প্রবন্ধ সাধারণত এক টুকরা লেখা যা লেখকের নিজস্ব যুক্তি দেয়

প্রবন্ধ (ইংরেজি: Essay) সাধারণত এক টুকরা লেখা যা লেখকের নিজস্ব যুক্তি দেয় — তবে সংজ্ঞাটি অস্পষ্ট। এটি চিঠি, গবেষণা-কাগজ, নিবন্ধ, পুস্তিকা এবং ছোট গল্পের সাথেও সংজ্ঞার্থে জড়ায়ে পড়ে। প্রবন্ধগুলি ঐতিহ্যগতভাবে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক হিসাবে উপ-শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।

সাহিত্যের অন্যান্য রূপ নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, প্রবন্ধ নিয়ে এতোটা হয়নি। এর কারণ সম্ভবত এই যে কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প এবং নাটককেই সাহিত্যের সৃষ্টিশীল আঙ্গিক মনে করা হয়। অবস্থান-বিচারে কোনো কোনো সমালোচক প্রবন্ধকে দ্বিতীয় শ্রেণির সাহিত্যরূপ (Literary Form) মনে করেন। কিন্তু আধুনিককালে মানুষের বুদ্ধি, যুক্তি এবং চিন্তা নির্ভরতা প্রবন্ধের প্রাসঙ্গিকতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। 

প্রবন্ধ বলতে আমরা সাধারণত এমন এক ধরনের গদ্যরচনাকে বুঝি, যা আলোচনার মাধ্যমে কোনো বিশেষ বক্তব্য, দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা বিষয়-অন্তর্গত বক্তব্যকে উপস্থাপন করে— চিন্তা এবং যুক্তির পরস্পর মিলনে পাঠককে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সহায়তা করে। ইংরেজি Essay-র প্রতিশব্দ হিসেবে প্রবন্ধকে গ্রহণ করে থাকেন অনেকে। কিন্তু বাংলা ভাষায় প্রবন্ধের ক্ষেত্র ইংরেজি Essay-র তুলনায় ব্যাপক। ইংরেজিতে Treatise, discourse বা dissertation জাতীয় রচনার সঙ্গে প্রবন্ধের পার্থক্য বিদ্যামান। ওই তিনটি সংজ্ঞায় বিশেষ ধরনের ‘নিয়মতান্ত্রিক’ ও ‘সম্পূর্ণ’ বিষয় উন্মোচন বোঝায়—যে নিয়মের শাসন বা সম্পূর্ণতা প্রবন্ধের ক্ষেত্রে সব সময় মেনে চলা হয় না। আরও উল্লেখ্য যে, Treatise বা dissertation জাতীয় রচনা নির্দিষ্ট ‘সীমাবদ্ধ’ পাঠক শ্রেণির জন্য রচিত হয়। কিন্তু প্রবন্ধ রচিত হয় ‘সাধারণ’ পাঠকের দিকে লক্ষ রেখে। এ-কারণে বিষয় বা পরিভাষার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো নীতিও মেনে চলে না প্রবন্ধ। বরং বক্তব্য বা বিষয় উপস্থাপনের প্রয়োজনে কখনো গল্প, কখনো দৃষ্টান্ত, কখনো কৌতুক, আবার কখনো সূক্ষ্ম-অনুভূতি প্রয়োগের মাধ্যমে পাঠকের বুদ্ধি ও যুক্তিকে জাগ্রত করাই প্রবন্ধের লক্ষ্য। 

প্রবন্ধের রূপগত বৈশিষ্ট্য 

ইংরেজিতে যেমন Essay-র সমধর্মী বেশ কিছু পরিভাষা—যেমন Treatise, dissertatorn, discourse রয়েছে, বাংলা ভাষায়ও অনরূপ কিছু শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। যেমন—নিবন্ধ, সন্দর্ভ, প্রস্তাব প্রভৃতি। এই শব্দগুলোর প্রয়োগ সংস্কৃত সাহিত্য এবং প্রাচীন-মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে লক্ষ করা যায়। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যচর্চার ক্ষেত্রে উক্ত শব্দগুলো বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছেন লেখকরা। কোনো গ্রন্থের টীকা অর্থে ‘নিবন্ধ’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো সংস্কৃত সাহিত্যে। ‘সন্দর্ভ’ শব্দটির অর্থ সম্যকরূপে গ্রন্থন, রচনা বা সংগ্রহ। উনিশ শতকে বাংলা গদ্যসৃষ্টির সূচনাপর্বে ব্যাখ্যানমূলক, বিতর্কমলক ও বর্ণনামলক রচনাকে ‘প্রস্তাব’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ মনীষীরা তাঁদের বিভিন্নধর্মী গদ্যরচনাকে ‘প্রস্তাব’ নামে চিহ্নিত করতেন। রামগতি ন্যায়রত্ন ‘প্রস্তাব’ শব্দটিকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস-ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছিলেন। উনিশ শতকের সত্তর দশক থেকেই মূলত গভীর চিন্তা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণমূলক গদ্যরচনাকে প্রবন্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করা শুরু হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা গদ্যরচনার সংকলনের নাম দেওয়া হয় প্রবন্ধপুস্তক (১৮৭৯)। 

