প্রবচন বা বচন (ইংরেজি: Adage) হচ্ছে সৃজনশীল, মননশীল ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির অভিজ্ঞতাপ্রসূত ব্যক্তিগত সৃষ্টি। অর্থাৎ এটি প্রায়শই কোনো একক লেখকের একক সৃষ্টি। কিন্তু পরবর্তীকালে লোকের মুখে মুখে তার ব্যাপক প্রচার ঘটে, ঠিক প্রবাদের মতোই। ফলে এইটিই এক অর্থে সর্বজনীনতা লাভ করে নিঃসন্দেহে।
প্রবচন কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্রষ্টার নামেই প্রচলিত হয় যেমন খনার বচন। কবি, সাহিত্যিক বা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিবর্গ প্রবচনের উদ্ভাবক বা রচয়িতা। বাংলা সাহিত্যে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর অনেকগুলো প্রবচন সৃষ্টি করেছেন। হুমায়ুন আজাদ তার নিজের লেখা প্রবচনগুচ্ছ নামে গ্রন্থে তার লিখিত বচনগুলোকে সংকলিত করেছেন।
প্রবচন ও প্রবাদের পার্থক্য
প্রবচন ও প্রবাদকে প্রায় সময়েই আমরা সমার্থক বলে মনে করে নিলেও, এই দুটির মধ্যে মৌলিক ভেদ আছে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রবাদ দীর্ঘদিনের আর্থসামাজিক অভিজ্ঞতায় বহু মানুষের চিন্তার আয়োজনে তৈরি হয়।
প্রবচন ও প্রবাদের সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য হচ্ছে প্রবাদ লোকসমাজ বা সময়ের সৃষ্টি। কিন্তু প্রবচন সাহিত্যিক, কবি বা জ্ঞানবান ব্যক্তির সৃষ্টি। প্রবাদের বিশেষ কোনো লিখিত ভিত্তি নেই, কিন্তু প্রবচনের লিখিত দলিল আছে। প্রবাদকে বলা যায়, লোক সংস্কৃতির অভিজ্ঞতার নির্যাস, একক কোনো ব্যক্তি প্রবাদের প্রণেতা হিসেবে দাবি করতে পারে না। অন্যদিকে প্রবচন ব্যক্তিগত প্রতিভার দ্বারা সৃষ্ট বাক্য বা বাক্যাংশ। তবে, এগুলো এক সময় কালের প্রবাহে লোকসমাজের অধিকারে চলে আসে।
অন্যান্য পার্থক্যের ভেতরে, প্রবাদ ব্যঞ্জনার্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু, প্রবচনের রূপক বা প্রতীকী ধর্ম থাকে না, বাচ্যার্থ বা সরাসরি অর্থই প্রকাশ করে। সাধারণত প্রবাদের চেয়ে প্রবচন আকারে দীর্ঘ হয়।
প্রবচন বা বচনের প্রকারভেদ
বচন শব্দের অর্থ কথন, ভাষণ, অনুশাসন বা আদেশ। এই বচন প্রবাদের মতই পূর্ণ বাক্য। বচন দু ধরনের, যথা:
(ক) খনার বচন, (খ) ডাকের বচন।
(ক) খনার বচন
কবি বিষয়ক বচনগুলি খনার বচন হিসাবে পরিচিত। যেমন:
(অ) কোদালে কুড়ুলে মেঘের গা।
মধ্যে মধ্যে দিচ্ছে বা।
বলগে চাষারে বাঁধতে আল
আজ না হয় জল হবে কাল।”
(আ) “মেঘ করে রাতে আর দিনে হয় জল।
তবে জেনো মাঠে যাওয়াই বিকল।”
(খ) ডাকের বচন
জ্যোতিষ বিষয়ক বচনগুলি ডাকের বচন হিসেবে পরিচিত। যেমন –
(অ) “হাঁচি, টিকটিকি পড়লে বসে যাবে
অষ্ট গুণ লভ্য হবে।”
(আ) “রবির কুড়ি সোমের ষোল
পঞ্চদশ মঙ্গলের ভাল।”
এভাবে বাংলা প্রবাদ প্রবচনগুলি সমাজ সংস্কৃতি ও সমাজের বাস্তব জীবনচিত্র অবলম্বনে রচিত হয়ে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।[২]
তথ্যসূত্র
১. চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত, “লোকসাহিত্য প্রসঙ্গে”, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৮১।
২. নিত্যানন্দ মণ্ডল, লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি, দূর শিক্ষণ অধিদপ্তর, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, নয়াদিল্লি, পৃষ্ঠা ৩৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।