ছোটগল্প ও উপন্যাসের পার্থক্য (ইংরেজি: The difference between Short story and Novel) এবং সাহিত্যের এই দুই ধারার তুলনামূলক আলোচনা হচ্ছে কথাসাহিত্যের বিশ্লেষণের ধারা। ছোটগল্পের সাথে উপন্যাসের মিল যেমন রয়েছে তেমনি আছে তার অমিল। উপন্যাসের মধ্যে আমরা জীবনের ব্যাপক গভীর পরিস্থিতির রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু ছোটগল্পে ঘটে একান্ত পরিস্থিতির রূপায়ণ। কিন্তু কেবল আকৃতির পার্থক্য দিয়ে ছোটগল্প ও উপন্যাসের স্বাতন্ত্র নির্দেশ করা যাবে না। ঘটনাংশ, চরিত্র, দৃষ্টিকোণ, পরিচর্যারীতির যথাযথ বিন্যাস দুটো সাহিত্যরূপের জন্যই অনিবার্য।
কোনো কোনো ছোটগল্প আয়তনের দিক থেকে উপন্যাসের সমমাপেরও হতে পারে। সুতরাং এ-দুয়ের পার্থক্য নিরূপণের জন্য আমাদেরকে এর প্রকৃতি ও মর্মগত বিভিন্নতার স্বরূপ সন্ধান করতে হয়। বহুমুখী ঘটনা, বিচিত্র চরিত্র, সমাজ ও সময়ের বিশাল প্লট উপন্যাসে মানবজীবনের পরিপূর্ণতা (Entirety) সৃষ্টির লক্ষে গৃহীত হয়। আর ছোটগল্প এই বিশাল জীবনেরই একটা অংশের সমগ্রতা (Totality) ঘটনা, চরিত্র, দৃষ্টিকোণ ও পরিচর্যারীতির দক্ষ বিন্যাসে সৃজন করা হয়। এই Totality বা সমগ্রতা শব্দটি উপন্যাসের স্বভাব নির্দেশের ক্ষেত্রেও কোনো কোনো সমালোচক প্রয়োগ করেছেন। আমরা দুটি সাহিত্যরূপের পার্থক্য নির্দেশের প্রশ্নে পরিপূর্ণতা ও সমগ্রতা শব্দদ্বয় ব্যবহার করছি।[১]
বিগত এক-দেড়শ বছরে ‘ছোটগল্প’ শিল্পরূপটি এত বিচিত্রভাবে নানা ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে যে একটি সর্বজনীন সংজ্ঞায় এটিকে ধরা অসম্ভব। কিন্তু ‘ছোট’ এবং ‘গল্প’ শব্দ-দুটির নির্দিষ্ট অর্থময়তার কারণে ছোটগল্পের মধ্যে আকারে ছোট একটি গল্প দাবী রেখেছেন কেউ কেউ। কিন্তু ছোট শব্দটি এত আপেক্ষিক এবং বহু ধ্রুপদী গল্প এতই গল্পহীন যে এই মত সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে কোনো কোনো সমালোচক আকারের চেয়ে প্রকার এবং গল্পের চেয়ে বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন বেশি। এর মধ্যে এই শিল্পরূপটিকে বৈচিত্র্যে বুঝার তাগিদ রয়েছে এবং রীতিটিও অবরোহী ফলে আধুনিক সমালোচনায় এই ভাবনা অনেকখানি মান্যতা পেয়েছে। আর এখন প্রায় সকলেই মেনে নিয়েছেন যে বৈচিত্র্য ছোটগল্পের দায় নয় — অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
ছোটগল্প যে উপন্যাস নয় কিংবা উপন্যাসের খণ্ডাংশ — তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ছোটগল্প শিল্পরূপের ভিন্ন শিল্প-প্রকরণ। এই ভিন্নতাকে মেনে নিতে কিছু কিছু পাঠক সমালোচকদের প্রাথমিক অসুবিধে হয়েছিল। তার থেকেই কাব্যধর্মী গল্প চিত্রধর্মী কাহিনী ইত্যাদি মতামতের সৃষ্টি। তেমনই সমালোচনার মুখে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘অসংখ্য ছোট ছোট লিরিক লিখেছি, বোধ হয় পৃথিবীর কোনো কবি এত লেখেন নি। কিন্তু আমার অবাক লাগে, তোমরা যখন বলো যে, আমার গল্পগুচ্ছ গীতিধর্মী।… ধরো একটা খ্যাপাটে ছেলে সারা গ্রাম দুষ্টুমির চোটে মাতিয়ে বেড়ায়, তাকে হঠাৎ একদিন চলে যেতে হলো শহরে আর মামার কাছে। এইটুকু চোখে দেখেছি, বাকিটা নিয়েছি কল্পনা করে। একে কি তোমরা গান-জাতীয় পদার্থ বলবে?’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন অবাক লাগে’, বোধ হয় অসহায় বোধ করেছিলেন, কারণ রূপক-প্রতীক-ব্যঞ্জনার্থ ইত্যাদি দিয়ে ছোটগল্পের যে শৈলী প্রকরণ তিনি গড়ে তুলছিলেন তা ছোটগল্পের জাত নষ্ট করছে এমন এক ইঙ্গিত ছিলো কাব্য-কবিতা’ ইত্যাদি শব্দে।
ছোটগল্পের ছোটর নির্মাণ যে শিল্পীর একটি বড় দায় এমন কথা ছোটগল্পকাররা মাঝেমাঝেই মনে করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন বেতার-কেন্দ্রের চৌম্বক ফিতে সম্পাদনার সময় শ্বাস, ক্ষণিক এবং নীরবতাকে যত্নে সংরক্ষণ করতে হয়, বাদ দিতে হয় অন্য অংশ ( হাইনরিশ ব্যোল-এর মাকে’স কালেকটেড সাইলেনসেস ১৯৫৮)। ছোটগল্পকে হয়ে উঠতে হয় এমন এক নির্মাণ যার প্রতিটি শব্দ অনিবার্য। ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড-এর ভাষায় এক শব্দও স্থান বিচ্যুত নয়, একটি শব্দও নয় বাড়তি। গদ্যে লেখা হলেও ছোটগল্প , উপন্যাস কিংবা উপন্যাসের নাতিদীর্ঘ সংস্করণ নয় তার নিদর্শন মেলে যে কোনো উল্লেখযোগ্য গল্পের প্রতিটি বাক্যেই।[২]
তথ্যসূত্র:
১. বেগম আকতার কামাল, ভীষ্মদেব চৌধুরী, রফিকউল্লাহ খান ও অন্যান্য, বাংলা ভাষা: সাহিত্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, পুনর্মুদ্রণ ২০১১, পৃষ্ঠা ১৯।
২. রামকুমার মুখোপাধ্যায় সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ২২৬-২২৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।