“অতপর একটি পোর্ট্রেট” পূরবী সম্মানিতের দ্বিতীয় ছোটগল্পের বই। প্রথম বইটি “আকালি বাড়ি যায়” সেখানে শ্রমজীবী নারীদের জীবনসংগ্রমের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। তবে এই বইটি মধ্যবিত্তদের নিয়ে লেখা। মোট ১৮টি গল্প আছে বইটিতে। প্রতিটি গল্পে নারী চরিত্র প্রধান হলেও শ্রমজীবী নারীদের মতো তারা চিন্তা-চেতনায় দিক থেকে স্বাধীন না।
মধ্যবিত্তদের মাঝে একটি রোগ আছে তার নাম পেটি বুর্জোয়া অস্থিরতা, যেটাকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন’ বইতে উল্লেখ করেছেন। ”বোভারিজম” একটি আচরনবিধি সম্পর্কিত শব্দ। যার অর্থ গরুর মতো জাবর কাটা। এই শব্দটি সেই সব ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা খুব ছটপটে, অস্থির, নীতি-কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন না, নিজের চাওয়া পাওয়াতে সন্তুষ্ট থাকেনা, ভুত-ভবিষত না ভেবেই সিদ্ধান্ত নেয়, একটুতেই বিচলিত হয়, অন্যের সফলতায় নিজেই হতাশ হয়ে পরে, চিন্তার ক্ষেত্রে স্বাধীন না ইত্যাদি; এক কথায় পেটিবুর্জোয়া অস্থিরতায় ভোগা ব্যক্তিরা। তবে এটা কোনো স্থায়ী বা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত রোগ না; চাইলেই ও চেষ্টা করলেই এই সমস্যা থেকে যেকোন ব্যক্তি বেরিয়ে আসতে পারে।
এই বইতে ‘রাজকন্যার মৃত্যু’, ‘অতপর একটি পোর্ট্রেট’, ‘আইনতঃ… ধর্মতঃ স্ত্রী’ গল্পগুলোতে লেখক মধ্যবিত্তের সেই আচরণগুলো তুলে ধরেছেন। আমরা এসব ঘটনা সচরাচর দেখে থাকি; কিন্তু সেগুলো আমাদের ভাবিয়ে তোলে না। লেখকের মগজকে যেমন ভাবিয়ে তোলে তেমনি কলমের আঁচড়ে গল্প হয়ে ওঠে।
‘রাজকন্যার মৃত্যু’ গল্পে বাবার ইচ্ছাতেই শিল্পপতির সাথে গল্পের নায়িকার বিয়ে হয়। আবার বিচ্ছেদও হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার বিয়ে হয়। এই দুই বিয়েতে রাজকন্যার কোনো মতামত নাই। তাই নিজের ইচ্ছায় সাহিত্যচর্চা শুরু করে। কবিতার বই বের হয়; বন্ধুমহলে নিজেস্ব পরিচয় তৈরি হয়। কিন্তু সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। নিজেকে কোনো এক অদৃশ্য রাগ, অভিমান, ক্ষোভে নিঃশেষ করে দিতে থাকে। নিজের সৃজনশীলতার থেকে সন্তানকে তৈরি করার দিকে মনোযোগী হয়। গল্পের শেষে দেখা যায় স্বামী, সন্তান, সংসার কোনটার জন্যই নিজেকে যোগ্য মনে করছে না। জীবনের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে।
‘দ্যা রুট’ নাবিলা অল্প বয়সেই অন্ধকার অধ্যায়ে প্রবেশ করে। সমাজের পিচ্ছিল পথে একটু অমনোযোগী হলেই উঠে দাড়ানো কঠিন হয়ে যায়। নাবীলার জীবনেও তাই হয়েছে। পতিতার জীবন থেকে শুরু করে একের পর এক হাত বদল হয়েছে কিন্তু ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় নি।
