বাংলা কবিতা হচ্ছে বাংলা ভাষায় রচিত কবিতার সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যবাহী ধারা

বাংলা কবিতা (ইংরেজি: Bengali poetry) হচ্ছে বাংলা ভাষায় রচিত কবিতার একটি সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যবাহী ধারা যার বিভিন্ন রূপ রয়েছে। বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন চর্যাপদ। ৭৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বৌদ্ধ সহজিয়ারা চর্যাপদ রচনা করেছিলেন। ধর্মের গুঢ় রহস্য এর বিষয় হলেও সমকালের সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দিক এতে প্রতিফলিত হয়েছে। চর্যাপদের পর দীর্ঘকাল সামাজিক-রাষ্ট্রিক অস্থিরতার কারণে কবিতা রচিত হয়নি অথবা রচিত হয়ে থাকলেও কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। 

বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগে প্রবেশ করে বড়ু চণ্ডিদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের মাধ্যমে। মধ্যযুগে বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি ঘটে বিচিত্রধারায়। নাথসাহিত্য, ধর্মমঙ্গল, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, জীবনী কাব্য, অনুবাদকাব্য, রোমান্সমূলক প্রণয়কথা (কারো কারো মতে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান) প্রভৃতি বিষয়ভবনা ও রূপবৈচিত্র্যে বাংলা কবিতার বিকাশ ও উত্তরণে ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ইউরোপীয় শিক্ষা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রভাবে বাঙালি জীবনে আধুনিকতার অনুপ্রবেশ ঘটে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০), হিন্দু কলেজ (১৮১৭), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭) প্রভৃতি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এদেশে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা ভাবনা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। 

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় প্রথম আধুনিক জীবনের লক্ষণসমূহ প্রকাশ পেতে থাকে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের প্রথম সর্বাঙ্গীন আধুনিক কবি। বিহারীলাল চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের হাতে আধুনিক বাংলা কবিতা আন্তর্জাতিক মান স্পর্শে সক্ষম হয়। কবিতার বিষয় ও রূপ-রীতি উদ্ভাবনে বাঙালি কবিরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। 

বাংলা কবিতার এক স্বতন্ত্র ধারা বাংলাদেশের কবিতা। অভিন্ন ভাষায় রচিত হলেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে বাংলাদেশের কবিতা পশ্চিমবাংলার কবিতা থেকে বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে স্বতন্ত্র। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের কবিতা নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানের অভিজ্ঞতায় আমাদের কবিতায় যে চেতনা জন্ম নেয় পৃথিবীর কোনো দেশের সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে না। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এই সমাজ ও তার কবিতা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের কবিতা 

বাংলাদেশের কবিতায় স্বতন্ত্র ভিত্তি রচিত হয় চল্লিশের দশকে। সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্র ধারার সঙ্গে শিল্পদৃষ্টির নতুনত্ব এ-সময়ের কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে। এ-সময়ে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-১৯৭৬), আবুল হোসেন (১৯২১-) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। আবুল হোসেনের ‘নববসন্ত’ (১৯৪০), ফররুখ আহমদের ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৫), আহসান হাবীরের ‘রাত্রিশেষ’ (১৯৪৭) কাব্যে উপকরণ, জীবনজিজ্ঞাসা ও শিল্পরীতির স্বাতন্ত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। 

পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্প-ভাবনায় যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়। এ-সময়ের কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গনি হাজারী, আজীজুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, শহীদ কাদরী উল্লেখযোগ্য। ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে নবোদ্ভূত মধ্যবিত্তের জীবনচেতনার রূপায়ণে এ-পর্যায়ের কবিতা এক নতুন মাত্রা যোগ করে। 

ষাটের দশকে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, মাহবুব সাদিক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। পাশ্চাত্য কবিতার ধ্যানধারণার সঙ্গে ব্যক্তিমানসের নিভৃতচারিতা ও রাজনীতি সচেতনতা এঁদের কবিতার স্বভাবধর্ম।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এ-সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ কবির আবির্ভাবে বাংলাদেশের কবিতায় নতুন প্রাণবন্যা সূচিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কবিতা যাঁদের সাধনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আবিদ আজাদ, সানাউল হক খান, সাজ্জাদ কাদির, সিকদার আমিনুল হক, মাহবুব হাসান, হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন এবং হাসান ফকরী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

রচনাকাল: ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ময়মনসিংহ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!