ছিন্নপত্র তুলে ধরে উনিশ শতকের বাঙলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন

ছিন্নপত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয় পত্রসাহিত্য, মনোযোগের সাথে তুলে ধরেছে উনিশ শতকের বাঙলাদেশের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন ও সেই জীবনের বহু দিক। বাংলার তৎকালীন প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষ; অতি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নাম উল্লেখহীন রবীন্দ্রনাথের পরিচিত-অপরিচিত মানুষ, কিন্তু সেইসব মানুষের পরিপূর্ণ পরিচয় আমরা কখনোই পাই না; কিছু পরিচয় তিনি ইচ্ছে করেই দেন না।

রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনটিই দেখেন, কিন্তু তাদের উপরে হাজার বছর ধরে চলে আসা শোষণটি ও তার কারণটিকে দেখেন না; বেশিরভাগ সময় সাধারণ মানুষদের জীবনটি দেখেন কল্পনার রঙে রঙিন করে। ফলে চাষাদের ও গ্রাম্য মেয়ে কূলবধূদের যে বর্ণনা দেন তা হয়ে দাঁড়ায় এক রোম্যান্টিক কবির কল্পনার আতিশয্যে ভরপুর চমৎকার শব্দে সাজানো চমৎকার বর্ণনা। কিন্তু এর গভীরে যে অনাহার, কষ্ট, যাতনা, শোষণ তা ফুটে উঠে না; ফলে অন্ধকারে বরকন্দাজের ডাক শোনা যায়, বেহারা বিজাতীয় ভাষা বোঝা যায় না, যাদের ঘাড়ে চেপে তিনি চলেছেন তাদের বাড়ি ঘর জন্ম কোথায় তা জানার প্রয়োজনও তিনি বোধ করেন না।

তিনি দেখেন ছোকরা মাঝি ডিঙ্গিতে গান গাইছে, তিনিও তার গান শুনে গোটা পৃথিবী দেখতে চান। আবার যখন অনেকগুলো ছোকরা ঝপঝপ শব্দে দোলে এবং সেই তালে গান গায়, ‘যোবতি, ক্যান কর মন ভারি/ পাবনা থ্যাকে এনে দেব ট্যাকা দামের মোটরি’ তখন এই গান শুনে কবির লজ্জা লাগে। তিনি ভাবেন এ অঞ্চলের মানুষ বেশ সুখে আছে। হয়তোবা সেই সুখ ছিলোও কারণ শত অভাবেও মানুষ গান গায়, কারণ গানই অভাবি মানুষের জীবন।

ছিন্নপত্রে আছে নারী, বিশেষভাবে তিনি যাদেরকে বলছেন মেয়ে, যারা কাপড় কাচছে, জল তুলছে, স্নান করছে এবং উচ্চস্বরে বাঙাল ভাষায় হাস্যালাপ করছে, যারা অল্পবয়সি মেয়ে তাদের জলক্রীড়া আর শেষ হয় না।…. পুরুষরা গম্ভীরভাবে এসে গোটাকতক ডুব মেরে তাদের নিত্যকর্ম সেরে চলে যায়; কিন্তু কবির কল্পনা লাগাম ছাড়িয়ে বর্ণনা করে চলে,

“মেয়েদের যেন জলের সংগে বেশি ভাব, পরস্পরের যেন একটা সাদৃশ্য ও সখিত্ব আছে”।

৬২ নং চিঠি থেকে জানা যায় পোস্টমাস্টার গল্প লেখার পটভূমি। সাজাদপুরের কুঠিবাড়ির একতলাতে একটা পোস্ট অফিস ছিলো, সেই অফিসে তিনি এক পোস্টমাস্টারকে প্রতিদিন দেখতেন এবং তখনই একদিন দুপুরবেলায় তিনি পোস্টমাস্টার গল্পটি লিখেছিলেন।[১]

ছিন্নপত্র গ্রন্থে মানুষের জীবন তুলে ধরতে গিয়ে তিনি দেখতে পাচ্ছেন, এক এক সময় এক একটি সরল ভক্ত বৃদ্ধ প্রজা আসে, তাদের অকৃত্রিম ভক্তিতে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি দেখেন এই জীর্ণ শীর্ণ কুঞ্চিত বলিত বৃদ্ধ দেহখানির মধ্যে একটি শুভ্র সরল কোমল মন রয়েছে; তিনি তুলনা করেন শিশুদের মনে কেবল সরলতা আছে, কিন্তু এমন স্থির বিশ্বাসপূর্ণ একাগ্রনিষ্ঠতা নেই। তিনি দেখেন জনপদবধূরা তাঁর সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে; এক বালিকাবধূ শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে তাকে বিদায় দিতে এবং অনেকগুলো কচি ছেলে, অনেকগুলো ঘোমটা, ও অনেকগুলো পাকাচুল এই উপলক্ষে একত্রিত হয়েছে। কবি শুধু ঘোমটা ও পাকাচুল দেখেন, তারাও যে আর দশজন নারী ও মানুষ—সেকথা উল্লেখ করেন না, কারণ তারা হয়তো ইংরেজ-সাহেব-মেম বা তাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন।

