ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন হচ্ছে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অধ্যায়

ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন বা ভারতীয় সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বা ভারতের বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (ইংরেজি: Revolutionary movement for Indian independence) হচ্ছে ভারতীয় বিপ্লবীদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বহুবিধ কার্যকলাপের প্রধান অধ্যায়। এই আন্দোলন গোপন ও প্রকাশ্য বিপ্লবী দলগুলির ক্রিয়াকলাপের একটি অংশ ছিল।

ভারতের স্বাধীনতার শত্রু মুৎসুদ্দি প্রতিনিধি সাম্প্রদায়িক সামন্তবাদী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত সাধারণভাবে আইন অমান্য আন্দোলনের বিরোধী পক্ষ হিসাবে সেসময়ের ক্ষমতাসীন আধুনিক বর্বর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলি এই সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনা করে। বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলি মূলত বাংলা, মহারাষ্ট্র, বিহার, যুক্ত প্রদেশ এবং পাঞ্জাবে কেন্দ্রীভূত ছিল। আরও গোটা ভারত জুড়ে কিছু গোষ্ঠী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বিশ শতকের আগেই এটি শুরু হয় এবং বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এটি চালু থাকে।[১]

ভারতীয় আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের দ্বারা রাজনৈতিক সন্ত্রাসের এই কৌশল গ্রহণ অনেকাংশেই ইউরোপীয় বিপ্লবী সংগঠনের, বিশেষত রাশিয়ার প্রভাবেই ঘটেছিল। যেসব ব্রিটিশ বা ভারতীয় গুপ্ত আন্দোলনের পক্ষে আশু বিপদের কারণ হয়ে উঠেছিল কেবল তাদের বিরুদ্ধেই এটি প্রযুক্ত হতো। গুপ্তসমিতির নেতৃবৃন্দ সন্ত্রাসকে ভারতীয় সমাজের মধ্যে বৈপ্লবিক কার্যকলাপ বৃদ্ধির অনুঘটক হিসাবে বিবেচনা করতেন।

বাংলায় বিপ্লবী সমিতিগুলির কার্যকলাপ

বিশ শতকের গোড়ার দিকে গড়ে ওঠা এবং স্বদেশী ও স্বরাজ আন্দোলনে সক্রিয় বাংলা ও মহারাষ্ট্রের বৈপ্লবিক গোপন সমিতিগুলি গণ-আন্দোলনে মন্দাভাব দেখা দেয়ার পর রাজনৈতিক নৈরাজ্যবাদের কৌশল গ্রহণ করে। বাংলার গোপন সমিতির মধ্যে ঢাকার অনুশীলন সমিতি ও কলিকাতায় যুগান্তর পার্টিই প্রধান ছিল।[২]

ঢাকা এবং কলকাতা ছাড়াও অন্যান্য শহর, এমন কি গ্রামেও এগুলি তাদের শাখা গঠন করেছিল। পুস্তিকা ও কলিকাতার ‘যুগান্তর’-এর সংবাদ অনুসারে এই বিপ্লবী সমিতিগুলির আরব্ধ লক্ষ্য ছিল: ভারতীয় যুবকদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য লালন, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সম্ভাব্য যে কোনো পথে সংগ্রাম চালানোর প্রস্তুতি এবং পরিশেষে সশস্ত্র আক্রমণ ও সন্ত্রাস সৃষ্টির উদ্যোগ।[৩]

মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী সমিতিগুলির কার্যকলাপ

মহারাষ্ট্রেও আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা সক্রিয় ছিল। সেখানকার সমিতিগুলির মধ্যে ১৯০৭ খ্রীস্টাব্দে বিনায়ক ও গণেশ সাভারকর ভাইদের প্রতিষ্ঠিত ‘অভিনব ভারত’ সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল। ব্যংলা ও মহারাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সমিতিগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গুপ্ত সংগঠনও পঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং দক্ষিণ ভারতে সক্রিয় ছিল।

