দোলন প্রভার যৌথ খামার

দোলন প্রভা সম্পর্কে এখন যেসব পরিচয় ব্যবহার করা হয় সেগুলো বহুমুখী ও বিচিত্র। তিনি একজন লেখক, কবি, সংস্কৃতি কর্মী, প্রকৃতিপ্রেমি, আলোকচিত্রী ও পর্যটক। মোটা দাগের এই পরিচয়ের বাইরেও তিনি অনেককিছুকে গভীরভাবে দেখতে পারেন। তিনি সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, মার্কসবাদ, সাহিত্য, জীবনী, চলচ্চিত্র, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে লেখালেখি করছেন। তিনি নিজেকে বাংলাদেশের মার্কসবাদী সাম্যবাদী আন্দোলনে যুক্ত রেখেছেন। তার এসব লেখা ও কাজে গভীরতা ও সৃজনশীলতার ছাপ আছে। নারী হিসেবে জন্ম হলে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তা আমাদের বহুল পরিচিত, কিন্তু নারী হিসেবে জন্ম হলে যে বাড়তি জায়গাটা পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে নারীকে সহজভাবে জানার সুযোগ। তিনি তার কাজে নারীকে জেনে নারীর গভীরতর অনুভুতিকে আমাদের সামনে হাজির করেছেন।   

লেখালেখির জগতে আসার আগে তিনি অনেকগুলো ছোটকাগজে লিখেছেন। সেসব কাগজে লেখা খুব আহামরি কিছু ছিল না। যদিও লেখক হিসেবে আবির্ভূত হতে হলে অনেককেই ছোট কাগজের সাথে সম্পৃক্ত হতে হয়। ছাত্রজীবনেই তিনি লেখালেখিকে গ্রহণ করেছিলেন, তবে তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করে। তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ হয় ২০১৬ সালের জুলাই মাসে।  ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতার বই। কবিতার বইটির নাম ‘স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে’। দোলন প্রভার প্রকাশিত আরেকটি বইয়ের নাম হচ্ছে ‘শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ’। এই বইটি ২০২২ সাধারণাব্দে আমরা দুজনে সম্পাদনা করেছিলাম। বইটি বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের কবি, সাহিত্যিকদের লেখার সমন্বয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন ছোট ছোট লেখা সংগ্রহ করতে তার দক্ষতার পরিচয় পেয়েছি। 

২০১৭ সাধারণাব্দেই তিনি একটি অনলাইন ওয়েবসাইটের সম্পাদক হয়ে যান, পরবর্তীতে সেই ‘রোদ্দুরে ডটকম’ ওয়েবসাইটটিতে তিনি নিয়মিত প্রাণ-পরিবেশ-প্রকৃতি বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছিলেন। একসময় তিনি ব্লগে লিখতেন। তিনি তার সুর্যস্নান ব্লগে ২০১২ সালে লেখা শুরু করেন এবং ২০১৬-এর এপ্রিল পর্যন্ত লিখেছেন। সেই ব্লগে তিনি কবিতা ও সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে নিবন্ধ রচনা করেছিলেন। সেই নিবন্ধগুলোতে রাজনৈতিক, সাহিত্য বিষয়টিকে তুলে আনতেন। মূলত সূর্যস্নান ব্লগে তার কবিতাগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমানে তিনি তার শিক্ষামূলক, রাজনৈতিক, চলচ্চিত্র, সমালোচনামূলক লেখা ফুলকিবাজ ডটকম নামে আরেকটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন। এটিরও সম্পাদক তিনিই। এক হাতে দুটি অনলাইন সাইট তিনি সম্পাদনা করছেন, যা কিছুটা অবাক করে বৈকি।

দোলন প্রভা ভ্রমণ পছন্দ করেন, কিন্তু এই ভ্রমণ একজন ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তির প্রকৃতি দেখা বা প্রকৃতির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা নয়। তিনি মানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস ইত্যাদি বুঝবার জন্য এশিয়ার তিনটি দেশ; বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল ভ্রমণ করেছেন। এই সব দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি বুঝবার চেষ্টা আর মানুষের সাথে মেশার বহুবিধ অভিজ্ঞতা তার লেখালেখিতে প্রভাব ফেলেছে। 

