নববর্ষ হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সূর্যকেন্দ্রীক নতুন বছর বরণের উৎসব

নববর্ষ বা বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ বা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সৌর নববর্ষ (ইংরেজি: Pohela Boishakh) হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সূর্যকেন্দ্রীক নতুন বছর উদযাপনের উৎসব। এই উৎসবটি অঞ্চলভেদে ১৩ এপ্রিলে শুরু হয়ে পুরো এশিয়াজুড়ে চলতে থাকে এবং শেষ হয় ১৭ এপ্রিলে। সাতদিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠান হচ্ছে কৃষিনির্ভর ও সূর্যনির্ভর মানবজাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।

এই নববর্ষকে ইংরেজি ভাষায় ‘South and Southeast Asian solar New Year’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। আসামে এটার নাম ‘ব’হাগ বিহু বা ৰঙালী বিহু’। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় এটার নাম পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। উড়িষ্যাতে এটার নাম পনা সংক্রান্তি বা মহাবিষুব সংক্রান্তি। অরুণাচল প্রদেশের খামটি, চিংফৌ, খাময়াঙ, টাংছা এবং আসামের টাই ফাকে, টাই আইটন এবং টুরুঙ জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত লোকজন এটাকে সাংকেন নামে ডেকে থাকে। বোড়োল্যান্ডে এটাকে বলা হয় বৈসাগু। বৈসু বলা হয় ত্রিপুরায়। চাকমারা বলে বিজু। তামিলনাড়ুতে বলা হয় পুথান্ডু। মালয়ালাম ভাষায় এটার নাম বিষু। কর্ণাটকে এটার নাম বিসু পরব। মৈথিলীতে এটার নাম জুর সিতাল, নেপাল পাঞ্জাব ও মধ্য ভারতে বৈশাখী, শ্রীলঙ্কায় অলুথ অভুরুদ্ধ।

বার্মাতে অনুষ্ঠিত এই নববর্ষটির নাম থিংযান, লাওসে পি মাই, থাইল্যান্ডে সংক্রান, কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান্তি বা ছৌল ছনম থমে। চীনের ইউনানের দাই জনগণ জল নিক্ষেপের অনুষ্ঠান করে থাকে যা নববর্ষ নামেই পরিচিত।

নববর্ষ শব্দটির উৎপত্তি

সূর্যকেন্দ্রীক কৃষিজীবী মানুষের জীবনে নববর্ষ হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অন্তত তিন হাজার বছর ধরে চলমান এক শক্তিশালী সংস্কৃতি। এপ্রিল মাসের সবচেয়ে গরম দিনগুলোতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এটি পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, চীনের ইউনান প্রদেশের দাই জনগণ, ভারত, মায়ানমার, নেপাল, থাইল্যান্ড এবং শ্রী লঙ্কার মতো দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে নববর্ষ উদযাপিত হয়।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ ও সংস্কৃতি বৃহত্তর বাংলা এবং মহাভারতীয় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে রয়েছে, তাই তাদের ঐতিহ্যবাহী বর্ষপঞ্জির বিকাশ প্রাচীন পঞ্জিকার কোনো না কোনো রূপ দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত হয়েছে। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের অন্যান্য অনেক পঞ্জিকার মতো, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন বছরটি উত্তর গোলার্ধের মহাবিষুব (বসন্তের শুরু) -এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। যাইহোক, বাংলাসহ ভারতীয় অন্যান্য পঞ্জিকায় বছরটি ছিল পার্শ্বীয় বছরের (অর্থাৎ তারার সাপেক্ষে সূর্যের গতিবিধি) উপর ভিত্তি করে, যখন পাশ্চাত্যের গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি গ্রীষ্মমন্ডলীয় বছরের (ঋতু চক্র) উপর ভিত্তি করে চালু আছে।

ইদানিং, জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে, মেষ তারকামণ্ডলে সূর্যের প্রবেশ ১৮ এপ্রিলের কাছাকাছি ঘটে। কিছু ঐতিহ্যবাহী বর্ষপঞ্জিকা এখন সূর্যের প্রকৃত গতিবিধি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে যখন অন্যগুলি গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিতে স্থির করা হয়েছে। বাংলা বর্ষপঞ্জিকা হাজার হাজার বছর ধরে সূর্যের গতিবিধির উপরে নির্ভর করে তৈরি।

নববর্ষ উদযাপনের একটি ভিডিও দেখুন

উপরের বর্ণিত শব্দগুলোর একটি মূল শব্দ হচ্ছে বিসু বা বিষু যা বিষুব ও বিষুবরেখা শব্দ দুটিকে মনে করিয়ে দেয়। বার্ষিক গতির ফলে নিরক্ষরেখায় বা বিষুব রেখায় সূর্যের গমনকে বিষুব বলা হয়।

মেষ তারকামণ্ডলের ভেতরে সূর্যের প্রবেশের বাৎসরিক ঘটনা সংস্কৃত ভাষায় মেষ সংক্রান্তি নামে পরিচিত এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এটাকে মেষ সংক্রান্তি এবং সংক্রান হিসাবে উদযাপন করা হয়।

এরকম বিশাল একটি উৎসব মোগল দরবারের কারো পক্ষেই চালু করা সম্ভব ছিল না। এটা চালু হয়েছে অন্তত দুই হাজার বছর বা তারও পূর্বে যখন মানুষ বুঝেছিল বর্ষা সমাগত প্রায়, সূর্য উত্তরের বিন্দুতে চলে এসেছে এবং মেষ তারকামণ্ডলে প্রবেশ করেছে। মানুষের জীবনে প্রভাবশালী এমন একটি উৎসবের শক্তি যতদিন সূর্য আছে, মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ আছে ততদিনই থাকবে।

আলোকচিত্রের ইতিহাস: আনুমানিক নবম শতকে আঁকা পাগান সাম্রাজ্যের নববর্ষ বরণ বা থিংযান উৎসবের নৃত্য।

Leave a Comment

error: Content is protected !!