নীতিগল্প বা নীতিকাহিনী বা নীতিকথা (ইংরেজি: Fable) হচ্ছে রূপকথার একটি ধরন যাতে জীবজন্তুর গল্পের মাধ্যমে যখন নীতি বা আদর্শের কথা সংযোজিত হয়। নীতি কাহিনী মূলক গল্পের উদাহরণ হচ্ছে ঈশপের গল্প, পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ প্রভৃতি।
এই সব নীতিকাহিনীর বেশির ভাগই যখন প্রথম বলা হয়েছিল, তারপর বহ, শতাব্দী পার হয়ে যাবার পরে সংকলিত হয়। যারা কাহিনী বলেছে তারা তাদের পছন্দমত, তাদের ইচ্ছানুসারে এদিক ওদিক বাড়িয়ে নতুন কিছু যোগ করে নতুন রূপ দিয়েছে। কাহিনীগুলো যত পুরোনো হয়েছে, ততই বেশি মনোগ্রাহী হয়েছে, আর তাদের শিল্পগুণও বেড়েছে। শত শত বছর ধরে লোকেরা মেজে ঘসে তুলির নানা টানে এসব উপকথা রূপকথাকে একেবারে নিখুঁত করে তুলেছে এসব কাহিনীকে।
এই জীবজন্তুর গল্পগুলো অনেককাল আগে শিকারীরা রচনা করেছে, তারা বনের জীবজন্তুকে ভাল করে চিনেছিল, দেখেছিল তাদের প্রত্যেকেরই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব আছে। এই গল্পগুলি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে রূপকথার অন্যান্য ধরনের মতো। তাতে রূপকের আকারে মানুষের লোভ, ধূর্তামি, নির্বুদ্ধিতা প্রভৃতি নানা দোষ ও দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।[১]
উনিশ শতকের মধ্যভাগ যখন লোককথায় উদ্ভব নিয়ে বিতর্ক চলছিল। সেই সময় জার্মান দেশীয় সংস্কৃত ভাষাবিশারদ পন্ডিত এবং জার্মান গটেনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থিওডোর বেনফা (Theodore Benefey) ১৮৫৯ এ পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থটি সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। তিনি তার গ্রন্থে অসংখ্য টিকার মাধ্যমে দেখালেন যে একই ধরনের গল্প তথা এই পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলি ইউরোপের প্রায় সব ভাষাতেই প্রচলিত রয়েছে। তবে ঈশপের গল্প থেকে পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলো বেশি উন্নত মানের।[২] তার মতে ঈশপের জীবজন্তু শুধুমাত্র জীবজন্তু হিসাবে গণ্য কিন্তু পঞ্চ তন্ত্রের জীবজন্তুগুলির মধ্যে মানবাত্মা আরোপ করা হয়েছে। তারা যেন মানুষের জবানিতে তদের কথা বলে যান। একই ধরণের গল্প প্রায় সকল দেশে কিভাবে পাওয়া যায় এই মন্তব্যের নিরিখে বেনকা বলেন
“নানা ব্যবসায়ী, পরিব্রাজক ও ধর্মপ্রচারকের মাধ্যমে দশম শতকের পূর্বেই কিছু সংখ্যক ভারতীয় গল্প ইউরোপে যায়। প্রসঙ্গে রাজ্য বিস্তার, বাঁদী, বন্দী, ক্রীতদাস, বিবাহ, হিজরত, পলাতক আসামী, ধর্মবিস্তারের মাধ্যম তা সম্ভব ছিল। দশম শতাব্দীর পর বিদেশী মুসলিম রাজশক্তি – ইটালি, স্পেন ও রোমে মুসলিম শাসকদের মাধ্যমে – এছাড়াও বৌদ্ধদের মারফৎ চীন ও তিব্বত এবং অবশেষে মোঙ্গলদের মাধ্যমে সমগ্র ইউরোপে প্রসার লাভ করে।”[৩]
পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলি সম্ভবত খ্রিস্ট পূর্ব ১০০-৫০০ শতাব্দীর মধ্যে রচিত ও বহু প্রাচীন নীতিগল্প উপাদানে এটি সমৃদ্ধ।
তথ্যসূত্র
১. এ পমেরান্তসেভা, রুশদেশের উপকথা, সুপ্রিয়া ঘোষ অনূদিত ও ননী ভৌমিক সম্পাদিত, রাদুগা প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৮।
২. নিত্যানন্দ মণ্ডল, লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি, দূর শিক্ষণ অধিদপ্তর, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, নয়াদিল্লি, পৃষ্ঠা ৩৯-৪৪।
৩. ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী; লোকসাহিত্য ১ম খন্ড; মল্লিক ব্রাদার্স; পৃষ্ঠা ২৩১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।