পিলসুজ শাহেরা খাতুন স্মরণে
দীপ দেখেছো আলো দেখেছো
দেখোনি কী দীপাধার
আঁধার তাড়িয়ে আঁধারেই রয়
পিলসুজ সভ্যতার।
কাঁটা মাড়িয়ে রক্ত ঝরিয়ে
বানালো যাহারা পথ
ভুলেও কি তাঁদের মনে করে কেউ
সে পথে চালিয়ে রথ?
রাজসিক কত সভা সমাবেশ
প্রাণ প্রকৃতির ওপর
সিঁধু ও কানুর অনুসারীদের
বলো কে রাখে খবর!
নৃত্য গীতের লোকশিল্পের
জনক জননী ভুলে
কাক হয়ে কেউ দিচ্ছি উড়াল
ময়ূর পেখম মেলে!
ঘাম ঝরিয়ে কাজ করে যারা
খ্যাতি পদ মোহ ছেড়ে
তাঁরাই প্রকৃত কর্মবীর আর
তাঁরাই সমাজ গড়ে।
সমাজ গড়ার পিলসুজ এক
শাহেরা খাতুন নাম
মস্তক আমার অবনত করে
তাঁকে জানাই সালাম।
বিরুদ্ধ স্রোতের নায়ের মাঝি
তিনি ছিলেন একদিন
তাঁহার কাছে তোমার আমার
রয়েছে অশেষ ঋণ।
বৈশাখ এখন
বৈশাখ কোথায় বৈশাখ কোথায়
বৈশাখ খুঁজে পাই না আর
বৈশাখ বিহীন গ্রাম জুড়ে যে
দেখছি কেবল হাহাকার।
পাতার বাঁশির খুকুর হাসির
মিলন মেলার বৈশাখ কই?
কোথায় গেলো বৈশাখের স্বাদ
মুড়কি মুড়ি চিঁড়া দই?
প্রাণের বৈশাখ গ্রামে যে নাই
লুট করেছে রাজার লোক
রাজধানীটা বৈশাখ ঠাসা
শূন্য খা খা মায়ের বুক।
বৈশাখ এখন শাহবাগ আর
বটমূলের খাচায় বশ
বহুজাতিক কোম্পানিরা
চিবিয়ে বৈশাখ খাচ্ছে রস।
দেখতে বৈশাখ র্যাব-পুলিশের
ছাড়পত্র আজ নিতে হয়
কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে
বৈশাখের স্বাদ পেতে হয়।
ভালোবাসার কবিতা
বিরক্ত করেছি অনেক
ছুটে গিয়েছি কাছে
পকেট থেকে হাতে নিয়েছি হৃদয়
তুমি দেখেছো কাগজ
আমি বলেছি কবিতা
পাগলামি বলে ফিরিয়েছো মুখ তোমার।
হৃদয় আর কাগজ, কবিতা আর পাগলামির
তর্কে না গিয়ে বলেছি মাত্রই শেষ করে এলাম
প্রথম শোনাবো তাই।
তোমার হাজারো ব্যস্ততা
বিরক্ত কিংবা তিরস্কার দমাতে পারেনি আমায়
এক নিঃশ্বাসে পড়েছি
হৃদয়ের গোছগাছ কথাগুলো সব।
বলেছো- খোদা হাফেজ
পরে কথা হবে।
না, সময় হয়নি এ নিয়ে কিছু বলার
পরে কখনো আর।
দেখা হলেই বলেছি- একটু দাঁড়াও
বিরক্ত হয়েছো তুমি-‘ উহ্ আবার কবিতা!
এখন কি কবিতা শোনার সময়?
