উপমহাদেশের সামন্তবাদী মুসলিম প্রাক-মুঘল সুলতানী মধ্যযুগের ইতিহাসের উৎস হিসেবে সাহিত্যিক উপাদান (ইংরেজি: Literary sources of Feudal sultanate of Indian history) হচ্ছে ইতিহাস রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস ছাড়াও আমাদের কাছে মধ্যযুগের সামন্তবাদী ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য এই উৎসটি প্রচুর ব্যবহৃত। বিভিন্ন সময়ে বিদেশীরা ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিবরণ লিখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ এ দেশে এসে তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে এবং কেউ এদেশে না এসেও লোকমুখে শুনে ভারতবর্ষ সম্পর্কে তাদের বিবরণ লিখেছিলেন।
এছাড়াও ভারত বিজয়ী তুর্কি মুসলমানরা ইতিহাস রচনার দক্ষতা নিয়ে এদেশে আসে। ফলে দিল্লিতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সময় থেকে শুরু করে সুলতানি আমলে ও পরবর্তীকালে রচিত বহু ইতিহাস গ্রন্থ দেখা যায়। প্রফেসর ডডওয়েল বলেন, মুসলমান আমল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতে ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস লেখা শুরু হয়, ফলে মুসলমান আমলের যেমন জীবন্ত চিত্র পাওয়া যায়, হিন্দু আমল তেমনই ছায়াছন্ন।
দিল্লির সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং অনেক সময় তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই সুলতানি আমলে অনেক ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এগুলোর সাহায্যে দিল্লির সুলতানদের ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা তেমন কষ্টসাধ্য নয়। মুঘল আমলে সম্রাটগণ নিজ নিজ সময়ের বা পূর্ববর্তীকালের ইতিহাস রচনা করার জন্য ঐতিহাসিক নিযুক্ত করতেন। মুঘল যুগে রচিত বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ থেকেও সুলতানি আমলের ভারতবর্ষের ইতিহাস জানা যায়। সুলতানি আমলের ভারতবর্ষের ইতিহাস পুনর্গঠনের উৎসগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:
(ক) সাহিত্যিক উপাদান,
(খ) বিদেশীদের বিবরণ এবং
(গ) সমসাময়িক শিলালিপি ও মুদ্রা।
সুলতানী আমলের ইতিহাসের উৎস হিসেবে সাহিত্যিক উপাদান
সুলতানী আমলের ইতিহাসের উৎস হিসেবে সাহিত্যিক উপাদান হচ্ছে বিভিন্ন ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থ, সুফিদের জীবন-চরিত ও সুফিদের লেখা চিঠি-পত্র এবং তাঁদের আলোচনার বিবরণ। যে সব ঐতিহাসিকদের রচনা থেকে সুলতানি আমলে ভারতবর্ষের ইতিহাস জানা যায় তাঁদের সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।
হাসান নিজামি: মুসলমানদের দিল্লি জয়ের অব্যহিত পরেই তিনি এদেশে আসেন। তিনি ছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবকের সমসাময়িক। ১১৯২-১২২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত প্রধান সামরিক ঘটনাবলি তাঁর গ্রন্থ তাজুল মাসির-এ স্থান পেয়েছে। আইবকের রাজত্বকালের প্রথম দিকে তিনি তাঁর গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। প্রধানত কুতুবউদ্দিন আইবককে নিয়ে রচিত হলেও তাজুল মাসির-এ মুহাম্মদ ঘোরী এবং ইলতুৎমিশেরও বিবরণ রয়েছে।
মিনহাজ-উস-সিরাজ: তিনি ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে তার তাবাকাৎ-ই-নাসিরি রচনা করেন। এটা মুসলমান বিশ্বের ইতিহাস হলেও মুসলমানদের ভারত জয় এবং প্রাথমিক সুলতানি আমলের ইতিহাস রচনার জন্য একটি অত্যন্ত মূল্যবান উৎস। তাঁর গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলির তিনি শুধু সমসাময়িকই ছিলেন না, কিছু কিছু ঘটনায় তিনি অংশও নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ধর্ম ও বিচার বিভাগীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি তাঁর গ্রন্থ সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং এ কারণেই তাঁর গ্রন্থের এ নাম।
আমীর খসরু: সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের রাজত্বকালে তিনি ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে উত্তর প্রদেশের পাতিয়ালিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাইফউদ্দিন মাহমুদ ছিলেন সুলতান ইলতুৎমিশের চাকুরিতে নিয়োজিত একজন প্রবীন যোদ্ধা। আমীর খসরু পর্যায়ক্রমে ছয়জন সুলতানের রাজত্বকালের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তারা হচ্ছেন বলবন, কায়কোবাদ, জালালউদ্দিন খলজী, আলাউদ্দিন খলজী, কুতুবউদ্দিন মোবারক শাহ খলজী এবং গিয়াসউদ্দিন তুঘলক। বাল্যকালেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। মূলত কবি হলেও আমীর খসরু মাঝে মাঝে তাঁর রচনার বিষয়বস্তু হিসাবে ঐতিহাসিক ঘটনাকে বেছে নিয়েছেন। ছয়জন সুলতানের সাহচর্য এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি ও নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সঙ্গে মেলামেশার ফলে রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য আহরণের অনন্য সুযোগ তাঁর ছিল। কাজেই ইতিহাস রচনায় কখনো মনোনিবেশ না করলেও তাঁর রচনাবলী, বিশেষত তার ঐতিহাসিক মসনভী ও দিওয়ানগুলো সমকালীন ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্ট আলোকপাত করে। আমীর খসরুর রচনাবলীর একটা বিশেষ প্রশংসনীয় দিক হচ্ছে- নির্ভরযোগ্য তারিখের প্রাচুর্য এবং সময়ানুক্রমের ব্যাপারেও তিনি জিয়াউদ্দিন বারাণীর চেয়ে অধিকতর নির্ভরযোগ্য। