু নাটকের ঐতিহ্য ও সূত্র বাঙালি জীবনে আদিকাল থেকেই ছিলো। যাত্রা, পালাগান, কবিগান এমনকি মঙ্গলকাব্যগুলোর মধ্যেও নাট্যরীতির যথেষ্ট নিদর্শন বিদ্যমান। উনিশ শতকে ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসার ফলে সচেতনভাবে বাংলা নাটক রচনা ও মঞ্চায়ন শুরু করে। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু এর বেশ আগে থেকেই বাংলা ভাষায় নাটক রচনা ও মঞ্চস্থ হতে শুরু করে। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয় যোগেন্দ্র চন্দ্রগুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’ এবং তারাচরণ সিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার নতুন বাজারে রামজয় বসাকের বাড়িতে অভিনীত হয় রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’।

বাংলা ভাষার প্রথম পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য নাট্যকাররা হলেন মাইকেল মধুসদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) অমৃতলাল বসু (১৮৫৩-১৯২৯), গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১১), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৬) প্রমুখ। মাইকেল মধুসূদনের ‘রত্নাবলী’ নাটক ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বেলগাছিয়া নাট্যশালায় অভিনীত হয়। তাঁর মঞ্চস্থ নাটকগুলোর মধ্যে ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৮), ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১), ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৫৯) উল্লেখযোগ্য। বাংলা নাটকের সমৃদ্ধি ঘটে মীর মশাররফ হোসেন, ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ নাট্যশিল্পীদের হাতে। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা নাটকের গতি ও ঐশ্বর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পায় নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর চেষ্টায়। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৯২-১৯৬১), শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭০) এবং বিজন ভট্টাচার্য (১৯১৫-১৯৭৭) পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলা নাটকে বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব আনেন। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় মঞ্চায়িত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা নাটক এক নতুন জগতে প্রবেশ করে।

বাংলাদেশের নাটক 

অন্যান্য সাহিত্য-আঙ্গিকের মতো বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাস তার স্বতন্ত্র যাত্রাপথ চিহ্নিত করে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এ-ভূখণ্ডের স্বতন্ত্র জীবনরুচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা-রূপায়ণে দেশবিভাগ-পূর্বকাল থেকেই যাঁরা নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন তাঁদের মধ্যে শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫) ইব্রাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৯), আকবরউদ্দীন (১৮৯৫-১৯৭৮), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), শওকত ওসমান (১৯১৮-১৯৯৮) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এঁদের হাতেই বাংলাদেশের নাটকের স্বতন্ত্র ভিত্তি তৈরি হয়। 

১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর যাঁরা নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন তাঁদের মধ্যে নূরুল মোমেন (১৯০৮-১৯৮৯), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১), মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১), আসকার ইবনে শাইখ (জন্ম-১৯২৫) উল্লেখযোগ্য। নুরুল মোমেনের ‘নেমেসিস’ (১৯৪৮) ও ‘নয়াখান্দান’ (১৯৬২), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘বহিপীর’ (১৯৬০) ও ‘তরঙ্গভঙ্গ’ (১৯৬৪); মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ (১৯৬২), ‘বিধি’ (১৯৬৬), ও ‘কবর’ (১৯৬৬) বাংলা নাট্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে কালজয়ী সংযোজন হিসেবে বিশিষ্ট। এছাড়া জসীমউদদীন, আজিমউদ্দীন আহমদ, রাজিয়া খান, আবদুল হক, সৈয়দ মকসুদ আলী, ফররুখ আহমদ, আনিস চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মমতাজউদ্দিন আহমদ বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক-নিরীক্ষার বাংলাদেশের নাটককে বহুগুণে সমদ্ধ করেছেন। 

স্বাধীনতা-উত্তরকালে (১৯৭১-১৯৯৯) পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিক থেকে নাটক যে সাফল্য অর্জন করেছে, গুণ ও মানবিচারে তা অন্যান্য সাহিত্য-শাখাগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। স্বাধীনতার অব্যবহিত-পূর্বে যারা নাটক রচনা শুরু করেন, স্বাধীনতার পর তাঁদের হাতেই বাংলাদেশের নাটক সমৃদ্ধি লাভ করে। নাটকের বিষয়ভাবনা প্লটবিন্যাস এবং চরিত্রচিত্রণের ক্ষেত্রে এই সব নাট্যকারগণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেন। মমতাজউদ্দিন আহমদ এবং সাঈদ আহমদ এ-ক্ষেত্রে স্মরণীয় নাট্যকার। স্বাধীন বাংলাদেশের নাটক যাঁদের সাধনা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন, সেলিম আল দীন, মামুনুর রশীদ, সৈয়দ শামসুল হক এবং জিয়া হায়দারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বস্তুসংক্ষেপ:

নাটকে ঘটনা, চরিত্র, চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, আচার-আচরণ উচ্চারিত সংলাপের মাধ্যমে রূপ লাভ করে। এক্ষেত্রে বিষয়বস্তু, পাত্র-পাত্রী এবং দর্শকের যৌথ উপস্থিতিতে এটি হয়ে ওঠে সমবায়িক শিল্প। মানুষের জীবন সরলরেখায় শান্ত-স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে প্রবাহিত হয় না। এ-ধরনের জীবন থাকলেও তা নাটকীয়তা বর্জিত। মানুষের জীবন ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে প্রবহমান। দুর্ভোগ, যন্ত্রণা, বিক্ষোভ, অশান্তি প্রতির আকস্মিক আঘাতে মানুষের জীবনে গতি ও বৈচিত্র্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। জীবনের এই গতি ও বৈচিত্র্যকে শিল্পে ধারণ করার প্রয়োজন থেকেই নাটকের উদ্ভব।

তথ্যসূত্র

১. আবুল ফজল ও রেজাউল ইসলাম, সাহিত্য তত্ত্ব-কথা, দুরন্ত পাবলিকেশন, ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ ২০০৯, পৃষ্ঠা ৩১।
২. বেগম আকতার কামাল, ভীষ্মদেব চৌধুরী, রফিকউল্লাহ খান ও অন্যান্য, বাংলা ভাষা: সাহিত্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, পুনর্মুদ্রণ ২০১১, পৃষ্ঠা ৩৫-৩৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!