দু’হাতে চেপেছো কান
তবু তবুও শুনিয়েছি পড়ে
নাছোড় বান্দা আমি।
‘কবিকে ভালোবেসে ভারি তো ফ্যাসাদ’
বলেছো বহুদিন
একটুও লাগেনি আমার
আবার লিখেছি, গিয়েছি ছুটে
প্রথম শোনাবো বলে।
শোন নি
একটি বারও শোন নি মনোযোগসহ
একটিও কবিতা আমার।
বিরক্ত করে করে নিজেও ক্লান্ত হলাম শেষে
শেষ কবিতাটাও হলো না শেষ।
জানতেও পারলে না তুমি
সুন্দর পৃথিবীর সব রূপ সব রং
সব গন্ধ থেকে দূরে বহু দূরে
নির্জনে একা একা
কী মানসিক চাপক্লিষ্ট আমি
প্রাণপণ চেষ্টা করছি শেষ কবিতাটি
শেষ করবো বলে।
একান্তই যদি শেষ না হয়
নিজেই হবো সেই কবিতাটি আমি।
জানি
আমার সেই কবিতাটিও শোনার
কোন সময় বা আগ্রহ হবে না তোমার।
তাতে কী
কবি এবং কবিতাকে ভালোবাসার
অনেকেই আছে।
এই দেখো
স্থবির নিশ্চল পরিচর্যাহীন
এই আমার হাতে পায়ে
এমনকি
নাক-কান-চোখ-মুখ গহব্বরে
এসে ভীড় করেছে
ঝাঁকে ঝাঁকে মাছি
সারি সারি পিঁপড়েরা।
সম্ভবত বাতাসই পৌঁছে দিয়েছে
ওদের কাছে
আমার শেষ কবিতাটির সংবাদ।
ওরা এসে বলছে-
‘দুঃখ করো না কবি
আমরা তো আছি
ভক্ত কুল তোমার।
আহ্ কী মধুর
কী মধুর তোমার লোবানমুক্ত
কবিতার অকৃত্রিম ঘ্রাণ!! ‘
বজ্রাগ্নি
বলছে সবাই যাচ্ছে ওরা শীঘ্রি রসাতলে
ভাবছি আমি আসছে কারা ওরা চলে গেলে?
আসবে আবার কারা?
শোষক রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণীর
অন্য কোন ধারা।
যাচ্ছে শুধু ক’জন মানুষ থাকছে সবই ঠিক
আসছে যাঁরা ওরা হবে সেই সবের মালিক।
বঙ্গভবন চিড়িয়াখানা হবে ঘষা-মাজা
অদলবদল চিড়িয়াগুলো বাহ্ বাহ্ কী মজা।
র্যাব-পুলিশ,আইন-আদালত থাকে যদি সব
কীসের যাওয়া কীসের আসা কীসের কলরব?
পাঁচ দশক একই দৃশ্য দেখছি যে বারবার
ক্ষমতার এই হাত বদলে লাভ নেই জনতার।
যুদ্ধ চাই শ্রেণি যুদ্ধ উঠুক কলরব
শ্রেণি শত্রুর রক্তে ভাসুক শাসন-শোষণ সব।।
নাম তাঁর অনুপ সাদি
সব গুণী নয় আলোচিত
কেউ কেউ নন সবার মতো
আছে ব্যতিক্রম
নাম, যশ আর খ্যাতির মোহ
হামবড়া ভাব যা-ই কহো
ব্যতিক্রমের কাছে ওসব
তুচ্ছই একদম।
গুণ ফলাতে যথা তথা
নেই কোনো তাঁর অস্থিরতা
সংযত সব সময়
প্রভুভক্ত’র নেই মনোভাব
স্বাধীনচেতার এটাই স্বভাব
নেই কোনো ডরভয়।
লোভ-লালসা নেই কিছু তাঁর
অন্যায়কে দেয় না সে ছাড়
সদা প্রতিবাদী
কমই আছে এমন গুণী
একজনকে আমি চিনি
নাম অনুপ সাদি।
হাসান ফকরীর কয়েকটি কবিতা শুনুন ইউটিউব থেকে
ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়
কৌপীন গান্ধী ধোপদুরস্ত জিন্নাহ
ধাপ্পাবাজির কারসাজিতে
কেউ যে কারো কম না
কম না কেউ কম না
যাঁরা তাদের উত্তরসূরী
কও দেখি কে যম না?
