রূপকথা বা পরির গল্প লোককাহিনী ঘরানার উদাহরণ যা ছোটগল্পের রূপ নেয়

রূপকথা, রূপকথার গল্প, আশ্চর্য গল্প, যাদু গল্প, পরির গল্প বা Märchen (ইংরেজি: Fairy tale) হচ্ছে একটি লোককাহিনী ঘরানার একটি উদাহরণ যা একটি ছোট গল্পের রূপ গ্রহণ করে। রূপকথা শব্দের ইংরেজি হচ্ছে Fairy tale। রূপকথার মধ্যে রাজা, রাণী, রাজকন্যা, পরী, রাক্ষস, ক্ষোকস প্রভৃতি কাহিনী থাকে। রাজতন্ত্রের সময় কাল থেকে সম্ভবত রূপকথার সৃষ্টি হয়েছে বলে ধরা হয়ে থাকে। তবে পরবর্তী কালে এর সাথে বণিক বা সওদাগরের কথা যুক্ত হয়েছে। যখন উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সদভাব ছিল, শ্রেণিচেতনা তখন এতটা প্রকট ছিল না। সেই সময় থেকে এই রূপকথার সৃষ্টি বলে ধরা যেতে পারে।

রূপকথার গল্পের কাহিনী কায়ার কখনো মালীপুত্র রাজকন্যাকে বিবাহ করছে বা ঘুটে কুড়ানী রাজার ছেলেকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছে। অর্থাৎ শ্রেণী চেতনা তখন খুব একটা প্রকট ছিল না ধরা যেতেই পারে। বাংলার রূপকথার ন্যায় সব সময় বীর, সাহসী, অদম্য উৎসাহ সে সমস্ত অসম্ভবকে সম্ভব করে ছাড়ে। ন্যায় অন্যায়ের সংঘাতে এই রূপকথাগুলি সমৃদ্ধ।

লোককথায় রূপকথার গল্পগুলি একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ায় নেপথ্যে আছে বণিক সম্প্রদায় বা সওদাগরদের কাহিনি। অধিকাংশ সওদাগর মুসলিম। সম্প্রদায় মুক্ত হওয়ার গল্পগুলি বাণিজ্যের কারণে একস্থান থেকে অন্য স্থান প্রবেশ করে। বলা ভালো বাংলাদেশেও তা প্রচলিত হয়। অলৌকিক ঘটনা সমৃদ্ধ বা জাদু বিশ্বাসের প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রূপকথার গল্পগুলি বিশ্বজনীনতা লাভ করে। রুপকথায় নায়ক বা নায়িকা মানব – মানবীর হলেও এর অন্য একটি প্রধান চরিত্র রাক্ষস। এই রাক্ষস সম্ভবত অনার্য জাতীয় কুৎসীত আচরণের চরিত্র থেকেই এই রাক্ষসের ধারণা তৈরী করে নিয়েছেন লোককথার সৃষ্টিকারীরা।

লোককথা বা রূপকথার কাহিনী মূলত শিশু মনকে ভোলানোর জন্য রচিত হয়েছিল, তাই এর নায়ক বা নায়িকা সোনার পালঙ্কে শুয়ে থাকে। রাজপুত্র এসে রাজকণ্যাকে রূপোর কাঠির সাহায্যে জাগিয়ে তুলে গল্প করে অথবা সোনার কাঠির ছোঁয়ায় ঘুম পাড়িয়ে চলে যায় আর যে ভয়ঙ্কর রাক্ষস থাকে তার প্রাণ লুকানো থাকে কোনো ভ্রমর বা কোন প্রাণী কিম্বা বড়ো কোনো মাছের পেটে। রাজপুত্র এক কোপে এই অসাধ্য সাধন করে অর্থাৎ ঐ প্রাণীদের হত্যা করে রাক্ষসের প্রাণ হরণ করে নিত। ফলে রাক্ষস মারা যেতে। অর্থাৎ আমাদের মনে নৃতত্বের যে ধারনা ছিল যে আত্মাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় অর্থাৎ এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে আত্মাকে স্থানান্তরিত করা সম্ভব। কারণ আত্মার মৃত্যু নেই। এক দেহ থেকে অন্য দেহে স্থানান্তরিত হয় মাত্র। এই ধারনা রূপকথায় গল্প গুলিকে সমৃদ্ধ করে।[১]