ভ্রমণ করার পথে আমরা কত কী দেখি! সেসব দৃশ্য এখন লোকে ক্যামেরাবন্দি করে রাখেন। আমরা অনেকেই শত শত ছবি তুলি, একসময় সেসব ছবি হারিয়ে যায়। তিনি যেহেতু ভ্রমণপিয়াসি, ঘুরতে ঘুরতে তিনিও ছবি তুলেছেন। তবে সেসব ছবি তিনি নিজ ঘরে বন্দি রাখেননি, সেসব ছবি ছড়িয়ে দিয়ে অন্তর্জাল দুনিয়ায়। তিনি উকিমিডিয়ার কমন্সে মোট আলোকচিত্র যুক্ত করেছেন প্রায় ১০০০টি। এই যে হাজার ছবিকে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া, এটাতো এক বিশাল কাজ। তার তোলা ছবির নিশ্চয় কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে। একটু বিশ্লেষণ করলে সেসব হয়ত আমাদের চোখেও পড়বে। একজন পরিবেশ কর্মী হিসেবে জগতকে সুন্দর করবার চেষ্টা তার তোলা আলোকচিত্রগুলোতে আমরা নিশ্চয় দেখতে পাব। 

আরো পড়ুন

আমরা অনেকেই জানি তার একটি রাজনৈতিক জীবন আছে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত। দিনাজপুর সরকারি কলেজে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে মিছিল, মিটিং, সমাবেশসহ প্রচারণামূলক কাজে যুক্ত থেকেছেন। জেলা ও জাতীয় পর্যায়ের সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। পরবর্তীতে আনন্দ মোহন কলেজে পড়ার সময় নবীন ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি দিনাজপুর আর ময়মনসিংহে অবস্থানকালে ‘সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট’ কলেজ কমিটির সদস্য ও জেলা কমিটির কর্মী সদস্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্নেল তাহের পাঠাগারের জন্য কুইজ প্রোগ্রাম আয়োজন ও বই বৃদ্ধির জন্য অর্থ সংগ্রহসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করেছেন। নেত্রকোনা আর ময়মনসিংহ শহরে পাঁচ নেতার মৃত্যুবার্ষিকী বা জন্মবার্ষিকী উদযাপন পর্ষদের সদস্য থেকেছেন আগ্রহ সহকারে। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক আড্ডা বা আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছেন। তিনি যখন রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন তখনকার শিক্ষার্থীরা বিসিএস গাইড মুখস্ত করছে, কিন্তু তিনি পড়ছেন মানুষের রাজনৈতিক জীবন, রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে তাকে কখনো অনাগ্রহী দেখা যায়নি।  

আড্ডা, আলোচনা, বিতর্ক বা টেবিল কথাতে তিনি প্রাণবন্ত থাকেন। মানুষকে বোঝানোর ক্ষমতা অসাধারণ। কথা ধীরে বলে বোঝানো যায়, এটা বাস্তবে প্রয়োগ করেন। আমরা অনেকেই গলা বাড়িয়ে উচ্চরবে কোলাহল করি, তাতে গুরুত্বপূর্ণ কথাও শব্দদূষণে চাপা পড়ে যায়। কিন্তু তিনি ধীরে বলে, আস্তে হাঁটেন, পথে অনেককে সঙ্গে নেন, পথ দেখান। একাই সব কাজ করতে চান না, সামাজিক কাজ সবাই মিলে করতে হবে, এই দৃষ্টিভঙ্গি মাথায় রাখেন। যৌথ খামারে সবার সহযোগিতা থাকবে, সাংগঠনিক রূপে কাজ করতে হলে হরেক মানুষের সাথে কাজ করতে হবে; এই কথা ভোলেন না। একজন সাংগঠনিক মানুষ হিসেবে তার এসব দক্ষতা বহু বছরের চেষ্টার ফল।  