স্বাধীনতার যম যে তাঁরা
গণতন্ত্রের যম
দেশপ্রেমের খই ফোটাচ্ছে
মুখেতে হরদম
ওরা গণতন্ত্রের যম।
দেশপ্রেম নয়, শ্রেণী প্রেম
দেখো দু’চোখ মেলে
ওদের ডাকে রক্ত দিয়ে
তোমরা কে কী পেলে
দেখো না চোখ মেলে-
দীর্ঘ ত্যাগ তিতিক্ষা, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন সংগ্রামের
ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশের বিদায়
অখণ্ড ভারত হলো খণ্ডিত
খণ্ডিত একাংশের মালিকানা গেলো
গান্ধী – নেহেরুর টাটা,বিড়লা, ডালমিয়াসহ
বড় বড় পুঁজিপতিদের হাতে
অপর অংশের মালিক হলো
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র আদমজী, ইস্পাহানি
বাওয়ানিদের ২২ পরিবার ও সামন্ত প্রভুরা।
আর আমরা
ওদের শাসন -শোষণের স্বাধীনতাকে উদযাপন করলাম
আমাদের স্বাধীনতা বলে।
বোধোদয় হতেই
আবার রক্তক্ষয়ী আন্দোলন -সংগ্রাম -যুদ্ধ
শোষনমুক্ত সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে
বিপ্লবীদের সংগঠিত সেই যুদ্ধের গতিপথ
আটকে দিলো সম্প্রসারণবাদী বিদেশি শক্তি।
শ্রমিক কৃষক ছাত্র জনতার মহান আত্মদানে
পূর্ব বাংলা থেকে পাততাড়ি গুটালো
পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও বাইশ পরিবার।
পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মালিকানা হস্তগত করলেন
শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন
সামন্তীয় ভাবাচ্ছন্ন আমলা মুৎসুদ্দি ও
লুটেরা আওয়ামিলীগ।
যাঁদের সাথে গাঁটছড়া বন্ধন
এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শত্রু
সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ,সামন্তবাদ এবং
আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের।
লুটেরা পুঁজিপতি বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, বিজিএমইএ
যমুনা-হামিম, এস আলমদের প্রতিনিধি
জিয়া-এরশাদ-খালেদা-নিজামী-শেখ হাসিনাদের
শাসন-শোষণের স্বাধীনতাকে
নিজেদের স্বাধীনতা বলে
একই ভুল করছি কি-না আমরা?
৪৭ সালের লালঝাণ্ডা তরঙ্গিত
মিছিল সমুদ্রের গর্জন
আজও কি প্রযোজ্য নয় এদেশে?
ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়
লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।।
আরো পড়ুন
- ৫৬,০০০ বর্গমাইল
- পরাজিত শ্রমিক
- স্বদেশ শ্মশান
- সমাজতন্ত্র আকাশ থেকে পড়ে না
- আমাদের আশাগুলোর বয়স বাড়ে না
- একটি নাটাবটের একটি তিতির হবে একটি সেতু
- ভিখারিনী থেকে জ্যান্ত পুঁজির দানব, কলকাতা
- হাজার বছর পরে মুক্তির উৎসব
- যৌথতার গান
- জীবনের নব সূর্যস্নান
- আমাদের অম্লান চেতনা
- আমার হৃদয় কোনো দেয়াল মানে না
- পিতৃভূমি, তোমার হৃদয়ে আলো জ্বেলে আমাদের ক্রমমুক্তি হবে
- তুমি আসবেই আমার শ্রেণিহীন রক্তে
- আমরা সেদিন, বহুদিন তারপর কিছুদিন জীবনের গল্প বলেছি
লেখক পরিচিতি: কবি, গীতিকার, লেখক ও প্রাবন্ধিক হাসান ফকরী ফুলকিবাজ ডট কমের জন্য এই কবিতাগুলো দিয়েছেন। ফুলকিবাজ তাঁর পাঁচটি কবিতা প্রকাশ করতে পেরে আনন্দিত।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।
সমাজবাস্তব চেতনার দ্যুতি ছড়িয়ে সুন্দর কয়েকটি কবিতা লিখেছেন আপনি। সবগুলো কবিতাই সুলিখিত। লোকগানশিল্পী ও সামাজিক মুক্তির দিশারী নারী শাহেরা খাতুনের স্মৃতিতর্পন করে উত্তরজীবী হিসেবে আপনি যথোচিত শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। আমাদের বৈশাখী উৎসব পালনে আজকাল যে সাংস্কৃতিক পশ্চাদ্পদতা ও অপসাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধ বিদ্যমান সে-বিষয়েও আপনার উপস্থাপন প্রণিধানযোগ্য। তৃতীয় কবিতায় প্রেম ও কবিতা বিষয়ক নান্দনিক বিবৃতি লক্ষ করা গেল। আর বাম-আদর্শভিত্তিক দৃঢ়তা ও সাহস নিয়ে লেখা শেষ দুটি কবিতাও শিল্পের মানদণ্ডে উতরে গেছে। ভালো থাকবেন হাসান ভাই।
হাসান ফকরীর সব কবিতাই সমাজের সমস্যার কথা বলে। এখানকার কয়েকটি কবিতা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।