বাংলা ছোটগল্প হচ্ছে বিশ শতকে বাংলা ভাষায় রচিত ও চর্চিত গল্পের ধারা

বাংলা ছোটগল্প (ইংরেজি: Bangla short story) হচ্ছে বিশ শতকে বাংলা ভাষায় রচিত ও চর্চিত গল্পের ধারা। সাহিত্যরূপ হিসেবে ছোটগল্পের উদ্ভব উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটগল্পের প্রথম ও প্রধান শিল্পী হলেও তাঁর পর্বে পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বর্ণকুমারী দেবী, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত — প্রমুখ লেখক গল্পরচনায় পটভূমি প্রস্তুত করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭) নামক অনুবাদ গ্রন্থটির ঘটনা উপস্থাপনায় গল্পরসের পরিচয় পাওয়া যায়। 

বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব, বিকাশ ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অতুলনীয়। কেননা, ছোটগল্প যে একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য রূপ (Literary form) এই ধারণাটি রবীন্দ্রনাথের গল্পেই প্রথম ধরা পড়ে। ইতিপূর্বে যাঁরা ছোটগল্প রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তারা কাহিনী বর্ণনার মধ্যেই আত্মতৃপ্তি সন্ধান করেছেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের “ভিখারিণী’ গল্পটি ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মাত্র ষোল বছর বয়সে রচিত এই গল্পে ছোটগল্পের বিষয়বস্তু, রূপ ও রীতির সমস্ত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এরপর ১৮৯১ সাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে রবীন্দ্রনাথ ৯৩টি ছোটগল্প এবং আরো কিছু গল্পধর্মী সাহিত্যরূপ সৃষ্টি করেছেন। ঊনবিংশ শতব্দীতেই রবীন্দ্রনাথ ৫০ এর অধিক ছোটগল্প রচনা করেন। যার মধ্যে ‘পোষ্টমাষ্টার’,‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘কঙ্কাল’, ‘একরাত্রি’, ‘কাবুলিয়ালা,‘শাস্তি’ ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘অতিথি’র মতো গল্প রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল থেকে রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্বমানে পৌঁছে দেন। বিষয়-বৈচিত্র্য ও আঙ্গিকের অভিনবত্বে পৃথিবীর আর কোনো গল্পকারকে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ মনে করা যায় না। নষ্টনীড় ‘হৈমন্তী’, ‘স্ত্রীরপত্র’, ‘পয়লা নম্বর’, ‘ল্যাবরেটরি’ প্রভৃতি গল্পে রবীন্দ্রনাথের অতুলনীয় সৃষ্টিসামর্থ্যের পরিচয় মেলে। 

রবীন্দ্রনাথের পর যাঁরা বাংলা ছোটগল্প রচনায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮), প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬), ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৬২), প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। শরৎচন্দ্রের গল্প অভিজ্ঞতার দিক থেকে অভিনব হলেও রূপরীতি বিচারে রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য নয়। প্রমথ চৌধুরী ও ধূর্জটিপ্রসাদ মননশীল জীবনচেতনাকে ছোটগল্পের উপাদানে পরিণত করেন। এ-সময়ই আবির্ভূত হন আরো কয়েকজন ক্ষমতাধর গল্প লেখক। এঁরা হলেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, (১৮৪৭-১৯১৯), প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৪৯-১৯৩২), রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০), ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৯-১৯১১), সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪) প্রমুখ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বাঙালির জীবনচেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে, তার প্রতিফলন ছোটগল্পেও অনিবার্য হয়ে ওঠে। প্রচলিত মূল্যবোধ, নারী-পুরষের সম্পর্কের ধারণা, সংস্কার ও বিশ্বাস নতুন ধারার গল্পকারদের নিকট তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। এ-সময়ে উদ্ভূত গল্পলেখকদের মধ্যে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত (১৮৮২-১৯৬৪), মনীন্দ্রলাল বসু (১৮৯৭-১৯৮৬), দীনেশরঞ্জন দাশ (১৮৮৮-১৯৪১), গোকুলচন্দ্র নাগ (১৮৯৪-১৯২৫), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৭), প্রবোধকুমার সান্যাল (১৯০৫-১৯৬৭), জগদীশচন্দ্র গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০০-১৯৬৭), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। 

জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতা, সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র, নারীপুরুষের সম্পর্কের জটিলতা, ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন, সুস্পষ্ট রাজনৈতিক আদর্শনিষ্ঠা এ-সময়ের গল্পের বৈশিষ্ট্য। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক ছোটগল্পের অবয়বে মানবজীবনের দৈহিক ও মানসিক সম্পর্কের জটিল দিকগুলোকে সূক্ষ্মদৃষ্টিতে উপস্থাপন করেছেন। দীনেশরঞ্জন দাশ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ লেখক জীবনের বাস্তব চিত্র, রাজনৈতিক আদর্শ ও জিজ্ঞাসাকে ছোটগল্পে রূপ দিলেন। বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় চিরচেনা জীবন থেকে উপকরণ আহরণ করলেও অভিজ্ঞতা ও বিন্যাসের অভিনবত্বে তাঁদের গল্প বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। গল্পের বিষয়বস্তুর মতো আঙ্গিক-নিরীক্ষায়ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর গল্পলেখকরা সচেতনভাবে মনোনিবেশ করলেন। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের গল্পলেখকদের ব্যতিক্রমী জীবনদৃষ্টি ও বিষয়ভাবনার সমান্তরালে উপাদান ও উপস্থাপনার অভিনবত্বে আরো একটি স্বতন্ত্র গল্পের ধারা লক্ষ করা যায়। এই ধারার গল্পকাররা হলেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৮৭), বনফুল ওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯), শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯), সজনীকান্ত দাস (১৯০০-১৯৬২), মনোজ বসু (১৯০১-১৯৮৭),প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-১৯৮৫), অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০১-১৯৯৯), শিবরাম চক্রবর্তী (১৯০৫), গজেন্দ্রকুমার মিত্র (১৯০৮), আশাপূর্ণা দেবী (১৯০৯) প্রমুখ। কৌতুক হাস্যরস ও বিদ্রুপ এদের গল্পের উপজীব্য হলেও জীবনের বর্ণনা অপেক্ষা বিশ্লেষণকেই তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তীকালে আবির্ভূত গল্প লেখকদের মধ্যে সুবো ঘোষ (১৯১০-১৯৭০), নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬-১৯৭৫), জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী (১৯১২-১৯৮২), সন্তোষকুমার ঘোষ (১৯২০-১৯৮৫), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০), সোমেন চন্দ (১৯২০-১৯৪২) উল্লেখযোগ্য। সমাজ-অভিজ্ঞতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ছোটগল্পের বিষয় ও রীতির ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, উল্লিখিত লেখকদের গল্পে তার প্রমাণ সুস্পষ্ট। 

বাংলাদেশের ছোটগল্প 

ভৌগোলিক-সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ড আদিকাল থেকেই ছিলো স্বতন্ত্র। মূলত নদীমাতৃক ও ভূমিনির্ভর এই দেশ ও তার জনগোষ্ঠী জীবনোপকরণ, জীবনযাপন ও অস্তিত্ব সাধনায় গোড়া থেকেই বাস্তবমুখী ও সংগ্রামশীল। উনিশ শতকে ইংরেজি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিক্ষার প্রভাবে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে ভৌগোলিক অবস্থান ও ইংরেজ রাজশক্তির অসহযোগিতার ফলে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে বা বর্তমান বাংলাদেশ তা ঘটেনি। এ-দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাত্রা শুরু হয় বিংশ শতাব্দীতে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি চেতনা ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হতে শুরু করে। যে-কারণে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশবিভাগের পূর্বেই এদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সাহিত্য সাধনার স্বতন্ত্র পটভূমি রচনায় সমর্থ হয়। এ-পর্যায়ের গল্পকারদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪১৯৭০), মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৯), সৈয়দ ওয়ালীউলাহ (১৯২২-১৯৭১) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এ-ভূখণ্ডের স্বতন্ত্র জীবনধারা, অস্তিত্ববিন্যাস, মানবসম্পর্ক প্রভৃতি এই গল্পলেখকদের মুখ্য উপজীব্য। উল্লিখিত গল্পকারদের অনেকেই দেশ বিভাগের পরও গল্পচর্চা করেছেন। কেবল কলকাতা-কেন্দ্রিক ছোটগল্প নয়, বিশ্বমানের ছোটগল্প রচনায়ও যে কেউ কেউ পারদর্শী ছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউলাহ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 

দেশবিভাগের পর যাঁরা বাংলা ছোটগল্প রচনায় আত্মনিয়োগ করেন, তাঁদের হাতেই বাংলাদেশের ছোটগল্প সমৃদ্ধি লাভ করেছে। শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯২৬-১৯৯৮), সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯১৮-১৯৮৬), মিরজা আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৮৫), আবু ইসহাক (১৯২৬- ), আবদুল গাফফার চৌধুরী (১৯৩১- ), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-), জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭২), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫- ) প্রমুখ লেখকরা বাংলাদেশের ছোটগল্পকে বিষয়বিন্যাস ও আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যমণ্ডিত করেছেন।

বাংলাদেশের ছোটগল্প এখন বিচিত্র বিষয় ও নিরীক্ষাশীল শিল্পরূপের বাহন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের পর ছোটগল্প হয়ে ওঠে আমাদের সাহিত্যের অন্যতম সমৃদ্ধ শাখা। প্রবীণ এবং নবীন মিলিয়ে প্রচুর গল্প লেখক এখনো সৃষ্টিশীল। এঁদের মধ্যে শওকত আলী (১৯৩৬- ) হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯- ), জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (১৯৩৯- ) রাহত খান (১৯৪০- ), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৮), আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩- ) বাংলাদেশের ছোটগল্পকে বিষয়ভাবনা ও শিল্পরূপের দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছেন।

তথ্যসূত্র

১. বেগম আকতার কামাল, ভীষ্মদেব চৌধুরী, রফিকউল্লাহ খান ও অন্যান্য, বাংলা ভাষা: সাহিত্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, পুনর্মুদ্রণ ২০১১, পৃষ্ঠা ২২-২৪।

2 thoughts on “বাংলা ছোটগল্প হচ্ছে বিশ শতকে বাংলা ভাষায় রচিত ও চর্চিত গল্পের ধারা”

Leave a Comment

error: Content is protected !!