তাকে কোনো একদিকে আগ্রহী হিসেবে দেখা যায় না। বহু দিকে নজর দেয়াই যেন তার জীবনের উদ্দেশ্য।  এটার ফলে তার কবিতা চর্চায় ছেদ পড়েছে। নিজস্ব কিছু কাজেও নিশ্চয় বিঘ্ন ঘটেছে। কিন্তু কাজ করতে হবে, এমন একটি চেষ্টা থেকে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তার কাজ একা ঘরে বসে থাকার নয়, তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। কবিতা, নাচ, গান, মঞ্চ নাটকে অংশ নিয়েছেন। আনন্দ মোহন কলেজের বাংলা বিভাগের নাট্য সংগঠন বাংলা নাট্যঙ্গনের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্র জীবনেই দুবছর উত্থান সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সংগঠনে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমার মনে পড়ে গম্ভীরা নামে লোকগানের যে ধারাটি কেবল উত্তরবঙ্গে চালু আছে, সেই গম্ভীরা গানের একটি দল তিনি তৈরি করেছিলেন ময়মনসিংহে। পরে সংগঠনটি নানান টানাপোড়েনে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ২০১৫ সালে বেস্ট নামে একটি স্ট্যাডি গ্রুপে ক্লাস ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালিয়েছিলেন। এসব কাজ নিজ আগ্রহে যতটা করেছেন, সংগঠনের চাপও নিশ্চয় সেসময় সামলাতে হয়েছে। 

তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ হয়েছিল, কিন্তু লেখাপড়ার অভ্যাস যার হয়ে যায়, তিনি সেটা ছাড়তে পারেন না। কলেজে যাওয়া বন্ধ হলে তিনি উইকিপিডিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়েন সাথে সাথেই। কাগজের বই পড়াই কেবল নয়, তিনি শুরু করলেন অনলাইনে পড়া ও সাথে সাথে অনলাইনে লেখা। নিজের ওয়েবসাইটে যেমন, তেমনি উন্মুক্ত জায়গা উইকিপিডিয়াতে লিখতে শুরু করেন। মাত্র ছয় বছরে লিখেছেন অনেক। তিনি আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত বত্রিশ হাজারের বেশি সম্পাদনা করেছেন, যা অবাক করার মতো। আগস্ট, ২০২৩ পর্যন্ত তিনি নতুন নিবন্ধ লিখেছেন প্রায় ৪৫০টি। সাড়ে চারশত নিবন্ধের বিষয় তো বহুমুখী হবেই। চাইলে সেসব নিয়েও আলোচনা করা যেত। কিন্তু সময়াভাবে সেটি থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। উইকিপিডিয়াতে লিখতে গিয়ে এবং উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন কাজ শিখতে গিয়ে তিনি বাংলা উইকিপিডিয়ান হিসেবে ভারতের পাঁচটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেছেন। ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলায় ২০১৯ সাধারণাব্দ থেকে উইকির নানা ধরনের প্রচারণামূলক কাজের সাথে যুক্ত আছেন। উইকিপিডিয়ায় একটি শিক্ষা কার্যক্রম আছে, সেটার সাথে যুক্ত থেকেছেন, নিজে জানা, নিজেকে জানা, অন্যকে জানা, অন্যকে জানানো; এই যে লেনদেনের সামাজিক সম্পর্ক, এমন এক জটিল জীবনের বহুবিধ গ্রন্থিতে বাঁধা জীবনকে তিনি প্রতিদিন যাপন করেন। এই যাপনে আনন্দ আছে কীনা তা হয়ত আমরা অনেকেই খেয়াল করি না, কিন্তু এমন একটি জীবন যাপন করতে তাকে কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি। যৌথ খামারে, কাজের বৈচিত্র্যে শ্রমিকের ক্লান্তি থাকার কথাও নয়; একঘেয়েমি সেখানে ঠাঁই পায় না।  

৩০ ডিসেম্বর ২০২৩,

কুরপাড়, নেত্রকোনা।

Leave a Comment

error: Content is protected !!