‘যুবতীটি শহরের প্রধান সড়কে’ গল্পে মধ্যবিত্ত সুশীল পাড়ার রাস্তায় এক পাগলী এসে বসে থাকে। এটা নিয়ে নানাজনের নাকসিটকানো, জল্পনাকল্পনা, পুলিশ তদন্ত শুরু হয়।
‘আইনতঃ… ধর্মতঃ স্ত্রী’ ঈশিতার বাবা সত্যরঞ্জন মেয়ের বিয়ে খুব তাড়াহুড়ো করে দেয়। ছেলে আমেরিকায় থাকে। বিয়ের পরে জানতে পারে বিদেশে ছেলের স্ত্রী আছে। ঈশিতা চিন্তা করতে থাকে বিয়ের পরের দিনগুলোকে নিয়ে; সুন্দর, প্রেমময় সময় কেটেছিলো তাদের। কিন্তু তার পরিবার চিন্তা করে ছেলের পরিবারকে আইনের কাঠগড়াতে দাঁড় করাবে কি করে? সামন্তীয়, পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার কাছে নারী হয়ে থাকে ভোগ্য পণ্য। ঈশিতার বাবার অহংকার, লোভের কাছে পরিবারের অন্যদের কথার মূল্য থাকে না। এইক্ষেত্রে মেয়েদের যতটা সাহসী, শক্তিশালী হতে হবে তেমনটা ঈশিতার ছিলনা। এমন কি শিক্ষিত হওয়ার পরেও সে মতামত দিতে পারে নি জীবনের গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্তে। এছাড় হিন্দু বিবাহ ব্যবস্থায় আছে সীমাবদ্ধতা। নারীকে অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে অন্যের অধীনে রাখতে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে রয়েছে নানা শর্ত।
‘তামস গহ্বর’ গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে আসে নিলুফা। সে জানেনা জীবনের নানা জটিলতাকে। শুধু সুন্দর, স্বাভাবিক স্বপ্নগুলোকে অন্যের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু প্রতারণার শিকার হয়ে জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তার গর্ভে বড় হতে থাকে প্রতারক প্রেমিকের সন্তান। ক্লিনিকের দ্বার থেকে ফিরে গিয়েছে নিলুফা; এক নতুন প্রাণের জন্ম দিবে সে। কিন্তু জীবনে ভুল ঘটে গিয়েছে তাকে আবার বহন করতে চাওয়া সেটাও এটাও ভুল।
‘আজ বসন্ত’ বয়স:সন্ধিকালে আবেগের প্রকাশ। ক্লাসের এমন কোন বন্ধু থাকে যাকে প্রতিদিন দেখার জন্য মন অস্থির হয়ে থাকে। এই সময়ই ছেলে-মেয়েরা নানা ভুল করে থাকে। যারা সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারে তারাই জীবন সিঁড়ির কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতে পারে।
‘অতপর একটি পোর্ট্রেট’ পেটিবুর্জোয়া অস্থিরতা। যেটাকে বোভারিজম বলে। মিথিলা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। সোশ্যাল মিডিয়া মাধ্যমে অনিরুদ্ধের সাথে পরিচয়। তাদের সম্পর্কের গাঢ়ত্ব হয় সাহিত্যচর্চাকে কেন্দ্র করে। অনিরুদ্ধের সাহিত্য পত্রিকায় কবিতা ছাপানোর পরে একসময় মিথিলার কাব্যগ্রন্থ বের হয়। একসময় জানতে পারে অনিরুদ্ধ বিবাহিত। জীবনের একটি অংশকে একেবারে আড়ালে রেখে আরো একটি সম্পর্ক করা মিথিলার কাছে মনে হয়েছে তার সাথে অনিরুদ্ধ অন্যায়, প্রতারণা করেছে। আধুনিক চিন্তা, ধর্মীয় সংস্কার থেকে মুক্ত, সাহিত্যমনা, আত্ননির্ভর মেয়ে হয়েও অতি অস্থিরতার কারণে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ মিথিলা। এক সম্পর্ক থেকে কষ্ট ভুলতে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সে। নিজের দক্ষতা, য্যোগতা, ব্যক্তিত্বে কোন মূল্যায়ন নেই তার কাছে।