অন্যান্য সমিতির কার্যকলাপ

১৯০৮ খ্রীস্টাব্দেই বাংলা ও মহারাষ্ট্রে প্রথম সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত হয়। আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক সরকার নিষ্ঠুর প্রতিহিংসা গ্রহণ করে; হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্টদের মত্যুদণ্ড এবং গুপ্তসমিতির সদস্যদের দীর্ঘমেয়াদী বা কঠোর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু এইসব নির্যাতন সত্ত্বেও বৈপ্লবিক কার্যকলাপ পুরাপুরি থেমে যায় নি। নিশ্চিহ্ন সমিতিগুলির স্থলে নতুন দল ও সংগঠন দেখা দিতে থাকে। প্রথম মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে বারাণসীতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত অনুশীলন সমিতির একটি শাখা, মহারাষ্ট্রে ‘অভিনব ভারত সমিতি’, কলিকাতায় ‘রাজাবাজার সমিতি’ ও পূর্ববঙ্গে ‘বরিশাল সমিতি’ ইত্যাদি খুবই সক্রিয় হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ এবং পুলিশের দালাল শ্রেণীর ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস অব্যাহত থাকে। ১৯০৯-১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এইরূপ ৩২টি ঘটনা ঘটে। ১৯১২ খ্রীস্টাব্দে বিপ্লবীরা ভাইসরয় হার্ডিঞ্জকে হত্যার চেষ্টা করে এবং বোমা বিস্ফোরণে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন।

ভারতের বিপ্লবী জাতীয় আন্দোলন ১৯০৫-১৯০৬ খ্রীস্টাব্দের দিকে কিছুটা শক্তিবৃদ্ধি ঘটে। সে সময় আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে তাদের প্রচার জোরদার করেছিল। সৈন্য ও ননকমিশনড অফিসরদের তারা ভাবী অভ্যুত্থানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ভাবত। ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে কলিকাতায় অবস্থিত পঞ্জাবী সৈন্যদের মধ্যে অভ্যুত্থান ঘটানোর একটি চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯১৫ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে পঞ্জাবের প্রধান শহর লাহোর সহ উত্তর ভারতের পাঁচটি গ্যারিসনে একসঙ্গে অভুত্থান ঘটানোর একটি সতর্কতর প্রস্তুতি নিষ্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু ছদ্মবেশী জনৈক দালালের জন্য পরিকল্পনাটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং সংশ্লিষ্টরা বন্দী হন। অতঃপর রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বাধীন এর সংগঠকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন।

প্রথম ও প্রধানত জনগণের সঙ্গে দুর্বল সংযোগ এবং কোন অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসচির অনুপস্থিতির জনাই আসলে পেটি-বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী এই বিপ্লবীদের পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। উল্লেখ্য বৈষয়িক সহায়সম্পদহীন, নির্মম পুলিশী অত্যাচারের লক্ষ্যস্বরপ এই বিচ্ছিন্ন ও অতি সীমিত সংখ্যক গুপ্তসমিতিগুলি কেবল ছাত্র, শহরে পেটিবুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই তাদের কার্যকলাপ কেন্দ্রীভূত করেছিল। কোন কোন বছর গুপ্তসমিতিগুলির বিভিন্ন দলের মধ্যে সংযোগ ঘটলেও কোনদিনই এদের মধ্যে দেশব্যাপ্ত কোন সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয় নি। জাতীয় বিপ্লবীদের কার্যকলাপের মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠার এই অভাবের কারণ আসলে তৎকালীন ভারতীয় সমাজ-জীবনের বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে, তার জাতি, অঞ্চল, বর্ণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রতিবন্ধের মধ্যেই মূলীভূত ছিল।

