ক্যাথারসিস বা বিমোক্ষণ পুঞ্জিভূত আবেগ প্রকাশের মাধ্যমে স্বাভাবিকে আসা

ক্যাথারসিস বা বিমোক্ষণ বা মোক্ষণ বা শুদ্ধি (ইংরেজি: Catharsis) হচ্ছে পুঞ্জিভূত আবেগ বা শক্তির প্রকাশের মাধ্যমে শক্তির আধারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া বা উপায়। বিমোক্ষণের মাধ্যমে ভারাক্রান্ত মন হালকা হয়, ব্যক্তি তার স্বাভাবিক ভারসাম্য ফিরে পায়, তার আবেগ পরিশোধিত হয়।[১]

এরিস্টটল ব্যক্তির উপর সঙ্গীতের প্রভাব আলোচনা করে বলছেন যে, ব্যক্তির উপর সঙ্গীতের একটি বিশুদ্ধকরণের দিক আছে।[২] সঙ্গীতের মাধ্যমে ব্যক্তির আবেগের প্রকাশ ঘটে এবং ব্যক্তি তার ফলে আনন্দ বা স্বস্তি বোধ করে। এছাড়াও তিনি ট্রাজেডি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ট্রাজেডিতে নায়ক নায়িকার ভয়াবহ পরিণতি এবং মহৎ চরিত্রের চূড়ান্ত পতন দর্শক-পাঠকচিত্তে ভীতি এবং করুণার জন্ম দিয়ে বিমোক্ষণ ঘটায়। ধ্রুপদী গ্রিক নাট্য সাহিত্যের ট্রাজেডির আলোচনায় ক্যাথারসিস একটি অপরিহার্য ধারণা।[১]

বিমোক্ষণ বা ক্যাথারসিস শব্দের ব্যুৎপত্তি

ইংরেজি ক্যাথারসিস শব্দের মূল গ্রিক শব্দের অর্থে বিশুদ্ধকরণের ভাব যুক্ত ছিল। গ্রিক গণ তাদের নন্দনতত্ত্বে এবং সাহিত্যে এই অর্থে শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন। শব্দটি এরিস্টটল তাঁর ‘পোয়েটিকস’ গ্রন্থে একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে ‘ক্যাথারসিস’ হলো ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্ত নাটকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

‘ক্যাথারসিস’ অর্থাৎ আবেগের শুদ্ধি অথবা শোধন। ট্র্যাজেডিতে প্রবৃত্তির ভয়ংকর পরিণতি দেখানোর মধ্য দিয়ে প্রবৃত্তিকে দমন বা সংযত করার আর-এক নাম শোধন। ‘শুদ্ধি’র আর-একটি ব্যাখ্যা হলো ট্র্যাজেডিতে কেবলমাত্র দর্শকের ভীতি বা করুণার আবেগের শোধন ঘটানো হয় না, কেন্দ্রীয় চরিত্রের প্রধান দোষেরও শুদ্ধি ঘটানো হয়। ‘ক্যাথারসিস’ কথাটির অন্যান্য ইংরেজি সমার্থক শব্দও আছে। ‘পিউরিফিকেশন’, ‘পারগেশন’ ইত্যাদি।[৩]

আধুনিক ব্যবহার

আধুনিককালে মনোবিজ্ঞানে, বিশেষ করে মানসিক রোগ নিরাময়ের একটি উপায় হিসাবে, বিমোক্ষণের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার দেখা যায়। মনোবিকলনের ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মনোবিকলনের রোগীকে যদৃচ্ছা আবেগ প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়। এরূপ ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানী অনুমান করেন যে, রোগীর মনে তার অপূর্ণ কামনা বাসনা, ইচ্ছা অনিচ্ছাসঞ্জাত যে আবেগ জমা হয়ে আছে তা যে কোন প্রকারে প্রকাশের পথ পেলে রোগী আবার রোগপূর্ব স্বাভাবিক ভারসাম্য ফিরে পাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবেগ বিমোক্ষণের এ পদ্ধতি রোগীর মনকে হালকা করে তার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।

উল্লেখ্য ব্যক্তির ভারসাম্য বিনষ্টির কারণ ব্যক্তির নিজের মধ্যে তত নয় যত তার পরিবেশ ও সমাজের মধ্যে। রোগীকে সমাজ-নিরপেক্ষ বিবেচনা করে তার মনের কথায় বা সীমাবদ্ধ আচরণে প্রকাশের সুযোগ দান কোনো স্থায়ী ফল দিতে পারে না। এ কারণে বিমোক্ষণে আবেগ প্রকাশের একটি পদ্ধতি হলেও তা মনোবিকলনের ক্ষেত্রে নিরাময়ের কোনো নিশ্চিত উপায় হয়ে উঠে নি।

তথ্যসূত্র:

১. কবীর চৌধুরী, সাহিত্যকোষ, মাওলা ব্রাদার্স ঢাকা, অষ্টম মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ৩২।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫।
৩. সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যের শব্দার্থকোষ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমী, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯,পৃষ্ঠা ১০৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!