গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হচ্ছে ব্যক্তিগত উন্নতি ও সমষ্টিগত স্বপরিচালনার সোপান

গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি (ইংরেজি: Democratic Culture) বা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বা উদারনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে এমন একটি সংস্কৃতি যেখানে ব্যক্তিকে এমন মূল্যবোধ তৈরির রূপগুলিতে অংশ নেওয়ার উপযুক্ত সুযোগ দেয়া হয় যা তাদেরকে ব্যক্তি হিসাবে গঠন করে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতার পাশাপাশি সমষ্টিগত স্বপরিচালনা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়; এটি সংস্কৃতির উৎপাদন এবং বিতরণে অংশ নিতে প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষমতাকে সম্পৃক্ত দেয়।

সংস্কৃতির ধারনায় বলা হয় যে, মানুষেরই শুধু সংস্কৃতি আছে যা অন্য প্রাণীর নেই; আর এই সংস্কৃতিই তার জীবনকে উন্নত করে। মানুষের ইতিহাস অন্য প্রাণী থেকে পৃথক হয়েছে তার সংস্কৃতির কারণে। সংস্কৃতির শক্তিতে মানুষ বেঁচে থাকে, সংস্কৃতির সাহায্যে সে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে, প্রকৃতিকে কাজে লাগায়, পরিবেশকে উন্নত করে। সংস্কৃতি মানুষের জীবন, পরিবেশ, কর্ম, উদ্দেশ্য ও বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াকে উন্নত, সুন্দর, রুচিশীল, সত্যপরায়ণ, ন্যায়বোধসম্পন্ন ও আধুনিক করে।

সংস্কৃতির সাহায্যে মানুষ অতীতের অন্যায়কে বর্জন করবার ধারণা পায়, নতুন ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে, নতুন মূল্যবোধ তৈরি করে, কর্মপদ্ধতিতে নৈপুণ্য অর্জন করে, অর্থাৎ মানুষের শিল্প-সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদির অগ্রগামিতার বাহক হিসেবে কাজ করে সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতি একটি নির্দিষ্ট সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির সাথে মিলে কাজ করে।

গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি

অর্থনীতি হচ্ছে সমাজের বুনিয়াদ, সংস্কৃতি হচ্ছে সেই সমাজের ডালপালা; আর রাজনীতি হচ্ছে অর্থনীতিরই ঘনীভূত প্রকাশ। মতাদর্শগত রূপ হিসেবে কোনো নির্দিষ্ট সংস্কৃতি সেই নির্দিষ্ট সমাজের রাজনীতি ও অর্থনীতিরই প্রতিফলন। সেই সংস্কৃতি আবার সেই নির্দিষ্ট সমাজের রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করে এবং সেগুলোর মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সমাজের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির এই পারস্পরিক সম্পর্ক ও অবস্থানই হলো সংস্কৃতি সম্পর্কে মার্কসবাদের মূল দৃষ্টিভঙ্গি।[১]   

বাংলাদেশে এখন দুই ধরনের সংস্কৃতি বিরাজমান। প্রথমটি হচ্ছে পশ্চাৎপদ প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি। এই প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির উৎস প্রধানত তিনটি। এই উৎস তিনটি হচ্ছে যথাক্রমে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ। এই উৎস তিনটি থেকে আসে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর দালালি সংস্কৃতি, সামন্তবাদ দ্বারা পুষ্ট সামন্তীয় সংস্কৃতি এবং পুঁজিবাদ নির্ভর বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। আর অন্যদিকে এই পশ্চাৎপদ প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির বিপরীতে আছে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ নির্ভর এই তিন প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতিই ভাববাদী ও পশ্চাৎপদ ধ্যানধারনার সাথে যুক্ত। আত্মবিক্রয়, পরাধীনতা, সম্পত্তিলোভ, ব্যক্তিগত সম্পত্তিজাত মানসিকতা, নিপীড়ন, আমলাতান্ত্রিকতা, সাম্রাজ্যবাদনির্ভরতা, কুসংস্কার, ধর্মব্যবসা, পরগাছাবৃত্তি, শ্রমহীনতা, পুরনো নীতি, পুরনো ভাবধারা, নারীপীড়ন ইত্যাদি পশ্চাৎপদ সংস্কৃতি এবং এ সংস্কৃতি নতুন সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরোধিতা করে।