যেহেতু তখনো ধর্মীয় ও অনান্য প্রথাসিদ্ধ নিয়মের দ্বারাই বিপুল সংখ্যাগুরু ভারতীয়রা চালিত হতো, সেজন্য ধর্মীয় আধেয় ব্যতিরেকে কোনো আবেদনই এই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এটি চরমপন্থী ও আত্মগোপনকারী সমিতিগুলির কার্যকলাপের ক্ষেত্র উভয়তই প্রযোজ্য। ১৯০৫-১৯০৮ খ্রীস্টাব্দে এদের ভাবাদর্শ তাই ব্যাপকভাবে অরবিন্দ ঘোষের প্রভাবাধীন হয় (১৯০৯ খীস্টাব্দের পর সক্রিয় রাজনীতি ত্যাগক্রমে তিনি ধর্মসংস্কার, শিক্ষা ও দার্শনিক সমস্যাবলী ব্যাখ্যায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সংহতির বিবিধ আবেদন প্রচার সত্ত্বেও কেন বিপ্লবী গুপ্তসমিতিতে কেবল হিন্দুরাই যোগ দিয়েছিল, এতেই তা ব্যাখ্যেয়। ইতিমধ্যে ভারতীয় মুসলমানদের রাডিকাল অংশের কার্যকলাপ সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির কাঠামোর মধ্যেই এগিয়ে চলছিল।

নির্বাসিত ভারতের বিপ্লবী আন্দোলন ও কার্যকলাপ

বিশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতের জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনের র‍্যাডিকাল প্রবণতাগুলি শুধু খোদ ভারতেই নয়, দেশের সীমান্তের বাইরেও বিকশিত হচ্ছিল। প্রবাসী ভারতীয়রা প্রথমে ইউরোপে এবং শেষে আমেরিকা ও প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বহু বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলেছিল। প্রবাসী ভারতীয়দের এরূপ প্রথম কেন্দ্রটি ১৯০৫ খ্রীস্টাব্দে লণ্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্যামাজী কৃষ্ণবর্মা নামক জনৈক প্রবাসী ভারতীয় সেখানে ইন্ডিয়ান হোমরুল সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষ্ণবর্মার উদ্যোগে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান সোসিওলজিস্ট’ নামের সাময়িকীটি পাঠকদের ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কৃষ্ণবর্মার ‘ভারত ভবন’ নামের যে বাড়িটিকে কেন্দ্র করে প্রবাসী ভারতীয়রা সংঘবদ্ধ হয়েছিল, আসলে সেটি ছিল ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ভারতীয় ছাত্রদের একটি আবাসিক ভবন। কৃষ্ণবর্মা ছাড়াও সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন বিনায়ক সাভারকর, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, এস. রাভাভাই রানা, ভি. ভি. এস. আয়ার প্রমুখরা। পুলিশী অত্যাচারের ফলে লণ্ডন দলের অধিকাংশ সদস্যই ১৯০৯-১৯১০ খ্রীস্টাব্দে প্যারিস চলে যেতে বাধ্য হন। ১৯১০-১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে সেখানেই প্রবাসী ভারতীয়দের দ্বিতীয় বৃহত্তম কেন্দ্রটি গড়ে উঠেছিল।

প্যারিসের দলটি গঠিত (এর প্রধান সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আর. কামা, হরদয়াল এবং লন্ডন থেকে আগত কৃষ্ণবর্মা, এস. রাভাভাই রানা, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভি. ভি. এস. আয়ার প্রমুখরা) হওয়ার পর ভারতীয় মুক্তি-আন্দোলনের বামপন্থী দলগুলির আন্তর্জাতিক সংযোগের পরিসর বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। অথচ ইতিপূর্বে এটি ব্রিটিশ উদারনৈতিক ও শ্রমিক দলের সদস্যদের মধ্যেই মূলত সীমিত ছিল। কামা, রানা, হরদয়াল প্রভৃতির শুধু ফরাসী সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গেই নয়, অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ, বিশেষত প্রবাসী রুশ বিপ্লবীদের সঙ্গে (সোশ্যাল ডেমোক্রাট) এবং সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকের সঙ্গেও সংযোগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্যারিস কেন্দ্রটি ভারতীয় গুপ্তসমিতিগুলির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে এবং সেখানে তাদের প্রকাশিত সাময়িকী ‘ইণ্ডিয়ান সোসিওলজিস্ট’ (কৃষ্ণবর্মা সম্পাদিত) ও ‘বন্দে মাতরম’ (কামা ও রানা সম্পাদিত) ভারতে পাঠায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্যারিসের ভারতীয় বিপ্লবীদের কেন্দ্রটি বস্তুত ভেঙ্গে পড়ে : কামা ও রানাকে অন্তরীণ করা হয়, কৃষ্ণবর্মা সুইজারল্যান্ডে ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বার্লিনে পালান। তাঁদের প্রকাশিত সাময়িকীগুলিও বন্ধ হয়ে যায়।

