কমেডি হচ্ছে প্রধানত নাটকের একটি ধরন যেখানে বিষয়বস্তু হাস্যরসাত্মক

কমেডি (ইংরেজি: Comedy) হচ্ছে সাধারণভাবে সেই সাহিত্যকর্ম যেখানে বিষয়বস্তু এমনভাবে নির্বাচিত ও উপস্থাপিত হয় যেন তা আমাদের উৎফুল্ল করে তুলতে সক্ষম হয়। কমেডিতে চরিত্রের দুর্বিপাকে আমরা খুব চিন্তিত হই না। আমরা জানি এখানে সাংঘাতিক কোনো বিপর্যয় ঘটবে না এবং নাটকের শেষাংশ প্রধান চরিত্রদের জন্য সুখকর ও আনন্দদায়ক হবে। কমেডি কথাটি সচরাচর নাটক সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু স্মরণ রাখা দরকার যে কমিক ফর্ম বিবেচনা করতে গেলে কথাসাহিত্য এবং কাহিনীকাব্যকেও তার আওতায় আনা দরকার। 

কমেডির প্রতিশব্দ রূপে বাংলায় অনেক সময় মিলনান্তক নাটক কথাটি ব্যবহৃত হয়। স্পষ্টতই ট্র্যাজেডির বাংলাকে বিয়োগান্তক নাটক বিবেচনা করেই তার বিপরীত মেরুতে কমেডিকে স্থাপন করে মিলনান্তক শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ট্র্যাজেডিকে যদি বিষাদাত্মক কিংবা করুণ রসাত্মক নাটক বলি তবে কমেডিকে হয়তো হাস্যরসাশ্রয়ী কৌতুক রসাত্মক নাটক বলতে পারি।[১]

‘কমেডি’ জীবনের অপেক্ষাকৃত লঘুতর, স্বল্পভার, হাস্যোদ্দীপক ও আনন্দময় পরিবেশন। যদিও অ্যারিস্টটল তার দি পোয়েটিকস-এ কমেডি নিয়ে খুব কম কথাই খরচ করেছেন, তবুও সেখানে তিনি বলেছেন কমেডির মূলে রয়েছে ‘some defect or ugliness that is not painful or destructive’। প্লেটো ও হবসের চিন্তায় কমিক নাট্যকার নিজের অপেক্ষাকৃত উচ্চতর অবস্থান ও কমিক চরিত্রের হীনতর, সামঞ্জস্যহীন ও সামাজিক আচরণবিধি থেকে স্খলিত অবস্থানের মধ্যে ফারাক বিবেচনা করে, পরেরজনকে হাস্যকর প্রতিপন্ন করেন।

বের্গস বা ফ্রয়েডের মতেও কমেডির উৎপত্তি কোনও অস্বাভাবিকত্ব বা অসংগতি থেকেই। অ্যারিস্টোফেনিসের (৪২৫-৩৮৮ খ্রিঃ পূঃ) হাতে গোনা কয়েকটি ব্যঙ্গাত্মক কমেডিকেই এই শিল্পরূপের প্রাচীনতম উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। যদিও এ ধরনের ‘ওন্ড কমেডি’-তে ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়, তবুও এই কমেডিগুলোতে একটি স্পষ্ট মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা ও উদ্ভট কল্পনার ছাপ প্রচ্ছন্ন। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে ‘নিউ কমেডি’ নামক আরো এক ধরনের কমেডি বিকশিত হয় গ্রিক মিনান্দারের (খ্রিঃ পূঃ ৩৪২-২৯১) হাতে। পরে এই ধারার অনুকরণ করেন প্লটাস (২৫৪-১৮৪) ও টেরেন্স (১৯০-১৫৯) নামক দুই রোমান নাট্যকার।

প্রাচীন এই নাটকগুলোকে সমাজ বাস্তবতার প্রত্যক্ষতা লক্ষ করে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে কমেডি ঐতিহাসিকভাবে ট্র্যাজেডির থেকে অনেক বেশি সমাজ সচেতন এবং এতে বিভিন্ন সামাজিক দুর্নীতি, অধঃপতন, অবক্ষয়কে আক্রমণ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে কমেডির চরিত্ররা মূলত একমাত্রিক বা স্টক ক্যারেক্টারস, যাদের সমগ্র নাটকের গতিপথে কোনো পরিবর্তন হয় না। কমেডির জন্ম ফার্সের গর্ভে একথা নিয়ে কোনো বিবাদ নেই। কিন্তু ফার্সের মূল লক্ষ্য যেখানে ভাড়ামি (buffonery) পেটে খিল ধরানো চটুল মোটাদাগের হাসি (belly-laughs), সেখানে প্রকৃত কমেডির উদ্দেশ্য বুদ্ধিদীপ্ত ও চিন্তা উদ্রেককারী হাস্যরস (‘intellectual laughter’… মেরেডিথ)।

সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি নাট্যকার মলিয়ের (১৬২২-৭৩) কমেডির অন্যতম সুদম স্রষ্টা। মলিয়েরের কমেডি (উদাহরণ-দি মিসানপ) উৎকর্ষের যে মানদণ্ড তৈরি করে, তা ছুঁতে না পারলেও একদল ইংরেজ নাট্যকার-কংগ্রেভ, উইচার্লি, ইথারেজ, ভ্যান।

‘কমেডি অব ম্যানারস’ নামক এক জাতীয় সামাজিক ব্যঙ্গাত্মক কমেডি লেখা শুরু করেন। এদের যোগ্য উত্তরাধিকারী গোল্ডস্মিথ, শেরিডান, অসকার ওয়াইন্ড কমেডিকে পৌছে দেন এক নতুন উচ্চতায়। কমেডি হয়ে ওঠে সূক্ষ্ম, ঝকমকে, চূড়ান্ত বুদ্ধিদীপ্ত, চটজলদি উপস্থিত বুদ্ধিনিষ্ঠ বাদানুবাদ (verbal repatee) সমৃদ্ধ। এ ধরনের কমেডি মূলত উচ্চবিত্ত জীবনের বৈভর, ভণ্ডামি, স্বার্থপরতা, যৌনবিকৃতি, অন্তঃসারশূন্যতা, ষড়যন্ত্রকেই আক্রমণের লক্ষ করে। শেক্সপিয়রের সমসাময়িক বেন জনসনের কমেডি অব হিউমারস প্রাচীন গ্রিক কমেডির আঙ্গিকের সঙ্গে, মধ্যযুগীয় ধারণা ‘humours’ এর মিশেল ঘটিয়ে আক্রমণ করে মানুষের প্রবৃত্তিগত ঘৃণ্য বৈশিষ্ট্যগুলোকে। জনসনের ‘হিউমারস’ কমেডিতে ব্লড, কোলের, ফ্রেম, বাইল প্রভৃতির অসঙ্গতিজনিত কারণে মানুষকে বিভিন্ন চারিত্রিক ত্রুটির শিকার হতে দেখা যায়। এই হিউমারস’কে ‘হিউমার বা নির্মল হাস্যরস হিসেবে দেখলে ভুল হবে। পক্ষান্তরে শেক্সপিয়রের কমেডি বা রোমান্টিক কমেডির জগত সম্পূর্ণ কল্পনাশ্রিত, স্বপ্নালু, কাব্যিক, অপেক্ষাকৃত নির্বিষ, কমিক ও ট্র্যাজিক উপাদানের নিয়ন্ত্রিত মিশ্রণে আবেগপ্রধান। প্রাচীন নিউ কমেডি ধারার আভাসযুক্ত এই কমেডির অন্যান্য অনুশীলনকারীরা হলেন বোমাঁ, ফ্লেচার, মিডলটন, মার্সটন প্রভৃতি।

সপ্তদশ শতাব্দীতে এই ধারার নাটক রিচার্ড স্টিল, হিউ কেলিদের হাতে যথেষ্ট সেন্টিমেন্টাল হয়ে উঠতে থাকায়, এর বিরুদ্ধে যে অ্যান্টি-সেন্টিমেন্টাল ধারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে তা শীর্ষবিন্দু ছোঁয় বানার্ড শ’-এর শেভিয়ান কমেডিতে। শ’ তার plags pleasantplags unpleasant-এর মাধ্যমে মেরামত করতে চান প্রথাসিদ্ধ ও ভ্রন্তি-জর্জরিত ধারণাগুলো। সে জন্যই তার কমেডিকে বলা হয় কমেডি অব আইডিয়াজ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কমেডিকারেরা নির্ভর করেন ‘ডার্ক কমেডি’র ওপরে। এখানে কমেডি ও ট্র্যাজেডির বিভাজন রেখা ক্রমশ অস্পষ্ট। স্যামুয়েল বেকেট, হারল্ড পিনটার, এডওয়ার্ড অ্যালবিদের কমেডি জীবনের অদ্ভুতত্বকে প্রকাশ করতে গিয়ে আশ্রয় নেয় উদ্ভট এক হাস্যরসের। আধুনিক মানুষের লক্ষ্যহীন, নিরালম্ব, বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন তাদের পরিবেশনে কমিক, কিন্তু সেই খোসার নিচে জমে উঠতে থাকে এক অন্তঃহীন বিষাদ, এক অব্যর্থ করুণ রস। বেকেট-এর ওয়েটিং ফর গোডো এমন এক কিছুর জন্য অপেক্ষাকে দেখায়, যা-এ পৃথিবীতে কখনোই ছিল না। এখানে অপেক্ষা এক উদ্দেশ্যহীন অভ্যাস, সময়কে খুন করে সময় তৈরি করার ছল। অত্যন্ত সচেতনভাবে বেকেট এখানে কমেডিকে ব্যবহার করেন, এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকা এক নির্মম ট্র্যাজেডিকে নির্দেশ করতেই।

তথ্যসূত্র:

১. কবীর চৌধুরী, সাহিত্যকোষ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ৩৮
২. তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়, “কমেডি প্রসঙ্গে”, সুধীর চক্রবর্তী; বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ১৫৪-১৫৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!