প্রবন্ধ শব্দটির আভিধানিক অর্থ প্রকৃষ্ট রূপে বন্ধন থেকেই এর রূপগত বৈশিষ্ট্য নিরূপণের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ও রূপসৃষ্টির ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে। এক সময় মনে করা হতো যুক্তি ও মননশীলতার প্রয়োগে সৃজনশীল মৌলিক শিল্পকর্মসমূহকে (যেমন, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প) মানুষের বোধের আয়ত্বে নিয়ে আসা প্রবন্ধের অন্যতম একটি কাজ। মানুষের জীবনের অন্যান্য প্রসঙ্গ যেমন সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, দর্শন, নন্দনতত্ত্ব, বিজ্ঞান, শিক্ষা—এগুলোও প্রবন্ধ সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে প্রবন্ধরূপী এমন কিছু সৃষ্টি বিভিন্ন কালে হয়েছে, যেগুলো অনেকটা মৌলিক সৃষ্টি কর্মের পর্যায়ভুক্ত। প্লেটোর Dialogue কিংবা এ্যারিস্টটলের Poetics গ্রন্থ দুটি মৌলিক কোনো সাহিত্যকর্মের পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু অনেক মৌলিক সৃষ্টির চাইতে তার প্রাসঙ্গিকতা এখনো পর্যন্ত বিদ্যমান। সাহিত্যবিচারের মৌলিক মানদণ্ডের মতো এগুলো যে ভাবীকালেও গ্রহণীয় থাকবে সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

প্রবন্ধের বিষয়ের ক্ষেত্র বিচিত্র। সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, রাজনীতি, দর্শন, নন্দনতত্ত্ব এমনকি অতি সাম্প্রতিক প্রসঙ্গও প্রবন্ধের বিষয় হতে পারে। প্রতিটি বিষয়কে অনিবার্য ভাষারূপের মাধ্যমে উপস্থাপন করা প্রাবন্ধিকের ধর্ম। এক্ষেত্রে প্রাবন্ধিকের ব্যক্তিত্ত্বের প্রসঙ্গটিও তাৎপর্যপূর্ণ। বিদ্যাসাগরের প্রবন্ধের ভাষা আর বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের ভাষা এঁদের ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্রের কারণেই বিভিন্ন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধের গদ্যরীতি বিষয়বস্তুর কারণেই বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর এবং বিশ্লেষণধর্মী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধের বিষয় যেমন বিশ্বজনীন মানব-জীবন ও অস্তিত্বনির্ভর, তেমনি এর ভাষাও যেন অনেকটা মন্ত্রোচ্চারণের মতো। আশি বছর বয়সের রবীন্দ্রনাথ ধ্বংসমত্ত সভ্যতা ও জীবনের বিপন্ন পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সভ্যতার সংকট রচনা করছেন। প্রমথ চৌধুরীর বৈদগ্ধ্য, নিরাসক্তি ও পরিমিতিবোধ ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ লেখকের সমাজ ও সংস্কৃতি অন্বেষার রূপায়ণ। ‘বাংলা গদ্যরীতি’ প্রবন্ধে মুনীর চৌধুরী বিষয়ের প্রয়োজনেই বর্ণনাত্মক ও বিশ্লেষণধর্মী ভাষা প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ অন্বিষ্ট সত্যকে যথার্থ রূপে প্রকাশের প্রয়োজনে দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষারীতির সম্পর্কে সচেতনতা লেখকের জন্য অপরিহার্য।

প্রবন্ধের শ্রেণীবিভাগ 

বিষয়ের প্রকৃতি ও উপস্থাপন-বৈশিষ্ট্য বিচারে প্রবন্ধকে প্রধানত দুটি শ্রেণিভুক্ত করা হয়: 

