অসহযোগ আন্দোলন (ইংরেজি: Non cooperation Movement) হচ্ছে ভারতের জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াশীল নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ১৯২০-২২ সালে পরিচালিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও ভারতীয় জমিদার ও মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ী শ্রেণির ক্ষমতা কুক্ষিগত করার আন্দোলন। এই আন্দোলনে জনগণের বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ভারতের জমিদারশ্রেণি নিজেদেরকে সারা ভারতে কৃষক শ্রমিকদের উপর ক্ষমতার ছড়ি ঘোরানোর দক্ষতা অর্জন করে।[১]
অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা ঘটে ইংরেজদের প্রস্তুত করা এবং ভারতে আমদানী করা পণ্যের বর্জন এবং তাকে ভস্মীভূত করা, মাদকদ্রব্যের পণ্য বয়কট করা নিয়ে। ক্রমান্বয়ে এই আন্দোলন খাজনা এবং ট্যাক্স প্রদান না করা, ইংরেজ সরকারের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র এবং শিক্ষক দ্বারা বর্জন, এমনকি আইন ব্যবসায়ীদের দ্বারা আইন আদালত বর্জন পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে।[২]
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ইংরেজ সরকার ভারতে দমননীতি তীব্র করে তোলে। ভারতেও বিচ্ছিন্নভাবে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত এবং বিস্ফোরিত হতে থাকে। ইংরেজ সরকার ‘রাওলাট বিল’ পাশ করে বিনাবিচারে গ্রেপ্তার, আটক এবং নির্যাতনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কার্যত এই আন্দোলনকে পূর্ববর্তী ১৯১৯ খ্রি রাউলাট অ্যাকটের বিরুদ্ধে পরিচালিত সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি বলা যায়। রাউলাট আইনের সাহায্যে সরকারের দমননীতির প্রতিবাদ, জালিয়ানওয়ালাবাগে সরকারি ফৌজের নৃশংস গণহতার প্রতিকার এবং খিলাফতের বিষয়ে ইংরেজদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা সমেত ১৯১৯ খ্রি ভারত শাসন আইনের ত্রুটি সমুহের ফলে যে অসন্তোষ দেখা দেয়, সে সব মিলিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের পশ্চাৎপট রচিত হয়েছিল।
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ
অসহযোগ শব্দটি গণশত্রু গান্ধী বস্তুত খিলাফত আন্দোলনসূত্রে উদ্ভাবন করেছিলেন। পরে জাতীয় আন্দোলনের বিভিন্ন দাবির সঙ্গে খিলাফত আন্দোলনের দাবিসমূহ যুক্ত হয়। অসহযোগ আন্দোলন ২ অগস্ট ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে সূচিত হয়। অসহযোগ আন্দোলনে হিংসার প্রয়োগ ছিল নীতিবিরুদ্ধ। অহিংসাভাব প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের একটি প্রধান ভাব। জীবমাত্রই ঈশ্বরের সৃষ্টি। ঈশ্বরের কোনো সৃষ্টি বিনষ্ট করা উচিত নয়। এই বোধ থেকে জৈন ধর্ম কোনো প্রকার জীবহত্যাকে অধর্ম বলে বিবেচনা করে।
অসহযোগের সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক সংকল্পে অবিচল থেকে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করাই ছিল লক্ষ্য। দ্বিতীয়ত, আন্দোলন মূলত গঠনপ্রয়াসী হলেও সংগ্রামের প্রয়োজনকে অস্বীকার করা হয়নি। তৃতীয়ত, অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে ব্যক্তিগতভাবে এবং সমবেতভাবে জনগণ নিষ্কলুষ বিদ্রোহের পথে এগোবে, সংযুক্ত প্রয়াসের মাধ্যমে মানুষ শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হয়ে স্বরাজের অভিমুখে অগ্রসর হবে।
