বর্ণবাদ হচ্ছে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি ও ক্রিয়াকলাপের চর্চা করা যাতে কোনো গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা অঞ্চলের মানুষকে কোনো একটি গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী অথবা অধিক যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়।
বর্ণবাদ প্রকাশ পায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে। এই বর্ণবাদী আচরণ দক্ষিণ এশিয়ায় গত আড়াই হাজার বছর ধরেই আছে। সবচেয়ে বড় বর্ণবাদী আচরণ আমরা দেখেছি জমিদার ও সামন্তপ্রভুদের ক্ষেত্রে। আধুনিক বর্বর ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরাও এদেশে বর্ণবাদী আচরণ চালু রাখে। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজদের ক্লাবে নেটিভদের প্রবেশাধিকার ছিল না। জমিদারদের বাড়ির সামনে দিয়ে তেমনি জুতা পরে যাওয়া যেত না, ব্রাহ্মণদের ছায়া মাড়ানো যেত না; এমন আরো হরেক রকম বর্ণবাদী আচরণ ছিল একশ বছর আগেও।
দুএকটি উদাহরণ দেয়া যাক। মোহনদাস গান্ধীকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। হাজী মহসিনকে ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণিতে জোর করে ভ্রমণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। জসীম উদ্দীন কত বড় কবি, তার জন্যও আলাদা প্লেট রাখতেন চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের মাতা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো নোয়াখালীতে এসে বলেই ফেলেছিলেন, এত মশা আর কচুরিপানার ভেতরে মানুষ থাকে কী করে! বাংলার বৈচিত্র্য না দেখে এরা মনের ভেতরের বর্ণবাদী আচরণকে প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্নভাবে। তেমন বর্ণবাদী আচরণ চলমান আছে ময়মনসিংহে।
ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিজয় এক্সপ্রেস নামে একটি ট্রেন চলে। গত ১ নভেম্বরের আগে ট্রেনটি জামালপুর থেকে চলবে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু ময়মনসিংহের কিছু বর্ণবাদী ও সংকীর্ণতাবাদী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন। তথাকথিত ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতির তীর্থভূমি’ ব্রহ্মপুত্র তীরের ময়মনসিংহ শহর এখন এমন কয়েকজন বর্ণবাদী, সংকীর্ণতাবাদী সামন্তপ্রভুদের দখলে। এই বর্ণবাদীরা এখন জামালপুর থেকে যে ট্রেন আসবে সেটিতে চড়বে না। কারণ হিসেবে তারা বলছে, এটার সাথে তাদের স্মৃতি ও আবেগ জড়িত, তাদের ঐতিহ্য ও অহংকার জড়িত। এসব কথা বলে তারা তাদের বর্ণবাদী আচরণকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে।
বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেন নিয়ে লিখিত একটি পোস্টার।
আমরা জানি জামালপুর একটি পশ্চাৎপদ জেলা, পাশের কুড়িগ্রাম জেলাটি আরো পশ্চাৎপদ। এই দুই জেলার গরীব লোকজন যে ট্রেনে উঠবে, সেই লোকজনের সাথে একই ট্রেনে উঠতে চাচ্ছে না ময়মনসিংহের বর্ণবাদীরা। এই লাটসাহেবরা আলাদা ট্রেন দিতে বলছে জামালপুরবাসীদের জন্য। এই বর্ণবাদী আচরণের মূল কথা হচ্ছে ময়মনসিংহের জমিদার-লাটসাহেবরা জামালপুরের লোকজনের সাথে একই ট্রেনে উঠবে না, পাশাপাশি বসবে না। তারা তাদের এই বর্ণবাদী আচরণকে ‘আন্দোলন’ বলে চালানোরও চেষ্টা করছে। দুঃখের বিষয় এটা প্রথমে শুরু করে একজন ছড়াকার। পরে কয়েকজন সাহিত্যিক লাটসাহেব এই বর্ণবাদী আচরণের পক্ষে জনমত তৈরি করা শুরু করে। যুক্ত হয় কয়েকজন বটতলার উকিল ও সাংবাদিক। মজার বিষয় হচ্ছে এমনকি কমিউনিস্ট নামধারী একটি সংগঠনের কয়েকজন পর্যন্ত সেই বর্ণবাদী আচরণের সঙ্গে জড়িত হন। একটি তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টির লোকজন কীভাবে একটি দুরপাল্লার ট্রেনের একটি পশ্চাৎপদ জেলায় চলাচলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
আরো পড়ুন
- যুক্তফ্রন্ট ও যুবসমাজ
- ট্রেড ইউনিয়ন ঐক্যের জন্য সংগ্রাম
- ময়মনসিংহে সাম্প্রতিক বর্ণবাদচর্চা
- ফ্যাসিবাদ-বিরোধী গণফ্রন্ট
- যুক্তফ্রন্টের সারবস্তু ও রূপ
- যুক্তফ্রন্ট-বিরোধীদের প্রধান যুক্তি
- যুক্তফ্রন্টের গুরুত্ব
- ফ্যাসিবাদ একটি হিংস্র কিন্তু অস্থিতিশীল শক্তি
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উৎস ও চরিত্র
- ফ্যাসিবাদের জয় কি অনিবার্য?
- বিজয়ী ফ্যাসিবাদ জনগণের জন্য কী বহন করে আনে?
- ফ্যাসিবাদের শ্রেণি চরিত্র
- সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদী চিন্তা হচ্ছে আগ্রাসনবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী
- সুভাষচন্দ্র বসুর রাষ্ট্রচিন্তা হচ্ছে স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ও জাতীয় মুক্তি
জামালপুরের লোকজন সিএনজি ও বাসে করে এসে এই ট্রেন ধরে। বাস্তব সত্য হচ্ছে ময়মনসিংহের বর্ণবাদীরা যে আচরণ করছে তা মূলত বাস মালিক ও সিএনজি মালিকদের পক্ষে যাচ্ছে। যেখানে সারা দেশে রেলপথকে জালের মতো ছড়িয়ে দেয়া দরকার, সেখানে এরকম একটি বর্ণবাদী চর্চাতে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ছড়াকার, আবৃত্তিশিল্পীর নেতৃত্বদান খুব বাজে উদাহরণ সৃষ্টি করছে। আশা করি ময়মনসিংহের লোকজনের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং তারা এসব নোংরা আচরণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।