অনুপ সাদি একজন সংগ্রামী কলমযোদ্ধা

পূরবী সম্মানিত
পূরবী সম্মানিত

একদিন আমি দেখলাম একটি বাঁশি
আর সবগুলো থেকে আলাদা,
সেইটিই তারপর থেকে আমার প্রিয় বাঁশি
আমি এখন ওটিকেই বাঁজাই। —- বাঁশিঅলা, পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি

অনুপ সাদি হচ্ছেন একজন কবি, প্রাবন্ধিক, সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তাবিদ, সুবক্তা ও শিক্ষক। সত্যিই তিনি একটি বাঁশি বাজান, আর তাতে সুর তুলে আহ্বান করেন সংগ্রামের, পরিবর্তনের, বিপ্লবের, প্রগতির। তাঁর বাঁশির সুর সেই সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার কথা বলে;– যে সমাজ মানুষকে পীড়ন করে, শোষণ করে, পুঁজির মুনাফার বন্ধনে শৃঙ্খলায়িত করে রাখে।

বাবা সাবের আলী আলকাপ গানের শিল্পী, মা শাহেরা খাতুন মেয়েলী গীত, কুটির শিল্প, আমাদের লোক শিল্প সংস্কৃতি’র বিকাশে কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। এ দু’জন লোকশিল্পীর আত্মজ লেখক অনুপ সাদি। পারিবারিক গণসংশ্লিষ্ট পরিবেশই তার ভেতর সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার বীজ বপন করেছে। যখনই অনুকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তাঁর ভেতরের বীজ অংকুরিত হয়েছে। একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণকালে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বি্শ্ববিদ্যালয়ের অনুকূল পরিবেশ, মহামহিম গুণিজনের সান্নিধ্য, বিশেষ উল্লেখ্য — ড. আহাম্মদ শরীফ, ড. হুমায়ুন আজাদ, আবুল কাসেম ফজলুল হকদের মতো মণিষিদের সান্নিধ্য তাঁকে এই আলোকোজ্জ্বল পথে হাঁটার প্রেরণা দিয়েছে।

লেখক অনুপ সাদি সংসারের নানা জটিলতা ছেঁটে কেটে, নিজেকে ভারমুক্ত রেখে জ্ঞান সাধনা করেন। শত শত বই শোকেশে সাজিয়ে রাখার জন্য শোকেশ কিনেন না তিনি। বই কিনেন, কোথাও একটা গুছিয়ে রেখে পড়েন, লিখেন, চিন্তা করেন, বক্তৃতা দেন। নিজেকে যেন তত্ত্ব-অনুশীলন-তত্ত্ব এই ফর্মে আবদ্ধ করেছেন। তিনি দিন রাতের কলম যোদ্ধা, সংগ্রামী।

কবি অনুপ সাদি একজন প্রথাবিরোধীও, হাসতে হাসতে তিনি প্রথা ভাঙেন, প্রথার বিরুদ্ধে বলেন, কাজ করেন, সংগ্রাম করেন। প্রথাবিরোধীদের তিনি উর্ধ্বে তুলে ধরেন। প্রথাবিরোধী খ্যাত লেখক হুমায়ুন আজাদ কে নিয়ে লিখেছেন — “নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ”। পুরনো প্রবাদ প্রবচনগুলোর বিশাল অংশ জুড়ে বিরাজ করছে যে নিচু মনোভাব, অগণতান্ত্রিক চিন্তাধারা সেগুলোকে তিনি বর্জনের আহ্বান জানান।

তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। অন্য সব অসাম্প্রদায়িক মানুষের মতো তিনিও কুখ্যাত এরশাদ সরকারের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা, জিয়াউর রহমানের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দেয়া নিয়ে  ক্ষুব্ধ। এটাকে এদেশে সাম্পদায়িকতাকে প্রতিষ্ঠা দেয়া মনে করেন। তাই সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনঃসংযোজনের কথা বলেন।

সংগ্রাম বিমুখ সময়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটে, দুষ্কৃতিকারিদের গর্জন শোনা যায়। কবি অনুপ সাদি লিখেন–

তিতুমীরের প্রাণের কেল্লা ভেঙে ফেলেছি
আমরা নব্য হিন্দু–মুসলমান
আজ তাই কিল্লার মোড়ে চিল্লা মারে
শত শত হায়েনা শয়তান।

কিল্লার মোড়ে চিল্লা মারে হায়েনা শয়তান, পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি

অনুপ সাদির মাথা সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার, তিনি পুঁজিবাদের নিষ্ঠুরতা আর অসারতা, আর এর পঁচা গলা রূপকে তুলে আনেন তাঁর কথায় লিখায়। যেমন একটা কবিতা–

বাসি বকুলের মালা সুগন্ধি বিলায় না আর।
বিস্মরণের আসনে বসে একালের মুখরা নারীরা।
ভবের মেলায় ঘুরে ফিরে ঘুরে বীর হারকিউলিস।
স্বাধীন গ্যাসের বাতি বেচা হয় পুঁজিবাদের ঘাটে ।
প্লুটোর শহরে আজ ডলারের গড় দাপাদাপি।
মহারাজের ঘানি টানে ব্যলটের রঙিন ইঞ্জিন।
রেসের মাঠে খোড়া হয় রাণী বারেবার।
কালের শকুন সাজে সময়ের সাহসি ডাক্তার।