‘ও কেন এত সুন্দরী হলো’ জবা ও জনির প্রেম হয় কিন্তু পরিবার না মানলে বিয়ে না করা। জাতের দিক থেকে যেমন উঁচু নিচুর ব্যপার আছে তেমনি মায়ের অলংকার পাবার লোভ আছে মেয়ের। স্ত্রী শেফালী স্বামীর চেয়ে দক্ষ ও যোগ্য কিন্তু তার উপার্জনের মূল্যায়ন নাই পুরুষতান্ত্রিক সামাজ।
‘প্রজন্ম শ্রমদাস’ মধ্যবিত্ত জীবনে সন্তানকে শ্রেষ্ট বানানো প্রধান কাজ। শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে সন্তান সমাজের অংশ। সমাজ থেকে শিক্ষা নিবে, নিজের মতো বেড়ে উঠবে। এছাড়া গরিবের কাছে সন্তান মানে আয়ের উৎস। যতদ্রুত সমাজের চাকা চালানোর কাজে লাগবে ততই ভালো।
‘ডকুমেন্টারির শেষ অংক’ গল্পে ফরজ আলী দাদার চরিত্রে যিনি আছেন তিনি চিন্তায় সামন্তীয়। যুদ্ধের সময় ছিলেন রাজাকার। এক সন্তান মারা যাবার পড়ে নাতনীকে নিয়ে নানা স্বপ্ন তার। নাতনী দেশের বাইরে লেখাপড়া করে। দেশে ফিরবে মুক্তিযুদ্ধের উপর ডকুমেন্টারি তৈরি করার জন্য। দাদা নাতনীর জন্য ইউরোপীয়ান স্টাইলে রুম সাজায়, গ্রামে লোকদের জন্য খাওয়ার আয়োজন করে ইত্যাদি।
ফরজ আলীর কাজের মহিলাদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক করে। এক কাজের মহিলার ছেলে খলিল; গল্পের মাঝামাঝি জানা যায় সে তারই সন্তান। গ্রামের অনেকেই ফরজের কুকর্ম সম্পর্কে জানে কিন্তু ভয়ে কিছু বলেনা। অনেক সম্পত্তি থাকার কারণে পারিবারিক জটিলতা তৈরি হয়। ফরজ আলী তা মিটাতে চাইলেও নাতিনীর এই বিষয়ে কোন আগ্রহই নেই। একদিন সকালে জানা যায় ফরজ আলী রহস্যজনক মৃত্যু কথা। নাতনী বিদেশ থেকে এলেও দাদার মৃত্যুতে কোন শোকের চিহ্ন নেই।
‘কুসুম কথা’ মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির দুই নারীর জীবনের গল্প ও ঠিকে থাকার লড়ায়। একজন চাওয়া পাওয়াকে রাস্তায় পিষ্ট হতে দেখেছে অন্যজন ড্রয়ংরুমে সাজানো ফুলদানির মতো ভাঙতে দেখেছে।
‘ওরা থাকে ওদের বলয়ে’ একই গ্রামে বেড়ে ওঠা বন্ধু মিনু ও ইমন। তাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক থাকে। এক সময় দুজনের চিন্তা, কাজে অনেক মিল ছিল। মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তে যায়, তখন নতুন পরিবেশের সাথে পরিচয় হয়। আধুনিকতার নামে পরিবেশ, সংস্কৃতির ক্ষয়কে মিনু মানতে পারে না। কিন্তু এর জন্য তার ব্যক্তিগত কোনো ভূমিকাও দেখা যায় না। তার বন্ধুরা গ্রামে বেড়াতে আসে। ধনী পরিবারের ছেলে মেয়েরা পরিবেশ যা উপভোগ করে তারচেয়ে নষ্ট করে বেশি। এছাড়াও অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে চিন্তাগত পার্থক্য।