ভারতীয় জনগণের শত্রু মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন জনগণের বিপ্লবী শক্তির বিরোধী। জনগণের বিদ্রোহকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য গণশত্রু গান্ধী খিলাফত সম্মেলনে নভেম্বর, ১৯১৯ সালে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযােগের আদর্শ ব্যক্ত করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ের অসহযোগ নামাঙ্কিত এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের ভেতরে তীব্র উদ্দীপনা দেখা দেয় এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কংগ্রেস একটি বৃহৎ আকার ধারণ করে জনগণের উপর চেপে বসে। এই ঘটনার পরেই জনগণ কংগ্রেসের নিপিড়নের কাছে হেরে যায়।[৩]
গণসংগ্রামের প্রারম্ভকাল
১৯১৯ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ভারতের বহু শহরে অনুষ্ঠিত হরতাল ছিল প্রগতিশীল অগ্রগতির পথে একটি নতুন পর্যায়ের সূচক। এটি ছিল ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের অর্থনৈতিক ধর্মঘট থেকে শহরে জনসাধারণের ব্যাপক অংশের শরিকানা সহ কখনো কখনো সংগ্রামের চরম রপে হিসাবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে উত্তীর্ণ হওয়া একটি গণসংগ্রাম।[৪]
গণসংগ্রামের সময়কার উল্লেখ্যোগ্য সাফল্যগুলি পাঞ্জাবে অর্জিত হয়েছিল। কারণ হিসেবে প্রথমত বলা যায়, পঞ্জাবকেই সবচেয়ে বেশি রক্তকর দিতে হত, কেননা এখান থেকেই ইঙ্গ-ভারতীয় সৈন্যদের প্রধান অংশ নিযুক্ত হত। দেশের শস্যভাণ্ডারখ্যাত এখানকার কৃষকরা সামরিক খরচার প্রধান চাপ বহন করত এবং পাঞ্জাবের কারিগর ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলি বহদায়তন শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পাঞ্জাব সোভিয়েত মধ্য-এশিয়ার নিকটতম হওয়ায় বৈপ্লবিক ঘটনাবলীর সংবাদ সেখানে অপেক্ষাকৃত দ্রুত পৌঁছাত ও শিখ সৈনারা দেশে ফিরলে তা আরও ছড়িয়ে পড়েছিল। তৃতীয়ত, পাঞ্জাবে গদর পার্টির প্রভাব তখনো অব্যাহত ছিল ও এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগকারী প্রবাসী বিপ্লবীদের প্রভাবও এখানে অটুট ছিল।
১৯১৯ সালের মার্চ মাস থেকেই পঞ্জাবের বিভিন্ন শহরে স্থানীয় জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশবিরোধী সভা ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠান শুরু করেছিল। ১০ এপ্রিল ব্রিটিশ শাসকরা অমৃতসরের দুজন জনপ্রিয় নেতা, সৈফুদ্দিন কিচলু ও সত্যপালকে বহিষ্কার করলে সারা দেশে প্রতিবাদের নতুন ঝড় বয়ে গিয়েছিল। অতঃপর পঞ্জাবের আরও দুটি শহর, লাহোর ও গুজরানওয়ালায় হরতাল ও বিক্ষোভ ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের রূপলাভ করেছিল এবং এতে শ্রমিকরা, বিশেষত রেলশ্রমিকরা সক্রিয় অংশ নিয়েছিল।
এইসময় গভর্নর ওডয়ের এবং জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে পঞ্জাবের ঔপনিবেশিক প্রশাসন রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে নৃশংস প্রতিশোধ গ্রহণের পরিকল্পনা করেছিল। এই উদ্দেশ্যেই ৯ এপ্রিল পাঞ্জাবে নতুন সৈন্য তলব করা হয়েছিল। ১৩ এপ্রিল কিচলু, ও সত্যপালের বহিষ্কারের প্রতিবাদে বিক্ষোভরত নিরস্ত্র নরনারীর উপর সৈন্যবাহিনী গুলি চালায়। এর ফলে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ ময়দানে প্রায় এক হাজার অসহায় মানুষ নির্মমভাবে নিহত ও প্রায় দুই হাজার আহত হয়। ডায়ার তখনই কারফু জারি করে এবং সেজন্য কোন চিকিৎসা-সাহায্য পৌছতে না পারায় ময়দান ও আশপাশের রাস্তায় অনেকেই বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারায়। পরে পঞ্জাবে সামরিক আইন জারি করা হয় এবং ব্যাপক গ্রেপ্তার ও অবাধ নির্যাতন ইত্যাদি চলে।