লোককথার বিভিন্ন রূপের মধ্যে সবচেয়ে কাব্যময় আর আনন্দের হলো রূপকথাগুলো। এরা আমাদের অপরূপ কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। মনে হয় এই সব রূপকথার ভিত্তি কেবল কল্পনা আর স্বপ্ন। অমঙ্গলের বাহনদের সঙ্গে এই সব রূপকথার যে বীর নায়করা যুদ্ধ করেছেন, তাঁরা কেউই সাধারণ জগতের নিয়মে বাঁধা নন। কিন্তু তবু, এই সব কিছুর ভিতরে মানুষের সত্যিকার স্বপ্ন ফুটে উঠেছে। এই রূকথাগুলির বীর নায়কেরা লোকপ্রচলিত আদর্শের মূর্তি। তাঁরা সবসময়ই নির্ভীক, দুঃসাহসী, মহৎ অমঙ্গলকে তাঁরা জয় করবেনই। রুশ কাহিনীকাররা খুব ভালোবাসেন ঘরোয়া গল্প ও চুটকি।[২]

রূপকথাতেও একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের গল্প থাকে আর সেই গল্পের কাঠামো তৈরি হয় কতকগুলি motif বা এপিসোডের সহায়তায়। রূপকথাতেও আখ্যানের যে প্রেক্ষাপটটি তা unreal, নির্দিষ্ট কোনো ভূখণ্ডকে বা স্থানকে চিহ্নিত করা সেখানে সম্ভব নয়; এমনকি উত্থাপিত চরিত্রগুলিও হয় নৈর্ব্যক্তিক। কিছু কিছু ব্যতিক্রম যে নেই তা নয় যেমন লালকমল নীলকমল, মধুমালা ইত্যাদি। তবে এগুলি ব্যতিক্রমই। রূপকথার চরিত্রগুলি সাধারণভাবে নৈর্ব্যক্তিকই হয়। এগুলি বিশেষের পরিবর্তে নির্বিশেষ।

রূপকথায় বিস্ময় ও চমৎকারিত্বের সব উপাদান মজুত থাকে। রূপকথার নায়ক প্রতিকুলতাকে, শত্রুকে নিঃশেষিত করে সুখে শান্তিতে সংসারযাত্রা নির্বাহ করে। মোটের ওপর পরিণতি হয় মিলনান্তক happy end দেখা যায়। যদিও marchen জার্মানিতে লভ্য, কিন্তু আমাদের রূপকথার সঙ্গে তার মিল অনেকখানি। নামে কি বা আসে যায়? মানুষ বাস্তবে কি চায়, চায় সুখের জীবন, অভিলাষিত লক্ষ্যে উপনীত হতে ঈপ্সিত সাফল্যের আধকারী হতে। কিন্তু বাস্তব যে বড় রূঢ়, বড় নির্মম তা যে ঘাতপ্রতিঘাতময়। আনুকুল্যের তুলনায় প্রতিকূলতার পরিমাণই যে অধিক। প্রকৃতপক্ষে বাস্তবজীবন সেদিক দিয়ে মানুষের কাছে কখনই আদর্শ হতে পারে না। কিন্তু মানুষ যে নাছোড়বান্দা, সহজে হার মানার পাত্র নয়। তাই সে তার মনোবাসনা চরিতার্থতার বিকল্প ব্যবস্থা করেছে, এই বিকল্প হল রূপকথা। রূপকথা মাত্রই মিলনান্তক, আমরা কেই বা বিয়োগান্ত পরিণতির জন্য ব্যাকুলতা বোধ করি যতই কেন বলি ‘our sweetest songs are those that tell of saddest thought.’[৩]

তথ্যসূত্র

১. নিত্যানন্দ মণ্ডল, লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি, দূর শিক্ষণ অধিদপ্তর, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, নয়াদিল্লি, পৃষ্ঠা ৩৯-৪৪।
২. এ পমেরান্তসেভা, রুশদেশের উপকথা, সুপ্রিয়া ঘোষ অনূদিত ও ননী ভৌমিক সম্পাদিত, রাদুগা প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৮।
৩. বরুণকুমার চক্রবর্তী, “রূপকথার প্রসঙ্গ”, লোককথার সাতকাহন, সম্পাদনা বরুণকুমার চক্রবর্তী, অপর্ণা বুক ডিস্ট্রিবিউটর্স, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০০০, পৃষ্ঠা ১১-১২।

1 thought on “রূপকথা বা পরির গল্প লোককাহিনী ঘরানার উদাহরণ যা ছোটগল্পের রূপ নেয়”

Leave a Comment

error: Content is protected !!