১. বস্তুনিষ্ঠ বা তন্ময় প্রবন্ধ (Formal or Informative Essay) 

২. ভাবনিষ্ঠ বা মন্ময় প্রবন্ধ (Familiar of Intimate Essay) 

বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে লেখক নিরাসক্তভাবে বিষয়ের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে যুক্তি ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে গভীরভাবে বিষয় বিশ্লেষণ করেন। চিন্তাশীল অনুসন্ধানী পাঠক এ-জাতীয় প্রবন্ধের অনুরাগী। বঙ্কিমবন্দ্রের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ Formal প্রবন্ধের গোত্রভুক্ত। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘প্রবন্ধপুস্তক’ বা ‘বিবিধ প্রবন্ধ’, জ্যোতিরিন্দ্র নাথের ‘প্রবন্ধমঞ্জুরী’, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘নানা প্রবন্ধ’, শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘প্রবন্ধাবলী’, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রবন্ধমালা’, ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সামাজিক প্রবন্ধ ও পারিবারিক প্রবন্ধ, কাজী মোতাহের হোসেনের ‘সংস্কৃতি কথা’, মুনীর চৌধুরীর ‘বাংলা গদ্যরীতি’ বস্তুনিষ্ট প্রবন্ধ বা Formal Essay-র দৃষ্টান্ত। 

ভাবনিষ্ট মন্ময় প্রবন্ধকে ব্যক্তিগত প্রবন্ধ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। এজন্যেই এ-জাতীয় প্রবন্ধের শ্রেণিকরণে Forma or Personal শব্দগুলো প্রয়োগ করা হয়। এ-ধরনের প্রবন্ধে বিষয়বস্তু অপেক্ষা লেখক পাঠককেই বেশি গুরুত্ব দেন লেখক। নিজ অনুভূতিকে পাঠকের অনুভূতি ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান। বলা যায়, এজাতীয় প্রবন্ধে লেখকের ব্যক্তিসত্তার ‘আত্মপ্রকাশ’ ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ ও ‘লোক রহস্য’, রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ এ-জাতীয় প্রবন্ধের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। 

প্রমথ চৌধুরী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, জ্যোতির্ময় রায়, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ মুজতবা আলী সাহিত্য ছাড়াও অন্যান্য বিষয় নিয়েও Informal বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে আশ্চর্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। 

প্রবন্ধের রূপ ও রীতি বহু বিচিত্র। লেখকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও চিন্তার বহুমুখিতা প্রবন্ধে ক্ষেত্রকে করেছে বৈচিত্র্যময়, বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ফলে সাম্প্রতিককালে প্রবন্ধ অধিকমাত্রায় ব্যক্তিত্বচিহ্নিত হয়ে উঠছে। অন্নদাশঙ্কর রায়, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, আবু সায়ীদ আইয়ুব, শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত দুই শ্রেণির প্রবন্ধ রচনায়ই পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিক থেকে বাংলা প্রবন্ধকে এঁরা সৃজনশীল সাহিত্যরূপের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন।

বাংলা প্রবন্ধ 

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা গদ্যের উদ্ভবের সঙ্গে প্রবন্ধ-লক্ষণাক্রান্ত বাংলা রচনার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইংরেজ রাজকর্মচারীরা বাংলা শেখার উদ্দেশ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০) তার মধ্যে অন্যতম। সচেতনভাবে বাংলা গদ্যচর্চার সূত্রপাত এখান থেকেই। রাজ রামমোহন রায়ের ধর্মচিন্তা মূলক রচনা এবং ‘দিগদর্শন’, ‘সমাচার দর্পন’ (১৮১৮), ‘সংবাদপ্রভাকর’ (১৮৩১) ও তত্ত্বাবাধিনী পত্রিকার (১৮৪৩) সংবাদ, প্রতিবেদন ও রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা প্রবন্ধের ভিত্তি তৈরি হয়। উনিশ শতকেই বাংলা গদ্য ব্যক্তির চিন্তা ও আত্মপ্রকাশের পরিপূর্ণ বাহন হয়ে ওঠে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগার (১৮২০-১৮৯১) অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৭), ভূদের মুখোপাধ্যায় (১৮২৫-১৮৯৪), রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৯০০), রামগতি ন্যায়রত্ন (১৮৩২-১৮৯৫) প্রমুখের চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের স্বতন্ত্র বাহন হয়ে ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ বাংলা প্রবন্ধকে বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি দান করেন। পরবর্তী পর্যায়ে প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ মুজতবা আলী, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, হুমায়ুন কবির, গোপাল হালদার, বিনয় ঘোষ, অমিয় চক্রবর্তী, অন্নদাশঙ্কর রায়, আবু সায়ীদ আইয়ুব প্রমুখের চেষ্টায় বাংলা প্রবন্ধ বিষয়ভাবনা ও রূপ-রীতির পরীক্ষা নিরীক্ষায় বিশ্বমানে উপনীত হয়।

