লোককথা বা লোককাহিনি বা লোক কাহিনী (ইংরেজি: Folktale) হচ্ছে লোকবিদ্যা বা লোকাচারবিদ্যার (folklore) একটি ধরন যা সাধারণত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মৌখিকভাবে কথা, কিসসা বা গপ নিয়ে গঠিত হয়।
গল্প বলা বা শোনার রীতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। আমরা ছোটবেলা থেকে ঠাকুমা, দিদিমাদের মুখে মুখে গল্প শুনে আসছি। এই ট্রাডিশন প্রাচীন যুগ থেকে তথা আদিম যুগ থেকে প্রচলিত। তাই লোক কথায় আবেদন বহু প্রাচীন। এই লোক কথা লোক সাহিত্যের একটি উৎকৃষ্ট উৎপন্ন যা লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে।
আশুতোষ ভট্টাচার্য (F O L K – TA L K ) শব্দটির প্রতিশব্দ হিসাবে ‘লোক কথা’ শব্দটি ব্যবহার করেন এবং দিন যত এগিয়েছে তত লোক কাহিনী, লোক গল্প প্রভৃতি শব্দ যুক্ত হয়েছে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে আজও সাধারণ মানুষ বা বিভিন্ন সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা বা শুনে আসা কাহিনীকে কিসসা বা কেচ্ছা কাহিনী বলে থাকে। শুধু বাংলা বলবো কেন, সুদূর আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা প্রভৃতি স্থানে ও এই লোকগল্প কথা বা লোক কাহিনী যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।[১]
তবে বলা যেতে পারে যে লোক কথা বা লোক কাহিনী বংশানুক্রমিক ভাবে প্রাপ্ত সম্পদ। লিখিত বা মৌখিক গদ্যের ভাষায় লোক কথা প্রকাশ করা হয়। ইতিহাস, পুরাণ, বিভিন্ন ধর্মীয় ভাবাদর্শ, রূপকথা লৌকিক ঘটনা ধারা অবলম্বনে লোককথা রচিত হয়।
লোককথা বা লোক কাহিনীর প্রকারভেদ
লোককথায় বা লোক কাহিনীকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে –
(ক) রূপকথা
রূপকথা, রূপকথার গল্প, আশ্চর্য গল্প, যাদু গল্প, পরির গল্প বা Märchen (ইংরেজি: Fairy tale) হচ্ছে একটি লোককাহিনী ঘরানার একটি উদাহরণ যা একটি ছোট গল্পের রূপ গ্রহণ করে। রূপকথা শব্দের ইংরেজি হচ্ছে Fairy tale। রূপকথার মধ্যে রাজা, রাণী, রাজকন্যা, পরী, রাক্ষস, ক্ষোকস প্রভৃতি কাহিনী থাকে। রাজতন্ত্রের সময় কাল থেকে সম্ভবত রূপকথার সৃষ্টি হয়েছে বলে ধরা হয়ে থাকে। তবে পরবর্তী কালে এর সাথে বণিক বা সওদাগরের কথা যুক্ত হয়েছে। যখন উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সদভাব ছিল, শ্রেণিচেতনা তখন এতটা প্রকট ছিল না। সেই সময় থেকে এই রূপকথার সৃষ্টি বলে ধরা যেতে পারে।
মূল নিবন্ধ: রূপকথা বা পরির গল্প
রূপকথার গল্পের কাহিনী কায়ার কখনো মালীপুত্র রাজকন্যাকে বিবাহ করছে বা ঘুটে কুড়ানী রাজার ছেলেকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছে। অর্থাৎ শ্রেণি চেতনা তখন খুব একটা প্রকট ছিল না ধরা যেতেই পারে। বাংলার রূপকথার ন্যায় সব সময় বীর, সাহসী, অদম্য উৎসাহ সে সমস্ত অসম্ভবকে সম্ভব করে ছাড়ে। ন্যায় অন্যায়ের সংঘাতে এই রূপকথাগুলি সমৃদ্ধ।[২]
(খ) রোমাঞ্চ কাহিনি:
আলিফ – লায়লার কাহিনি, বোক্কাচিওর গল্প, ডেকামেরনের গল্প প্রভৃতি এই পর্যায়ে পড়ে।
(গ) বীর কাহিনি:
এই পর্যায়ের গল্পে নায়কেরা অসম্ভবকে তথা অতি প্রকৃত শক্তি সমূহকে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়। যেমন – হারকিউলিসের গল্প।
‘লোকপুরাণ’ বা ‘মিথ’ থেকেই সময়ের বিবর্তনে তৈরি হয়েছে ‘টেল’ (বা ‘কথা’) যাতে মিথ-সম্পৃক্ত ধর্ম ও অলৌকিকতার ভাগ কমে এসে মুখ্য হয়ে উঠেছে প্রচলিত লোকজীবনের পরিচিত ছবিগুলি। তাই ‘মিথের মূল ভিত্তি ধর্ম ও দেবতা হলেও, তার বিবর্তিত রূপ ‘টেল’-এ মানুষ ও তার সামাজিক সংস্কারই প্রধান। তবে মানুষের সহজাত অলৌকিকতায় প্রতীতি তার মধ্যেও বিম্বিত হয়ে থেকেছে।
(ঘ) স্থানিক কাহিনি:
লোক বিশ্বাস সংস্কৃত এই কাহিনীগুলি অসম্ভরের মাত্রাকে স্পর্শ করে। এই সবগল্পের নায়ক বা ভূত প্রেত প্রভৃতি অবিশ্বাসী শক্তিকে পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এর ভীত্তি ভূমিতে আছে আঞ্চলিক লোক বিশ্বাস ও সংস্কার।
(ঙ) পুরাণ কাহিনী:
ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মাচারের সাথে জড়িত যে সব লোককাহিনী সৃষ্টি হয় তা পুরাণ কাহিনী হিসাবে বর্ণিত হয়। কাহিনীতে সৃষ্টির লীলা রহস্য যেমন লুকায়িত থাকে, তেমনি দেবতা সুলভ নায়কের উৎপত্তির কথাও এখানে বর্ণিত থাকে।
মূল নিবন্ধ: মিথ বা পুরাণ
লোককথার অন্তর্গত গুরুত্বপূর্ণ প্রকরণগুলোর মধ্যে মিথ বা পুরাণই হচ্ছে প্রাচীনতম। প্রাচীন পূর্বপুরুষদের নানান অভিজ্ঞতার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছিল না সে যুগে। সেই অব্যাখ্যাত অভিজ্ঞতাগুলির বর্ণনামূলক যে মৌখিক কাহিনিগুলি গড়ে উঠেছে সেগুলিই হলো আদিম মিথ। প্রাক কৃষিবিজ্ঞান যুগের মানসিকতায় রচিত এই কাহিনিগুলির ভিত্তিভূমি অলৌকিকের ওপর বিশ্বাস এবং একক নয় গোষ্ঠীগত প্রয়াসে এগুলি গড়ে উঠত। এই কাহিনীগুলির সঙ্গে প্রাচীনকালের ধর্মবিশ্বাসের সংযোগও ছিল গভীরভাবে।
(চ) নীতিগল্প বা নীতিকাহিনী:
নীতিগল্প বা নীতিকাহিনী বা নীতিকথা (ইংরেজি: Fable) হচ্ছে রূপকথার একটি ধরন যাতে জীবজন্তুর গল্পের মাধ্যমে যখন নীতি বা আদর্শের কথা সংযোজিত হয়। নীতি কাহিনী মূলক গল্পের উদাহরণ হচ্ছে ঈশপের গল্প, পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ প্রভৃতি।
মূল নিবন্ধ: নীতিগল্প
এই সব নীতিকাহিনীর বেশির ভাগই যখন প্রথম বলা হয়েছিল, তারপর বহু শতাব্দী পার হয়ে যাবার পরে সংকলিত হয়। যারা কাহিনী বলেছে তারা তাদের পছন্দমত, তাদের ইচ্ছানুসারে এদিক ওদিক বাড়িয়ে নতুন কিছু যোগ করে নতুন রূপ দিয়েছে। কাহিনীগুলো যত পুরোনো হয়েছে, ততই বেশি মনোগ্রাহী হয়েছে, আর তাদের শিল্পগুণও বেড়েছে। শত শত বছর ধরে লোকেরা মেজে ঘসে তুলির নানা টানে এসব উপকথা রূপকথাকে একেবারে নিখুঁত করে তুলেছে এসব কাহিনীকে।
(ছ) কিংবদন্তী:
যেহেতু মানুষের মনের অবচেতনে পরবর্তীকালীন ক্রমবর্ধমান বিজ্ঞান মনস্কতার যুগেও অলৌকিকের প্রতি আকর্ষণ ও আস্থা থেকেই গেছে তাই ধর্ম-দেবতা প্রভৃতি থেকে মুক্ত ‘টেল’-এর সঙ্গে আবারও যুক্ত হতে থাকে অলৌকিক ক্ষমতা, অসাধারণত্বের প্রতি বিশ্বাস অর্থাৎ একটি নতুনমাত্রার ঐশীভাব। কিন্তু এই ঐশীভাব ‘মিথ’-এর মতো দেবতা বা ধর্মসম্পৃক্ত নয়—বরং কোনো অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের বা আপাতভাবে অব্যাখ্যেয় ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গড়ে তোলে টেল-এর বিবর্তিত রূপ ‘লিজেণ্ড’ তথা কিংবদন্তী । অর্থাৎ এতে অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী মানুষের ওপর আরোপিত হয় অলৌকিকত্ব। স্থান বা ঘটনাও সেই অসাধারণত্ব অর্জন করে বহু সময়ে। পশুকথা, রূপকথা, রসকথা, ব্রতকথা, প্রভৃতি নানা বর্গে লোককথাগুলিকে বিভক্ত করা হয় ।
(জ) হাস্যরসাত্মক কাহিনী:
লোক ঠকানোর উদ্দেশ্য হাস্যরসাত্মক লোক কাহিনীগুলি রচিত হয়। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র এই হাসি কৌতুকের লোক কাহিনী প্রচলিত। ঐ ধারায় শ্রেষ্ঠ সংযোজন – “গোপাল ভাঁড়ের গল্প”।
সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বহুবিচিত্র লোক কথা প্রচলিত আছে। তাদের মধ্যে বহু সাদৃশ্যও বর্তমান। কারণ লোককথা স্থানান্তরিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্নভিন্ন ভাবে।
(ঝ) লোক অভিনয়:
প্রাচীনকাল থেকেই লোককথা বা লোকগল্পকে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয়। গল্প বলার ধরন শৈল্পিকভাবে প্রকাশিত হলে তা লোকশিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয় যা লোক কাহিনীর অন্তর্গত।
লোককথা বা লোককাহিনীর বিশেষত্ব
(ক) লোককথায় কাহিনী গুলি শুরু হয় একটা অভাব বোধ দিয়ে এবং শেষ হয় সেই অভাব পুরণের মধ্যে দিয়ে। যেমন গল্পের শুরুতে রাজা, রাণী, নিঃসন্তান ছিল। গল্পের শেষে রাজপুত্রের বিবাহের মাধ্যমে তা সম্পন্ন হয়।
(খ) একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে কিন্তু সেখানে ফল হয় পৃথক ধরণের। যেমন সুখ দুখুর গল্প বা কাঠুরে ও জলদেবতার গল্প।
(গ) টাইপ চরিত্রের সন্নিবেশে পরিলক্ষিত হয়।
(ঘ) অসংলগ্ন কাহিনীর মধ্য দিয়ে গল্পে কাহিনী এগিয়ে যায়।
(ঙ) সতর্ক মূলক বিধি নিষেধ লোককথায় অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার নিরিখে Totem, Tabu, Mana প্রভৃতি যুক্ত থাকে।
এভাবে লোক সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা রূপে লোককথা স্থান পেয়ছে। বলা যায় লোক কথাই লোকসাহিত্যকে বেশি মাত্রায় সমৃদ্ধ করেছে।
তথ্যসূত্র
১. চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত, “লোকসাহিত্য প্রসঙ্গে”, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৮১।
২. নিত্যানন্দ মণ্ডল, লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি, দূর শিক্ষণ অধিদপ্তর, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, নয়াদিল্লি, পৃষ্ঠা ৩৯-৪৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।