কিন্তু এই নিষ্ঠুর অত্যাচারেও ব্রিটিশদের ঈপ্সিত ফল ফলে নি। পক্ষান্তরে, লাহোর ও অমৃতসরে প্রধানত লাঠিধারী ‘দণ্ডফৌজ’ নামে এক রক্ষিবাহিনী গড়ে তোলা হয়। সারা দেশে তখন রাজনৈতিক কার্যকলাপের জোয়ার দেখা দিয়েছিল। থানা আক্রমণ ও বন্দীদের ছিনিয়ে নেওয়া নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় কৃষকদের সহায়তায় রেলকর্মীরা কয়েকটি সৈন্যবোঝাই ট্রেনও লাইনচ্যুত করেছিল। ১৯১৯ খ্রীস্টাব্দের ঘটনাবলী মোটই জাতীয় কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল না।[৪] ভি আই লেনিন পঞ্জাবের এই ঘটনাবলী ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেছিলেন। প্রাচ্যের শক্তি-আন্দোলনের আলোচনায় তিনি ভারতে এই আন্দোলনের নতুন পর্যায় সম্পর্কে লিখেছিলেন:
“এইসব দেশের পুরোভাগে আছে ব্রিটিশ ভারত, বিপ্লব সেখানে ততই দ্রুত বাড়ছে যত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে, একদিকে শিল্প ও রেলওয়ে প্রলেতারিয়েত এবং, অন্যদিকে, ব্রিটিশরা বর্বর সন্ত্রাসের মাত্রা বৃদ্ধি করছে; তারা সর্বকালের তুলনায় ঘন ঘন গণহত্যা (অমৃতসর) ও ব্যাপক প্রকাশ্য বেত্রাঘাত ইত্যাদির আশ্রয় নিচ্ছে।”[৫]
অসহযোগ আন্দোলন ঘটার প্রেক্ষাপট
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত খিলাফত সম্মেলনে চতুর্মুখী কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল : ১. সরকারি খেতাব ও কাউন্সিলের সদস্যপদ ত্যাগ, ২. সরকারি পদ থেকে ইস্তফা, ৩. পুলিশ ও সামরিক বিভাগ থেকে পদত্যাগ এবং ৪. খাজনা প্রদান বন্ধ । খিলাফতি ধর্মীয় আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিকে জড়িয়ে ফেলার বিরোধিতা করেন কংগ্রেসের অনেক নেতা ও কয়েকটি প্রাদেশিক কমিটি। কিন্তু ভারতীয় জনগণের চিরশত্রু গান্ধী তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং ধর্মের সাথে রাজনীতিকে জড়িয়ে একজন পাকা ধুরন্ধর হিসেবে নিজের শক্তি কুক্ষিগত করেন।
সেপ্টেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক বিশেষ সম্মেলনে বিরোধীদের সংখ্যা হ্রাস পায় এবং কর্মসূচিতে আরও পাঁচটি বিষয় যুক্ত হয় : ১. যাবতীয় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কট এবং জাতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, ২. ইংরেজদের আদালত বয়কট ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রবর্তন, ৩. মেসোপটেমিয়াতে সামরিক ও করণিক কর্মচারী এবং শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করা, ৪. কাউন্সিল নির্বাচন বয়কট এবং ৫. বিদেশি পণ্যের শ্রমিক বয়কট।
ডিসেম্বরে নাগপুরে অনুষ্ঠিত বার্ষিক অধিবেশনে অতিরিক্ত স্বরাজ দাবি যুক্ত হয়ে অসহযোগ প্রস্তাব বিপুল ভোটাধিক্যে গৃহীত হয়। এক বছরে স্বরাজ পাওয়া যাবে বলে গান্ধী ঘোষণা করেন। বিপুল উদ্দীপনায় কংগ্রেস যথার্থই একটি জমিদারদের সর্বাত্মক দলে পরিণত হয়। কৃষকদের সাথে প্রতারণার উদ্দেশে ভড়ং ধরার জন্য সব ভণ্ডরা কংগ্রেসের গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে খাদি বস্ত্র, গান্ধী টুপি পরিধান বাধ্যতামূলক করে। চরকা-খদ্দর, মাদকতা বর্জন, অস্পৃশ্যতা পরিহার, কথায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য কর্মসূচি অঙ্গীভূত হয়। কিন্তু ভেতরে হিন্দু মুসলিম অনৈক্য চালু থাকে।
যেহেতু এসব বদমায়েশি কাজ চালানোর জন্য টাকা দরকার, তাই কথিত গঠনকর্মের নাম করে টিলক স্বরাজ্য-ভাণ্ডারে এক কোটি টাকা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়। অতঃপর সারা দেশে বিক্ষিপ্ত আকারে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে মালাবারে সশস্ত্র মোপলা বিদ্রোহ (অগস্ট ১৯২১), ও বোম্বাইতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (নভেম্বর ১৯২১) ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর। শাসনতান্ত্রিক নতুন আইন (১৯১৯) অনুযায়ী ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন কংগ্রেস বয়কট করে। আন্দোলনের অনুষঙ্গী হিসেবে মেদিনীপুরে ইউনিয়ন বোর্ড বর্জন এবং পঞ্জাবে অকালি বিক্ষোভ দেখা দেয়। ১৯২১ খ্রি নভেম্বরে প্রিন্স অব ওয়েলসের (পরে অষ্টম এডওয়ার্ড) ভারত ভ্রমণের সময়ে সর্বত্র তাঁর সভাসমাবেশকে বয়কট করা হয়। প্রিন্স বোম্বাইতে যেদিন পৌঁছান সেদিন হরতাল পালিত হয়। সেদিন এক জনসভার শেষে গান্ধী বিদেশি বস্ত্রের বহ্ন্যুৎসব করেন। পরে পুলিশের গুলি চলে, ৫৩ জন নিহত ও দাঙ্গায় ৪০০ ব্যক্তি আহত হন। আত্মশুদ্ধিকল্পে গান্ধী পাঁচ দিন অনশন করেন।