—- পথভ্রষ্ট হারকিউলিস, পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি

অনুপ সাদির প্রতিবাদের ভাষা, সাহিত্যের ভাষা কখনো ব্যাঙ্গাত্মক, কখনো উন্মাদের মতো অসঙ্গতও বটে। গণবিরোধীদের তিনি কবিতায় গালি দেন, বিদ্রুপ করেন, হাসেন। এ বিষয়ে তাঁর ‘আধুনিক মানুষের ধারাবাহিক গল্প” বা উন্মাদনামা কাব্যগ্রন্থকে উল্লেখ করা যায়।

অনুপ সাদি একজন নির্ভীক কলমযোদ্ধা। তিনি যা বিশ্বাস করেন তা অকপটে বলেন “বর্তমান বাংলাদেশে প্রচলিত সাম্রাজ্যবাদনির্ভর ইঙ্গ-মার্কিন প্রভাবিত লুটেরাগোষ্টীর গণতন্ত্রের পরিবর্তে সংখাগরিষ্ট অভাবী-নির্যাতিত মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।” এই নতুন ধরণের গণতন্ত্র অর্জনের পথটা যে সোজা নয় তা‌ও তিনি জানেন। কেবল একটি সফল গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই তা অর্জন করতে হবে। তিনি জানেন এ-গণতন্ত্রের পথ ধরেই মানুষ সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তির পথ সমাজতন্ত্র-কমিউনিজমের পথে এগিয়ে যাবে।

ইউটিউবে দেখুন অনুপ সাদির সাক্ষাতকার

তিনি নিরন্তর নিরলস কাজ করে যান, হয় একাকি, না হয় যথাসম্ভব যৌথভাবে। লক্ষ একটাই – সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন। সাদির কিছু গুণ আমাকে মুগ্ধ করে যেমন – তিনি ভিন্ন মত-পথের মানুষের সঙ্গেও সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব নিয়ে চলেন, মিশেন। হাসতে হাসতে সে ভিন্ন মত পথের মানুষের অগণতান্ত্রিক কাজের সমালোচনা করেন, তার ভালো গুণগুলোকে বিকশিত করতে চেষ্টা করেন।

তিনি একজন ভালো শিক্ষক। কলেজে ক্লাসের বাইরেও তিনি বিষয়ের উপর ক্লাস বৈঠক, সাহিত্য আড্ডায় বক্তা তিনি, তথ্যও তত্ত্বসমৃদ্ধ চমৎকার বক্তৃতা করতে পারেন তিনি। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উপর তাঁর পান্ডিত্যও কম নয়। বিভিন্ন বিষয়ের  উপর তাঁর একাধিক লিখা রয়েছে। এসব লিখায় অসাধারণ মেধা ও তাঁর দক্ষতার পরিচয় পাই। তিনি “প্রাণকাকলি” নামে একটি অনলাইন সম্পাদনা করেন।

“শ্রমিক ও কৃষকের সেবায় নিয়োজিত সাহিত্য হচ্ছে সাহিত্যের প্রধান ধারা। অন্যান্য সকল সাহিত্য হচ্ছে সমাজের সেই আবর্জনা যা ধ্বংস হবার অপেক্ষায় দিন গুজরান করছে। মানবজাতি তার জন্য অপ্রয়োজনীয় কিছুই সংরক্ষণ করে না বিধায় সমাজ পরিবর্তনে সে সাহিত্য কাজে লাগে না, সেই সাহিত্যের মৃত্যু অনিবার্য।”

উপরের এ বার্তাটি সাহিত্য রচয়িতাদের কাছে পৌছে দেয়ার জন্য, মূলধারার সাহিত্যকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি ভ্লাদিমির ইলিচ লেলিনের সাহিত্য প্রসঙ্গে বইটি ভূমিকা সহ সম্পাদনা করেছেন।

সমাজের অসঙ্গতি, শোষণ নিপীড়ন যাঁদেরকে পীড়া দেয় সে যাতনা থেকে মুক্তির পথ তাঁরা খুঁজতে থাকেন। ছাত্র জীবনে অনুপ সাদি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাথে যুক্ত ছিলেন। আমি মনে করি অনুপ সাদির মতো মানুষেরা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হলেও কোনো রাজনৈতিক দলের গঠনতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতার মধ্য থাকতে পারেন না। তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদী। মার্কসবাদ-লেলিনবাদ-মাওবাদ– সর্বহারার এই মতবাদের উপর তিনি আস্থা রাখেন। তাই নিষ্ঠাভরে তিনি তাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট দিবসগুলো পালন করেন। তাঁদেরকে উর্ধ্বে তোলে ধরেন। অনুপ সাদির মতো মহাপ্রাণ মানুষেরাই নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে ভুমিকা রাখে। দিন রাতের এ কলম যোদ্ধা, অবিরাম সংগ্রামীর জন্য শুভকামনা রইলো।

আরো পড়ুন

বিশেষ দ্রষ্টব্য: অনুপ সাদি সম্পর্কিত এই মূল্যায়নটি এনামূল হক পলাশ সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ অন্তরাশ্রম-এর অনুপ সাদি সংখ্যা, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ৪৬-৪৮, ময়মনসিংহ থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে ফুলকিবাজ.কমে প্রকাশ করা হলো।

Leave a Comment

error: Content is protected !!