ইউরোপের এই সংগঠনগুলি ছাড়াও এই সময় উত্তর আমেরিকায় – কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই জাতীয় সংগঠন গড়ে উঠেছিল। ওইসব দেশের কারখানা ও অফিসে স্থানীয় সহকর্মীদের সমান সুযোগ-সুবিধা লাভের দাবি নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রবাসী ভারতীয়রা প্রথম সংগঠনগুলি (যেমন ‘ইউনাইটেড ইণ্ডিয়ান লীগ’) গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সেখানে আগত ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রভাবে অচিরেই এই সংগঠনগুলি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য লাভ করেছিল।

১৯০৬ খ্রীস্টাব্দে কানাডায় আগত বাঙ্গালী বিপ্লবী তারকনাথ দাস ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য চালনায় বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯০৮ খ্রীস্টাব্দে তারকনাথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে ‘ফ্রি হিন্দুস্তান’ নামক একটি সাময়িকী প্রকাশ শুরু করলে সেটি প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারকনাথের সামাজিক-রাজনৈতিক মতবাদ ছিল সাম্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক বুর্জোয়া সভ্যতার সমালোচনায় অনুরঞ্জিত। ‘লেভ তলস্তয়ের কাছে খোলা চিঠি’ নামক তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধে তিনি সর্বজনীন মানবভ্রাতৃত্বে নিজ আস্থা জ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গে যে কোনো বর্ণ, জাতি, সমাজ বা ব্যক্তিবিশেষ কর্তৃক অন্যদের শোষণের বিরোধিতা করেছিলেন। তারকনাথ এই প্রচারের মাধ্যমে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের একটি ব্যাপকভিত্তিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিত তৈরি করেছিলেন যার মূল সংগঠক ছিলেন হরদয়াল।

১৯১১ খ্রীস্টাব্দে সান ফ্রান্সিকো পৌঁছানোর পর অচিরেই হরদয়াল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী ভারতীয়দের এক উল্লেখ্য ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ১৯১৩ খ্রীস্টাব্দে তাঁর উদ্যোগে ‘গদর’ (বিদ্রোহ) নামক একটি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নামটি ১৮৫৭-১৮৫৯ খ্রীস্টাব্দের বিদ্রোহের স্মৃতি থেকেই চয়িত হয়েছিল। সেই বছরেই আমেরিকা প্রবাসী বিভিন্ন ভারতীয় সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠিত একটি কংগ্রেসে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ নামক যে-সংস্থাটি গঠিত হয়েছিল তারও মূলে ছিলেন হরদয়াল। অচিরেই সংস্থাটিকে ‘গদর’ নাম দেয়া হয়। আমেরিকা এবং জাপান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়, চীন ইত্যাদি সহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় বহু দেশে এটির শাখা-প্রশাখা জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। এর সদস্যরা ভারতে অভ্যুত্থান ঘটানোর বহু পরিকল্পনা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দলনেতাদের পরিকল্পনা মোতাবেক বিপ্লবীদের কোষকেন্দ্র হিসাবে কাজের জন্য প্রবাসীদের নিয়ে সৈন্যদল গঠন করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে প্রবাসীদের (যাদের কেউ কেউ ছিল খুবই ধনী) কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থে অস্ত্রশস্ত্রও ক্রয় করা হয়েছিল। সাপ্তাহিক সংবাদপত্র গদর এবং বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় মার্কিন প্রবাসী দলনেতাদের প্রকাশিত পুস্তিকাগুলি খোদ ভারতেও প্রচারিত হওয়ার ফলে সেগুলি জনগণের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার পক্ষে শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।

১৯১৪ খ্রীস্টাব্দের গ্রীষ্মে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বাধলে ভারতের সামাজিক অর্থনৈতিক শক্তিগুলির সঙ্গে পেটিবুর্জোয়া বিপ্লবীদের দৃষ্টিভঙ্গিও প্রভাবিত হয়েছিল।