দেশব্যাপী জনবিক্ষোভে দিশেহারা বর্বর ব্রিটিশ সরকার খিলাফতি ও অসহযোগী স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনকে বেআইনি ঘোষণা করে। তাতে আন্দোলন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়, সেইসঙ্গে সরকারি দমন ব্যবস্থাও কঠোর হয়ে দাঁড়ায়। ৩০,০০০ নরনারী গ্রেপ্তার হন। অনেক নেতা কারারুদ্ধ হন। সংবাদপত্রের উপরও বিধিনিষেধ জারি হয়।
খিলাফত আন্দোলন
৮ জুলাই ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে করাচিতে নিখিল ভারত খিলাফত সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে কংগ্রেসের আসন্ন আহমদাবাদ অধিবেশেনের পূর্বে দাবিসমুহ সরকার মেনে না নিলে স্বাধীন ভারত প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হবে। ইতিপূর্বে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলাভঙ্গের সৃষ্টির প্রচেষ্টার দরুন আলি ভ্রাতৃদ্বয় ও অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন কারারুদ্ধ হওয়ায় হাকিম আজমল খাঁর সভাপতিত্বে কংগ্রেসের আহমদাবাদ অধিবেশন বসে। গান্ধী ওই অধিবেশনে অন্যান্য নেতাদের অনুপস্থিতিতে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিজের হাতে রাখার জন্য একটি প্রস্তাবে নিজেকে স্বৈরতন্ত্রী হিসেবে অনুমোদন করিয়ে নেন। এইভাবে গান্ধী যে ভারতের জনগণের শত্রু তা প্রমাণিত হয়।
হিন্দু এবং মুসলমান নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে অনৈক্য ছিল তা ১৯১৬ সনের লক্ষ্মো চুক্তিতে অনেকটা দূরীভূত হয়। মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে মুসলিম স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে একটা সমঝোতা হয়। এতদ্ব্যতীত যুদ্ধের ফলে জার্মানীর সহযোগী হিসাবে তুরস্কের পরাজয়ে তুরস্কের সুলতানের প্রতি ইংরেজদের আচরণে ভারতের মুসলমান সম্প্রদায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।[২]
তুরস্কের সুলতান তখনো মুসলিম সমাজের খলিফা বলে বিবেচিত হতেন। সেভারস এর চুক্তি অনুযায়ী (১৯২০) হেজাজ রাজ্যকে তুরস্কের অধীনতা মুক্ত করা হয় এবং আরমেনিয়া, থ্রেস, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়ার এবং প্যালেস্টাইনের উপর তুরস্কের কর্তৃত্ব বিলোপ করা হয়। তুরস্কের প্রতি মিত্রশক্তির এরূপ আচরণ ‘খিলাফত’কে ধ্বংস করার নামান্তর বলে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় মনে করে। তারা ‘খিলাফত’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ‘খিলাফত কমিটি’ গঠন করে। মৌলানা মোহাম্মদ আলী এবং মৌলানা শওকত আলী এই খিলাফত কমিটির নেতৃত্ব দেন। কংগ্রেস ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় খিলাফত কমিটিও এই আন্দোলনকে সমর্থন দান করে।[২]
অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারিতে গান্ধী ভাইসরয় লর্ড রেডিংকে একটি চরমপত্রে জানিয়ে দেয় যে এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারের মনোভঙ্গি পরিবর্তিত না হলে তিনি গুজরাতের বড়দৌলি তালুকে কর বন্ধ আন্দোলন শুরু করবেন। কিন্তু ৪ ফেব্রুয়ারি গোরখপুর জেলার চৌরিচেরায় তিন হাজার লোকের এক ক্রুদ্ধ জনতা পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে থানায় অগ্নিসংযোগ করে; তাতে ২১ জন পুলিশ ও ১ জন সাব-ইন্সপেক্টর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। আন্দোলনকারীরা স্বেচ্ছায় গ্রে্প্তার বরণের নীতি গ্রহণ করে। ইংরেজ সরকার ভারতবাসীদের শান্ত করার জন্য রাজকুমার অর্থাৎ প্রিন্স অব ওয়েলস-কে ভারত ভ্রমণে পাঠায়। কিন্তু তাঁর ভারত উপস্থিতির দিন (১৯২১ এর ১৭ নভেম্বর) দেশব্যাপী এক বিরাট প্রতিবাদ হরতাল পালন করা হয়। আন্দোলনের চরমে ৩০,০০০ আন্দোলনকারীকে কারাগারে আবদ্ধ করা হয়।
পুলিশের অগ্নিদগ্ধের এই হিংসাত্মক ঘটনায় গান্ধী বিচলিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত রাখেন। গান্ধী এই আন্দোলনকে পুরোপুরি অহিংস রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু আন্দোলন যত ব্যাপকতা ও তীব্রতা লাভ করতে থাকে তত তা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। ফলে গান্ধী আন্দোলন সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি আন্দোলনের রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করেন। তার নেতৃত্ব জনগণ অস্বীকার করতে শুরু করলে গান্ধী নেতৃত্ব কব্জায় রাখার জন্য ইংরেজ সরকারের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও শত্রুতা করে। শুধু ব্যক্তিগতভাবে ও সীমিত ক্ষেত্রে আইন অমান্যের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত থাকে। স্বাধীনতা ও জনগণের শত্রু মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ষড়যন্ত্রে ১৯২১ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ধ্বংস হয়ে যায়।
এদিকে তুরস্কে কেমাল আতাতুর্ক ক্ষমতাসীন হয়ে ১৯২৩ খ্রি ২৯ অক্টোবর দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে এবং তুরস্কে খলিফার ক্ষমতাসহ খিলাফতের অবসান ঘোষণা করেন। তখন থেকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন স্তিমিত হয়ে ১৯২৪ খ্রি পর্যন্ত বিভিন্ন প্রদেশে বিচ্ছিন্নভাবে চলার পর গান্ধীর ষড়যন্ত্রে স্থগিত রাখা হয়।
১৯৩০ সালে পুনরায় সমুদ্রতীরের ডান্ডিতে লবণ আইন অমান্য করে শয়তান ভণ্ড গান্ধী আবার অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। গান্ধী ছিলো প্রধানত ভারতের রক্ষণশীল সমাজ এবং প্রতিষ্ঠাকামী ধনিক শ্রেণীর প্রতিভূ। এ শ্রেণী শ্রমিক ও কৃষকের জঙ্গি চেতনা এবং সংগঠনকে ভয়ের চোখে দেখত। এই ভীতি থেকে জনতা অধিকতর সংগ্রামী হতে চাইলে গান্ধী নেহেরু প্যাটেলরা জনগণের শক্তিকে রাশ টেনে ধরতে চেয়েছে।[২]
দ্রষ্টব্য: আইন অমান্য আন্দোলন
চিত্রের ইতিহাস: জালিয়ানওয়ালাবাগ স্মৃতিসৌধ, ৯ আগস্ট, ২০১৬ নেপালি আলোকচিত্রী Bijay chaurasia-র (विजय चौरसिया) তোলা আলোকচিত্র। CC-BY-SA-4.0
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, ২৩ অক্টোবর ২০১৮, “অসহযোগ আন্দোলন ছিলো ভারতীয় জমিদারশ্রেণির ক্ষমতা কুক্ষিগত করার আন্দোলন” রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/history/non-cooperation-movement/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৯৫।
৩ গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ২৪-২৫।
৪. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক দ্বিজেন শর্মা; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা- ৫৪০-৫৪১।
৫. ভি আই লেনিন, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তৃতীয় কংগ্রেস, ১৩ জুন ১৯২১, ভ ই লেনিন নির্বাচিত রচনাবলী, ১২ খণ্ড, প্রগতি প্রকাশন মস্কো ১৯৮১, পৃষ্ঠা ৯।
রচনাকাল: ২২-২৩ অক্টোবর ২০১৮, নেত্রকোনা বাংলাদেশ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।