নেত্রকোনার ইতিহাসে কয়েকটি প্রসঙ্গ গ্রন্থের সম্পাদকের কথা

নেত্রকোনার ইতিহাসে কয়েকটি প্রসঙ্গ হচ্ছে এমন একটি বই যেখানে ইতিহাসের কিছু বিষয়কে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। এই বই লেখা হয়েছে এমন এক ব্যক্তির দ্বারা যিনি এসব ঘটনার বেশ কয়েকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন।  এছাড়াও এমন কিছু ঐতিহাসিক বিষয় তুলে ধরেছেন যেসব ঘটনার সংঘটনের ব্যক্তিদের সংগেও তার দেখা সাক্ষাত হয়েছে। এই যে ঘটনার ভেতরে ঢুকে গিয়ে ঘটনাকে জনগণের উদ্দেশ্যের সাথে মিলিয়ে নেয়া, তাতে সাহসের সংগে সদিচ্ছার মেলবন্ধন ঘটেছে। 

একসময় মনে করা হতো বীরেরা ইতিহাস তৈরি করে; পরে দেখা গেল ইতিহাস তৈরি করেন শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি জনগণ। এই জনগণ আবার তাদের নির্বাচিত পরিস্থিতিতে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো তৈরি করেন না। পুরনো অতীতে প্রাপ্ত মাল মশলা সরঞ্জামাদি, হাল হাতিয়ার নিয়ে তাদেরকে ভবিষ্যৎ ইতিহাস তৈরি করতে নেমে পড়তে হয়। এই মানুষের তৈরি ইতিহাসের আঞ্চলিক এক টুকরো নিয়ে বাদল মজুমদার তার বইয়ে বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। ছিয়াত্বর বছর বয়সে এসে এমন একটি কাজ করবার চেষ্টা আমাদের অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণাদায়ী আগ্রহের বিষয় নিশ্চয়।

বাদল মজুমদারের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাত হটাত করেই গত ১১ মার্চ ২০২৪ তারিখে নেত্রকোনার চারু প্রেসের কার্যালয়ে। তিনি তখন একটি বই প্রকাশের চেষ্টা করছেন। সেই চেষ্টাকে যত দ্রুত সম্ভব বাস্তব রূপ দেবার জন্য আমি কাজটিতে জড়িয়ে যাই এবং কয়েকদিন একটু একটু করে চেষ্টা করে কম্পোজ করা লেখাগুলোর একটা কাঠামো দাঁড় করাতে সক্ষম হই। বইটি পড়তে গিয়ে আমার অনুভূতি হয়েছে যে, তিনি দীর্ঘদিন নেত্রকোনার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে নিজ চোখে দেখেছেন। এছাড়াও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ তাঁকে এইসব ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করতে এবং এসব ঘটনার দালিলিক প্রমাণ সংরক্ষণ করতে উৎসাহিত করেছে। সবশেষে তিনি এসব ঘটনার দালিলিক প্রমাণগুলোকে আমাদের সামনে লিখে এবং বই আকারে প্রকাশ করে আমাদেরকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করলেন।    

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একবার আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, বাঙলার ইতিহাস নাই। তার কথাটি পুনরায় পড়ে দেখি; তিনি লিখেছিলেন:

বাঙ্গালার ইতিহাস নাই, যাহা আছে, তাহা ইতিহাস নয়, তাহা কতক উপন্যাস, কতক বাঙ্গালীর বিদেশী বিধর্ম্মী অসার পরপীড়কদিগের জীবনচরিত্রমাত্র। বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই। কে লিখিবে?

তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙ্গালী, তাহাকেই লিখিতে হইবে। মা যদি মারা যান, তবে মার গল্প করিতে কত আনন্দ। আর এই আমাদিগের সর্ব্বসাধারণের মা জন্মভূমি বাঙ্গালাদেশ, ইঁহার গল্প করিতে কি আমাদের আনন্দ নাই?

বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড – বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা

এই যে ইতিহাস লেখার তাগিদ উনিশ শতকের শুরুতেই তাড়িত করেছিল, তার ফলেই আজ এতোশত ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এসব গ্রন্থ আমাদেরকে যেমন অতীত দেখতে সহায়তা করে তেমনি, ভবিষ্যতের পাথেয় সঞ্চয় করতেও উৎসাহিত করে। নেত্রকোনার ইতিহাসে কয়েকটি প্রসঙ্গ বইটি লেখার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে স্বদেশী আন্দোলন ও বিপ্লবী যুগের বিপ্লবীদের অনন্যসাধারণ সব দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের সুলুকসন্ধান করতে গিয়ে। ধীরে ধীরে লেখক টঙ্ক ও তেভাগা আন্দোলন, সাম্যবাদী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির ভেতরে প্রবেশ করেছেন। এসব ঐতিহাসিক ঘটনার সংগে যেসব মানুষ তাদের জীবনের কিছু কথাও এই বইয়ে সংযোজিত হয়েছে। আর এসেছে নেত্রকোনার আদিবাসি জাতিসমূহের কথা। ব্যক্তি হিসেবে এসেছেন ললিত হাজং ও মণি সিংহ, এসেছেন কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ের কয়েকটি তালিকা যুক্ত করেছেন। এসব কাজ একজন ঐতিহাসিক বিচারে যেমন হোক, তার অসীম আগ্রহের ফলেই সম্ভব হয়েছে। 

আরো পড়ুন

মুক্তিকে আমরা দেখতে চাই, সকল রকমের জড়তা আর অন্ধতা থেকে মুক্তি, মজুরি দাসত্ব আর ভূমি দাসত্ব থেকে মুক্তি। এই যে ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন সশস্ত্র আন্দোলন থেকে মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মদান, তাঁদের এই আত্মদানকে শক্তিতে পরিণত করে ভবিষ্যতের মুক্তির পাথেয় সংগ্রহ করতে এই বইটি কাজে লাগবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। 

অনুপ সাদি
১৬ মার্চ ২০২৪,
কুরপাড়, নেত্রকোনা।

Leave a Comment

error: Content is protected !!