সামাজিক অনুশীলন, সমতাভিত্তিক মূল্যবোধ, যৌথকর্ম ও যৌথপ্রচেষ্টা, সামাজিক মূলধন, সামাজিক বিকাশ, সামজিক সম্পর্ক, যূথবদ্ধতা, গণতন্ত্র চর্চা, বস্তুবাদী দর্শন চর্চা, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা, বিশ্বায়ন সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসন বিরোধিতা, স্বাধীনতা-সমতা-ভ্রাতৃত্ব, পুঁজিবাদ বিরোধীতা, নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য লড়াই, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ অভিমুখী গণসংগ্রাম ইত্যাদিতে যে সংস্কৃতি বিরাজমান তাই সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির সেবা করে। ভবিষ্যতের নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণের চেষ্টা হচ্ছে জনগণের বিপ্লবী সংস্কৃতি। আমরা যদি রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, পরিবার, সমাজ, প্রশাসন, আইন ও বিচার, অর্থনীতি, শ্রমব্যবস্থাপনা, প্রচারমাধ্যম, শিক্ষাব্যবস্থা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা ইত্যাদিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই তবে এসব বিষয়ের ওপরে সুস্পষ্ট ধারনা অর্জন করতে হবে এবং জনগণের জীবন ও পরিবেশকে উন্নত করার জন্য বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি দ্বারা এসব বিষয়ের উন্নতি ঘটাতে হবে।

একমাত্র সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণ করবার ধারাবাহিক চেষ্টার মাধ্যমেই প্রগতিশীলতাকে অর্জন করা যেতে পারে। এই সাম্যবাদী সমাজের আশাবাদের গানটি আছে সমতার দিন নির্মাণের অবিরত সংগ্রামের মাঝে। সমতার সমাজ নির্মাণ একটি ধারাবাহিক বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া, কিন্তু এই সমাজ কিভাবে তৈরি করতে হবে এই প্রসঙ্গে ভি আই লেনিন লিখেছেন যে, ‘পুঁজিবাদ সংস্কৃতি যোগায় কেবল সংখ্যাল্পদের। অথচ সমাজতন্ত্র গড়তে হবে এই সংস্কৃতিটা থেকেই, অন্য মালমসলা আমাদের নেই’।[২]  পুঁজিবাদী সমাজে অন্য মালমসলা থাকে না, সামন্তবাদ পুঁজিবাদের মালমসলা দিয়েই সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়তে হবে।

প্রতিটি সমাজের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটান সেই সমাজের শ্রমিক, কৃষক, মনিষী, বিজ্ঞানী ও অন্যান্য সৃষ্টিশীল ব্যক্তিরা। এ-প্রসঙ্গে  শিবনারায়ণ রায় (১৯২১ – ২০০৮) লিখেছেন,

‘মনিষী তাঁরাই যারা পূর্বসূরিদের দ্বারা সৃজিত এবং অর্জিত সাংস্কৃতিক সম্পদের সংগে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত, যারা সেই উত্তরাধিকারের মূল্যায়নে সমর্থ, যারা সেই সম্পদের সংরক্ষণে সচেষ্ট এবং তারি সংগে সংগে যারা নব নব রূপের উদ্ভাবনে সক্ষম, যারা নব নব জিজ্ঞাসায় ব্যাপৃত, যারা স্বকীয় সৃষ্টির দ্বারা ঐতিহ্যকে সম্পন্নতর করতে উদ্যোগী। সূক্ষ্ম অনুভূতি এবং নিপুণ প্রকাশ-সামর্থ্যের অনুশীলনে এরা নিরলস; নাচিকেত প্রশ্নশীলতা এবং অদম্য সৃজনপ্রেরণার অধিকারী হওয়ার ফলে অভ্যাসের জড়তা থেকে এঁরা অনেকটা মুক্ত। দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক এবং ঐতিহাসিক, শিক্ষক, সাহিত্যিক এবং শিল্পী_ এঁরাই হলেন যে কোনো সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রধান উৎস। সৃষ্টি, আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনের দ্বারা এঁরা সংস্কৃতির সম্পদ বৃদ্ধি করেন; অপরপক্ষে বৈদগ্ধ এবং নিষ্ঠার দ্বারা এঁরা অর্জিত সংস্কৃতিকে অবক্ষয় এবং নিম্নগামিতার হাত থেকে রক্ষা করেন।’[৩]

এইখানে শিবনারায়ণ রায় যে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের সংস্কৃতির প্রধান কাণ্ডারি হিসেবে উল্লেখ করছেন যা মূলত পুঁজিবাদী সংস্কৃতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক ও কৃষকদের সৃষ্টিকে সংস্কৃতির অন্যতম প্রেরণা ও শক্তিশালী উৎস হিসেবে বর্ণনা করলে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে যথার্থ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।[৪]

তথ্যসূত্র ও টিকা:

১. অনুপ সাদি, লেনিন ও সংস্কৃতির কয়েকটি দিক, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শতবর্ষ স্মারক সংকলন, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন কমিটি, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১১৫
২. ভি আই লেনিন, সোভিয়েত রাজের সাফল্য ও বিঘ্ন, ১৯১৯, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৬৮; পৃষ্ঠা ৪৬
৩. শিবনারায়ণ রায়; গণতন্ত্র, সংস্কৃতি ও অবক্ষয়; দেজ পাবলিশিং; কলকাতা; তৃতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০০০; পৃষ্ঠা-৪১।
৪. প্রবন্ধটির অংশবিশেষ আমার [অনুপ সাদি] রচিত ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং সাম্প্রতিককালে পরিবর্ধিত। 

Leave a Comment

error: Content is protected !!