বিপ্লবী আন্দোলনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি

বিপ্লবী নেতা বালগঙ্গাধর তিলক মনে করতেন যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সমাজসংস্কার মিশিয়ে ফেললে গোঁড়া রক্ষণশীলরা কংগ্রেসের প্রতি অসন্তুষ্ট হবে। তাতে ক্ষতি হবে আন্দোলনের। তিলক ব্যতীত বিপ্লবী অন্যান্য নেতারা চাইলেন ঐতিহ্যপন্থী, ইংরেজী শিক্ষা বঞ্চিত অথচ দেশী ভাষায় শিক্ষিত জনগণের এক বৃহদাংশকে কংগ্রেসের বাইরে বিভিন্ন দলে সামিল করতে। সামাজিক ভাবে বিপ্লবীরা তাই হয়ে উঠলেন প্রগতিশীল।

অন্যদিকে তিলকের অনুসারীরা বললেন যে বিদেশী রাজশক্তির আইনের মাধ্যমে যদি সমাজ সংস্কার করা হয় তবে তা বিদেশী রাজশক্তিরই শক্তি বৃদ্ধি করবে। তাই ১৮৯১ সালে তিলক সহবাস বিষয়ক আইনকে সমর্থন জানান নি। তিনি সংস্কারকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন ও বহু পুরাতনপন্থী, দেশীয় ভাষায় শিক্ষিত, এমনকি অশিক্ষিত লোকের সমর্থন পেলেন।

ঔপনিবেশিক শোষণের ধারা অব্যাহত থাকাতে দেশের তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা দিয়েছিল এক হতাশাবোধ। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুযোগ না পেয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত যুবকেরা ক্রমশঃ সরকারী চাকুরী বা আইন ব্যবসায়ের দিকে ঝুঁকেছিলেন। অনেক উদ্যোগী যুবক আবার সাংবাদিকতাকে তাদের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তবে সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্র ছিল অত্যন্ত সীমিত। ১৯০৩ সালে সারা ভারতে মাত্র ১৬,০০০ ভারতীয় কর্মচারী ছিলেন যাঁদের মাইনে ৭৫ টাকার বেশি। আইনের ক্ষেত্রেও সাফল্যের সম্ভাবনা কম ছিল আর সাংবাদিকতা তখনও খুব অনিশ্চিত পেশা। সফল ডিগ্রীধারীদের চাইতে পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে এমন যুবকের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী। চাকুরীর ক্ষেত্রে এরা ছিল যোগ্যতাহীন। এদের মধ্যেই হতাশার ভাব সবচেয়ে বেশী তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছিল।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সম্পন্ন পল্লীজীবী এবং সাধারণ কৃষকদের মধ্যেও অসন্তোষের হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেও বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছিল। মধ্যপন্থীদের সংস্কার আন্দোলন এদের নাড়া দিতে পারে নি। বিপ্লবী আন্দোলনের নেতারা এদের কাছে তাদের ডাককে পৌঁছে দিয়েছিলেন।[৪]

আলোকচিত্রের ইতিহাস: মূল চিত্রটি জালিয়ানওয়ালাবাগ স্মৃতিসৌধ, ৯ আগস্ট, ২০১৬ নেপালি আলোকচিত্রী Bijay chaurasia-র (विजय चौरसिया) তোলা আলোকচিত্র। CC-BY-SA-4.0

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ২৩ অক্টোবর ২০১৯, “ভারতীয় বিপ্লবীদের কার্যকলাপ ভারতের বিপ্লবী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের একটি প্রধান অধ্যায়”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/history/revolutionary-movement-for-indian-independence/
২. চিন্মোহন সেহানবীশ গণেশ ঘোষ ও অন্যান্য, মুক্তির সংগ্রামে ভারত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা দ্বিতীয় সংস্করণ ডিসেম্বর ২০১০ পৃষ্ঠা ৫৬;
৩. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা- ৫১৩-৫১৮।
৪. স্নিগ্ধা সেন, ঐচ্ছিক ইতিহাস, “চরমপন্থা, স্বদেশী আন্দোলন, এবং সুরাটে কংগ্রেসের ভাঙ্গন”, নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, দ্বিতীয় পুনঃমুদ্রণ জুন ২০০৮, পৃষ্ঠা ১১৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!