দশ বছর সময়ের ভেতরে লেখা ছিন্নপত্রে ইংরেজ সাহেব-মেমরা চা-বিস্কুট কান্ট্রি সুইটস ভালোবাসে এ খবর পাই; কিন্তু গ্রামের কৃষকেরা কে কী খায়, কবার খায়, কোন বছর বন্যা বা খরা হলো, কোন বার ফসল ভালো হলো সে খবর পাই না। আমরা খবর পাই না বাঙালি কৃষকেরা কী কারণে এতো রাজভক্ত, কী কারণে কৃষক-প্রজারা অনেক দুঃখ ধৈর্য্য সহকারে সহ্য করে, কিন্তু এদের ভালোবাসা কোনো কিছুতেই ম্লান হয় না। এরকম কৃষকদের সরলতা তিনি দেখছেন, সেইসাথে পূর্ববঙ্গে এসে তিনি সমাজ ও অভাব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। যেমন তিনি এক চিঠিতে লিখেছেন,

“আমার এই দরিদ্র চাষি প্রজাগুলোকে দেখলে আমার ভারি মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মতো নিরুপায়। সোসিয়ালিস্টরা যে সমস্ত পৃথিবীময় ধনবিভাগ করে দেয় সেটা সম্ভব কি অসম্ভব জানি নে_যদি একেবারেই অসম্ভব হয় তবে বিধির বিধান বড়ো নিষ্ঠুর, মানুষ ভারি হতভাগ্য।”[২]

যদিও সেই সময়ে তাঁর প্রবন্ধ ক্যাথলিক সোসিয়ালিজম এবং সোসিয়ালিজম প্রবন্ধ দুটিতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। আর বছর দশেক পরেই রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় আমরা বড় পরিবর্তন দেখবো এবং বুঝবো যে তিনি কৃষকের দারিদ্র সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠেছেন।

ছিন্নপত্র বইতে প্যারিসের জটিল সভ্যতার সংগে কালিগ্রামের সরল চাষী প্রজাদের সরলতা বহু রকমের মানুষের জীবন তিনি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন; সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সরলতাই মানুষের স্বাস্থ্যের একমাত্র উপায়, সে যেন গঙ্গার মতো, তার মধ্যে স্নান করে সংসারের অনেক তাপ দূর হয়ে যায়; অথচ ইউরোপ সমস্ত তাপকে লালন করে নিজেকে রাত দিন উত্তেজিত করে তুলছে। কবি বলেছেন যতক্ষণ না সভ্যতার মাঝখানে এই স্বচ্ছ সরলতার প্রতিষ্ঠা হয় ততক্ষণ সভ্যতা কখনোই সম্পূর্ণ ও সুন্দর হবে না। শুনতে চমৎকার হলেও কী পথে এই সরলতার বিজয় হবে তা তিনি বলেন না।

কটকে থাকাকালিন ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ তে কবি একটি চিঠি লেখেন যেখানে মহামানুষের জন্য তার হাহাকার প্রকাশ পেয়েছে। তিনি লিখেছেন যে দশ-বিশ ক্রোশের মধ্যে কথা বলে প্রাণ সঞ্চয় করা যায় এমন একজন লোকও পাওয়া যায় না। সমস্ত মানুষগুলো যেন উপছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাচ্ছে-দাচ্ছে, আপিস যাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে, তামাক টানছে আর নিতান্ত নির্বোধের মত বকর বকর করছে। ঠিক যেন অবিকল ২০০৮ সালের বাংলাদেশের সব শহরের চিত্র।[৩]

তথ্যসূত্রঃ

১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২৯ জুন ১৮৯২, ছিন্নপত্র, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীকে লেখা ৬২ নং পত্র, রবীন্দ্রসমগ্র খণ্ড ২২, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৬৬৩।
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১০ মে ১৮৯৩, ছিন্নপত্র, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীকে লেখা ৯৫ নং পত্র, রবীন্দ্রসমগ্র খণ্ড ২২, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৬৯৯।
৩. প্রবন্ধটি শফিকুল কাদির সম্পাদিত ‘অর্ঘ্য’ ছোটকাগজে প্রকাশিত। এছাড়াও প্রাণকাকলিতে প্রকাশিত হয়েছিল ৩০ জানুয়ারি, ২০১৩ তারিখে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!