ভারতে দাসপ্রথা বা ভারতের দাস ব্যবস্থা বা ভারতে দাসত্ব (ইংরেজি: Slavery in India) হচ্ছে কয়েক হাজার বছরের ভারতীয় দাসমালিক, সামন্তপ্রভু, বিদেশি আধিপত্যবাদী শাসক, এবং আধুনিক ভারতীয় কংগ্রেস-বিজেপি সরকারের ধারাবাহিক গণহত্যার নিয়মিত প্রদর্শন যা একুশ শতকেও বিরামহীনভাবে ঘটে চলেছে। ভারতে দাস ব্যবস্থা হচ্ছে প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের একটি অনিবার্য ফল যা হাজার বছরের নিশ্চলতার প্রতীক। ভারতে দাসত্ব হচ্ছে ঐতিহাসিক কাল থেকে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান।[১]
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত ভারতের শাসকগোষ্ঠী হচ্ছে এমন সব নরপিশাচ গোষ্ঠী যারা নরমাংস ভক্ষণ করেই টিকে আছে। ভারতের আধুনিক কালের এই বর্বর গোষ্ঠীর নাম হচ্ছে কংগ্রেস-বিজেপি বা কংজেপি।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের আইন সম্পর্কিত তৃতীয় গ্রন্থের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে দাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আধুনিক ভারতে দাসপ্রথা
ভারতে ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুসারে ১ কোটি ৮৩ লক্ষ মানুষ দাস হিসেবে বেঁচে আছে। ভারতে আধুনিক দাসত্বব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে বিহারের দাসত্ব। ভারতের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশ হচ্ছে বিহার। এই “বিহারে এখনও দাসত্ব একটি চলমান জীবন্ত ঘটনা।”[২]
কলকাতার নাব্যতা সচল রাখার জন্য ফারাক্কা ব্যারাজ দিতে হয়েছিল। ফলেই হুগলী নদীতে জল আসছে। আবার ফারাক্কার কারণে গত ৫০ বছর ধরে বিহারে কতগুলো বন্যা হয়েছে তা কলকাতার কেউ জানে না। কাঠমান্ডো শহরের সব ফেরিওয়ালা হচ্ছে বিহারের এই বন্যা আক্রান্ত নিরন্ন মানুষ। বোম্বাইয়ে যেসব গরিব মানুষ কাজ করতে যায়, তাদের বেশিরভাগ বিহারের। এখনো ১০০ ডলারে একটা দশ-বারো বছরের বালিকা কিনতে চাইলে, যেতে হবে বিহারে।
কলকাতার ফুটপাতে যেসব হিন্দিভাষী মানুষ দেখবেন, তারা আর কোথাকার, সেই বিহারের। খৈনি খায়, বস্তি আর ফুটপাতে থাকে, তারা শখ করে কি কলকাতা দখল করতে এসেছে, মোটেই নয়। এই বিহারী গুটখাখোর এসব গরিব মানুষের বিরুদ্ধে নেমেছে বাংলাপক্ষ।
আপনি যদি ট্রেনে করে সহর্ষা, সমস্তিপুর হয়ে দিল্লি যান, দেখবেন শত শত কিশোর কিশোরী চলেছে কাজের উদ্দেশ্যে দিল্লি। কেন যায়? আপনি যদি বিহারের রক্সোল হয়ে কাঠমান্ডু যান, দেখবেন শত শত মানুষ ৫৫০ রুপি দিয়ে জীপ গাড়িতে করে কাঠমান্ডু যাচ্ছে, কেন? তারা কাঠমান্ডুতে গিয়ে ফেরিওয়ালা হবে, কাঠমাণ্ডু যেতে খরচ কম, কিন্তু আয় অনেক। ওখানে নরমাংসভোজী হিন্দুত্ববাদ বা বর্ণপ্রথার বর্বরতা নেই। পূর্ব নেপালের হাজার হাজার মানুষ যেমন শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি আসে, তেমনি বিহারের মানুষ ছড়িয়ে গেছে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়, ঠিক যেমন নোয়াখাইল্লারা।
বিহার থেকে সব মানুষ তো পালাতে পারেনি, অনেক মানুষ বিহারে আছে। তারা খুব কষ্টে আছে, যেমন আছে ঢাকা শহরের জেনেভা ক্যাম্পে। পুরো বিহার একটি বন্দী শিবির। সেই বন্দিদের আবার আছে সামন্তবাদী মর্দামো। ভাতার হলে স্ত্রী-পুত্র কন্যার মুখে খাবার দিতেই হবে? যখনই খাবারে টান পড়েছে, মর্দামো নেতিয়ে পড়েছে, তখনি দড়ি পড়েছে মরদের গলায়।