বাংলাদেশের প্রবন্ধ 

বাংলাদেশের প্রবন্ধের পটভূমি তৈরি হয় বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৯২১) পরিমণ্ডলে। মুসলিম সাহিত্য সমাজ ‘শিখা’ পত্রিকার (১২৬৯) মাধ্যমে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের চর্চা করতে গিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজ আধুনিক বুদ্ধি ও গভীর চিন্তা সম্বলিত প্রবন্ধ রচনায় মনোনিবেশ করেন। এ-পর্যায়ের লেখকদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আব্দুল কাদির, আবুল ফজল প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কাজী মোতাহার হোসেন, মুহাম্মদ এনামুল হক ১৯৪৭-এর দেশভাগের পূর্বেই বাংলাদেশকেন্দ্রিক স্বতন্ত্র প্রবন্ধশৈলীর ভিত্তি তৈরি করেন। 

১৯৪৭-এর দেশভাগের পর নতুন সামাজিক-রাষ্ট্রিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রাবন্ধিকগণ সাহিত্যবিচারের পাশাপাশি সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়েও প্রবন্ধ রচনা শুরু করেন। এ-সময়ের নবোদ্ভুত প্রাবন্ধিকদের মধ্যে আবু জাফর শামসুদ্দীন, রনেশ দাশগুপ্ত, শওকত ওসমান, আবদুল হক, সৈয়দ আলী আহসান, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, আহম্মদ রফিক, আনোয়ার পাশা, আহমদ শরীফ, হাসান হাফিজুর রহমান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিচিত্র পরিসরে এই সব প্রাবন্ধিকের চিন্তা ও অনুভূতি পরিভ্রমণ করেছে। এঁদের অব্যবহিত পরে প্রবন্ধ রচনায় মনোনিবেশ করেন বদরুদ্দীন উমর, আবদুল হাফিজ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আহমেদ হুমায়ুন, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখ। এঁদের প্রায় সকলেই বিচিত্র বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন। 

ষাটের দশকের নবোদ্ভূত প্রাবন্ধিকেরা প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ও ভাষারীতির ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা বিস্তারে মনোযোগী হন। এ-ধারার প্রাবন্ধিকদের মধ্যে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, হায়াৎ মামুদ, আহমদ ছফা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ আকরম হোসেন, শামসুজ্জামান খান, আবুল কাসেম ফজলুল হক, হুমায়ুন আজাদ উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রবন্ধের রূপ ও রীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এঁদের অবদান এখনো পর্যন্ত গতিশীল ও বৈচিত্র্যময়। 

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের প্রবন্ধ নিত্যনতুন চিন্তা ও চেতনায় সমৃদ্ধি লাভ করেছে। বিশ্বসাহিত্যের অনুভূতি ও চিন্তা স্রোতের সঙ্গে সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সাহিত্যের পর্যবেক্ষণেও নিত্যনতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে। 

বস্তুসংক্ষেপ 

প্রবন্ধ বলতে আমরা সাধারণত এমন এক ধরনের গদ্য রচনাকে বুঝি, যা আলোচনার মাধ্যমে কোনো বিশেষ বক্তব্য, দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা বিষয়-অন্তর্গত বক্তব্যকে উপস্থাপন করে চিন্তা এবং যুক্তির পরস্পর মিলনে পাঠককে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সহায়তা করে। প্রবন্ধ রচিত হয় সাধারণ পাঠকের দিকে লক্ষ্য রেখে। এ-কারণে প্রবন্ধের বিষয় বা পরিভাষার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো নীতি মেনে চলে না। বরং বক্তব্য বা বিষয় উপস্থাপনের প্রয়োজনে কখনো গল্প, কখনো দৃষ্টান্ত, কখনো কৌতুক, আবার কখনো সূক্ষ্ম-অনুভূতি প্রয়োগের মাধ্যমে পাঠকের বুদ্ধি ও যুক্তিকে জাগ্রত করাই প্রবন্ধের লক্ষ্য।

Leave a Comment

error: Content is protected !!