পূরবী সম্মানিতের বই সম্পর্কে আলোচনা দেখুন
‘জুতা সেলায় থেকে চন্ডী পাঠ’ পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার কাছে নারীর পরাজয়। নারী যদি নিজের ব্যক্তিত্ব না বুঝে তাহলে নিজেকে উপস্থাপন ঠিকভাবে করতে পারে না। শুধুই যদি একজন ভালো বউমা, স্ত্রী, মা, কন্যা হতে চায় তাহলে নানা অন্যায় মেনে নিয়ে সুখী সংসার গড়তে হয়। এই গল্পে তেমনটাই হয়েছে। প্রচলিত পরিবারগুলোতে যা ঘটে সেটাই উঠে এসেছে এই গল্পে।
‘লাবন্য প্রভার কৈল্যাস যাত্রা’ হিন্দু বিয়ে রেজিস্ট্রি যেটা সময়ের দাবি। বৈবাহিক সম্পর্কে তালাক ব্যবস্থা না থাকায় নানাভাবে মেয়েদের নির্যাতন সহ্য করে থাকতে হয়। এছাড়াও নিজের সিদ্ধান্ত নিয়েও হেনস্তার স্বীকার হতে হয়।
‘শেয়াল, মুরগী ও লছমী’ শ্রমিকের জীবন ও বাস্তবতা নিয়ে গল্পটি। এই শ্রেণির নারীটি জানে যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী শুধু ভোগের জিনিস। তাই মালিকের ছলে রাজি না হয়ে নিজের কাজ দায়িত্বের সাথে করতে থাকে। লছমীর মধ্যে মধ্যবিত্তের রোগ না। স্বামী তার কাছে মহান কিছু না, নিজের গতর যতদিন চলে ততদিন সে উপার্জন করেই নিজের পেট চালাবে।
‘অতপর একটি পোর্ট্রেট’ বইটির গল্পগুলো উঠে এসেছে সমাজের বাস্তব কাহিনী থেকে। দু একটি গল্প ছাড়া বাকিগুলো মধ্যবিত্ত নারীদের নিয়ে লেখা। সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, সন্তান জন্ম দেয়া নারীত্বের পূর্ণতা আনে। কথাটি পুরুষতান্তিক হলেও নারীদের মুখে বেশি শোনা যায়। তাহলে কি একটি নারী বিয়ে আগে পুর্নাঙ্গ থাকে না?
কোন ব্যক্তি যা অর্জন করে সেটা দিয়েই তাকে মূল্যায়ন করতে হয়। বিয়ে, সন্তান, ধর্ম, সংসার এই সব সমাজের প্রচলিত ধারা থেকে চলে আসে। কিন্তু সন্তান জন্মদানকে যদি কেউ মহৎ কাজ মনে করে তাহলে সেটা হবে পুঁজিবাদে প্রদান করা যান্ত্রিক জ্ঞান। অর্থনীতি, উত্তরাধিকা, সভ্যতা নির্মাণে সন্তান জন্ম বা মানুষ দরকার। কিন্তু এটা যদি নারীর জীবিনের জন্য আবশ্যিক কাজ মনে করা হয় তাহলে সেটা ভুল চিন্তা। তামস গহ্বর, জুতা সেলায় থেকে চন্ডী পাঠ গল্পে দেখা যায় সন্তান লালন পালন ও জন্মই প্রধান হয়ে ওঠে।
‘অতপর একটি পোর্ট্রেট’ বইতে লেখক মধ্যবিত্ত নারীদের জীবন সংগ্রামের ভুলগুলো, পেটিবুর্জোয়া অস্থিরতা, ব্যক্তিত্ব তৈরিতে ব্যর্থতা, শ্রমিক নারীদের থেকে দুর্বল আত্মশক্তির অধিকারী। এছাড়াও সমাজ কতৃক নারীর জন্য বেঁধে দেওয়া সীমারেখাকে তুলে আনার চেষ্টা করেছে গল্পকার।
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।