বিহারের ছড়িয়ে পড়া এসব মানুষের দারিদ্র হচ্ছে ভারতশত্রু নেহেরু ও গণশত্রু ইন্দিরা গান্ধীর ভুল রাজনীতির ফল। সিপিএম-এর এক মূর্খ অর্থ মন্ত্রী ছিলো নাম তার অশোক মিত্র। সে কোনোদিনই বোঝেনি, কৃষিভিত্তিক স্বাধীন শিল্পায়ন দরকার পশ্চিমবঙ্গে। দিল্লি বোম্বাইয়ের মাড়োয়ারি-গুজরাটি শিল্পপতি টাটা-বিড়লা-বাজাজ-আম্বানির ফাসি নিশ্চিত করে, নেহেরু-ইন্দিরার গণহত্যাগুলোর বিচার করেই কেবল এগোনো যেত, এটা সিপিএমের গান্ডুগুলোকে কে বোঝাবে। বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলোতে সম উন্নয়ন করতে হলে যে স্বাধীন শিল্প গড়ে তুলতে হবে এটা তাদের কে বোঝাবে? না, তারা শুধু কৃষককে ফাঁসিতে লটকাতে জানে, আর জানে কংগ্রেসের পশ্চাৎদেশ চাটতে।
গো বলয়ে দাসপ্রথা
করোনা মহামারীতে অক্সিজেন নেই তো কী হয়েছে, আছে গো-বলয় বা হিন্দি বলয়ের গোমূত্র। সেই দেশে ইতর প্রাণী গরু, বান্দর, হনুমান এমনকি ওলাওঠার মতো একটা ব্যাকটেরিয়া পর্যন্ত দেবতা হয়ে গেছিল। মানুষ ছিল এবং এখনো আছে এসব ইতর প্রাণীর চেয়ে অনেক নিচের স্তরে।
সেই দেশে প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তিভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে হাজার বছরের স্থবির কৃষকের গ্রামগুলো। উত্তরাখন্ড, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা আর রাজস্থানের গ্রামগুলো শত শত বছর ধরে পড়ে আছে সেই আদিম কৃষি উৎপাদনের পর্যায়ে। বিহারে বন্যার ফলে নদী ভাঙনে সর্বশান্তরা ছুটছে দিল্লি কাঠমাণ্ডো আর কলকাতায়। মহারাষ্ট্রে গাছ গাছালিবিহীন এক বিরাট জনপদ ধ্বংস হয়েছে গত সত্তর বছরে।
ভারতে টাটার তৈরি করা বিভিন্ন যানবাহনের পেছনে লেখা থাকে মেরা ভারত মহান। সেই নিপীড়িত জনগণের দেশে, প্রধানত উত্তরাখন্ড, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা আর রাজস্থান আর মহারাষ্ট্রে, কৃষক বিদ্রোহ হাতে গোনা। প্রবীর ঘোষ লিখেছেন,
“ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষদের চেয়ে অনেক কম নিপীড়িত মানুষরাও বহুদেশে শাসকদের গদি উল্টিয়ে দিয়েছে। সেসব দেশের জনগণের চেয়ে বহুগুণ বেশি শোষণ ও বঞ্চনাকেও সংখ্যাগুরু ভারতীয়রা প্রতিবাদহীন ভাবেই সহ্য করে আসছেন ভাগ্য ও কর্মফলের দোহাই দিয়ে”।
জোর করে বহুজাতিক একটি রাষ্ট্রকে গো বলয়ের অধীন রাখতে গিয়ে দিল্লির সেনাবাহিনী শুধু হাজার হাজার মানুষকে মারছে না; হাজার বছরের অজ্ঞতা, দাসত্ব, অন্ধতা মিলিয়ে দিল্লি যেন আক্রান্ত হয়েছে জাতিদম্ভী নিষ্ঠুর শাসক কংগ্রেস আর বিজেপির তৈরি করা দানবের কবলে।
ছবিটির ইতিহাস: ছাবু মন্ডল, বিহারের লোক; অভাবে আত্মহত্যা করেছেন। এইটি তার পরিবারের দৃশ্য। এখন আর হাড়ি চুলায় উঠবে না।
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ১৯ মে ২০২০, “ভারতে দাসপ্রথা প্রসঙ্গে”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল https://www.roddure.com/international/slavery-in-india/
২. Farzand Ahmed, ২১ জানুয়ারি ২০১৪, “More than 200 Adivasis rescued from labour camps in Tripura” দি টেলিগ্রাফ, অনলাইন এডিশন, https://www.indiatoday.in/magazine/indiascope/story/19800715-more-than-200-adivasis-rescued-from-labour-camps-in-tripura-821272-2014-01-21
৩. প্রবীর ঘোষ, সংস্কৃতি সংঘর্ষ ও নির্মাণ, দেজ পাবলিশিং কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ জুন ২০০০, পৃষ্ঠা ৯৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।