লোকসাহিত্য বা মৌখিক সাহিত্য (ইংরেজি: Folk literature বা Oral literature) হচ্ছে এমন ধরনের সাহিত্য যা লিখিত সাহিত্যের বিপরীতে কথ্য বা গীত হয়েছে, তবে অনেক মৌখিক সাহিত্যের অনুলিপি করা হয়েছে। লোক সাহিত্য বা মৌখিক সাহিত্যের জন্য লোককাহিনীবিদদের বিভিন্ন বর্ণনা থাকায় এদের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। একটি বিস্তৃত ধারণা হচ্ছে এমন যে এটি মৌখিক প্রবাহের মাধ্যমে রক্ষিত এবং এটার কোনও নির্দিষ্ট গঠনরূপ থাকে না। এর মধ্যে লোক কাহিনী, কিংবদন্তি এবং ইতিহাস কথ্য আকারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়েছে।
এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে, এক গোষ্ঠী থেকে আরেক গোষ্ঠীতে যে অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞা হস্তান্তরিত হতে থাকে, সেসব অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে মানুষ একই সঙ্গে ব্যবহারিক এবং নান্দনিকভাবে নানান কিছু সৃষ্টি করে। এই ব্যবহারিক এবং নান্দনিক দুটি দিককে প্রথা, রীতি, আচার, সংস্কার ইত্যাদির মাধ্যমে সংহত করে তৈরি হয় সংস্কৃতি। সংস্কৃতিকে তিনটি স্তরের আয়তনে বিন্যস্ত করলে দেখা যায় যে:
ক. প্রথম স্তর: ভাবসম্পদের স্তর যার অন্তর্ভুক্ত ললিতকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি।
খ. দ্বিতীয় স্তর: ভাবসংযোগ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত প্রথা, রীতি, বিশ্বাস, আচারসংস্কার ইত্যাদি।
গ. তৃতীয় স্তর: ব্যবহারিক সম্পদের স্তর, যাতে রয়েছে বিশ্বপ্রকৃতিকে আয়ত্ত করার উদ্ভাবনী প্রজ্ঞাসমূহ এবং উৎপাদন-প্রক্রিয়া।
অর্থাৎ নান্দনিক অনুভূতি ও ব্যবহারিক প্রয়োজন এ দুয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো লোকসাহিত্য, যা প্রাথমিক অবস্থায় ছিলো একান্তভাবেই মৌখিক তথা oral-literature। এইটিই বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত থেকেছে নানান প্রকরণের মধ্যে দিয়ে। আধুনিককালে এসে যখন গবেষণা ও বিজ্ঞানসম্মত লোকসংস্কৃতি চর্চার উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে লোকসাহিত্যের নানা প্রকরণ, লিখিত-রূপও তখন থেকেই তৈরি হতে শুরু করেছে মূলত নানান গ্রন্থে সংকলনের আকারে।
লোকসাহিত্য শুধু গ্রামীণ মানুষেরই সাহিত্য নয়, খেটে খাওয়া নাগরিক জীবনের অংশীদারও এই সাহিত্যের সীমানার অন্তর্ভুক্ত। আসলে লোক তথা সাধারণ মানুষের জীবনকথার অভিপ্রকাশকেই লোকসাহিত্য বলা যেতে পারে হয়ত, তবে সমাজবিজ্ঞানের নিরিখে সেই সাহিত্যকেই যথা অর্থে লোকসাহিত্য বা Folk literature বলা যেতে পারে যা ঐতিহ্যের দীর্ঘ পরম্পরার অবিভাজ্য অংশ হিসেবেই প্রজন্মানুসারে মৌখিকভাবে প্রবাহিত হয়ে থেকেছে অতীত থেকে বর্তমান অবধি। ফলত লোকসাহিত্যের সীমানার বিস্তৃতি অনেকদূর অবধি—সৃষ্টি রহস্যের কথা, সমাজবিবর্তনের সূত্র, প্রতিষ্ঠিত আচার-সংস্কৃতি-রীতিনীতি, মিথ, টেল, লিজেণ্ড সবই লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।[১]
লোকসাহিত্যের অন্তর্গত উপবর্গগুলি ছয় ধরনের। সেগুলো হলও:
ক. লোককথা, খ. ছড়া, গ. ধাঁধা, ঘ. প্রবাদ, ঙ. প্রবচন ও চ. গীতিকা।
আপনারা উপরের এই ছয়টি লিংকে ক্লিক করে সবগুলোই বিস্তারিত পড়তে পারবেন।
তথ্যসূত্র
১. চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৮০-৫৮১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।