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো ইতিহাসের উৎস হিসেবে বিশেষ উল্লেখযোগ্যঃ
(ক) কিরান-উস-সাদাইন: বাংলার শাসনকর্তা বুঘরা খান ও তাঁর পুত্র দিল্লির সুলতান কায়কোবাদের সাক্ষাতের ঘটনা নিয়ে এ কাব্য রচিত। সরজু নদী-তীরে এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন আমীর খসরু। এটি রচিত হয়েছিল ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে। এটা দিল্লির সামাজিক জীবনের ওপরেও আলোকপাত করে। এ গ্রন্থে আমীরদের সামাজিক মেলামেশা ও কর্মকান্ড, জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র, বিভিন্ন ধরনের নৌকা এবং উপাদেয় খাদ্যের বর্ণনা রয়েছে।
(খ) সিফতাহুল ফুতুহ: এ গ্রন্থ জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজীর সামরিক অভিযান, মালিক সাজুর বিদ্রোহ দমন, সুলতানের রণথম্ভোরের দিকে অগ্রসর হওয়া এবং ব্যর্থ মোঙ্গল আক্রমণের বিবরণ রয়েছে।
(গ) খাজাইন-উল-ফুতুহ: এ গ্রন্থ গদ্যে লেখা এবং এতে আলাউদ্দিন খলজীর দাক্ষিণাত্যে সাফল্যসমূহের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আলাউদ্দিন খলজীর রাজত্বকাল সম্পর্কে এটাই একমাত্র সমসাময়িককালে লিখিত ইতিহাস। কারণ, বারাণীও তাঁর তারিখ-ই-ফিরোজশাহী লিখেছিলেন আলাউদ্দিন খলজীর মৃত্যুর বহু পরে। বাদাউনীর ভাষ্য অনুসারে আমীর খসরু দাক্ষিণাত্য অভিযানকালে মালিক কাফুরের সঙ্গে গিয়েছিলেন।
(ঘ) আশিকা: আশিকা রচিত হয়েছিল ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দে। এতে যুবরাজ খিজির খানের সঙ্গে গুজরাটের রাজা করণের কন্যা দেবল দেবীর প্রণয় ও বিয়ের বিবরণ আছে। তাছাড়া এতে কবির মোঙ্গলদের হাতে বন্দী হওয়া এবং আলাউদ্দিন খলজীর গুজরাট, চিতোর ও মালওয়া বিজয়ের ঘটনাবলির বর্ণনা রয়েছে।
(ঙ) নুহ সিপার: এটি রচিত হয়েছিল ১৩১৮ খ্রিস্টাব্দে। মোবারক শাহ খলজীর সামরিক অভিযানগুলো ছাড়াও এ গ্রন্থে দিল্লির চমৎকারিত্ব, দেশের মনোরম আবহাওয়া, ঋতু, ফল, দর্শন, আচার-আচরণ, ভাষা ইত্যাদির বিবরণ রয়েছে।
(চ) তুঘকলনামা: জীবনের শেষ প্রাড়ে ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে আমীর খসরু রচনা করেন তুঘলকনামা। এ গ্রন্থে তিনি গাজি মালিকের সঙ্গে নাসিরউদ্দিন খসরুর যুদ্ধের এবং গাজি মালিকের সিংহাসনারোহণের বর্ণনা দিয়েছেন।
জিয়াউদ্দিন বারাণী: সুলতানি আমলের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ছিলেন বারাণী। তাঁর তারিখ-ই-ফিরোজশাহী রচিত হয়েছিল ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে। বারাণী তাঁর গ্রন্থে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে শুরু করে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বের প্রথম ছয় বছর পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর পিতা মুঈন-উল-মুলক আলাউদ্দিন খলজীর রাজত্বকালে বারাণের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর পিতৃব্য আলাউল মুলক এবং মাতামহ হিসামউদ্দিন দুজনই ছিলেন দিল্লির সুলতানদের অধীনে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত। বারাণী নিজেও ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন সুলতানের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ট অনুচর (নাদিম) এবং তিনি প্রায়ই দরবারে উপস্থিত থাকতেন। বহুসংখ্যক প্রভাবশালী আমীরের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল এবং দরবারে তাঁর অবাধ প্রবেশাধিকারও ছিল। কাজেই তাঁর তথ্যের উৎস ছিল বহু ধরনের এবং নির্ভরযোগ্য। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁর দুর্দিন শুরু হয় এবং তিনি পাঁচ মাস দিল্লির শহরতলীতে স্বেচ্ছানির্বাসনে বাস করেন। দিল্লিতে ফিরে এসে তিনি তাঁর হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধারের আশায় তারিখ-ই-ফিরোজশাহী এবং ফতোয়া-ই-জাহানদারী রচনার কাজে মনোনিবেশ করেন। বারাণী তার ইতিহাসে শুধু সুলতান, দরবার ও অভিযান সম্পর্কেই বিবরণ দেননি, শাসকদের সংস্কারমূলক কার্যাবলী, বাজারের দ্রব্যমূল্য, রাজস্ব-বিধিমালা, সরকারি কর্মচারী, কবি, ঐতিহাসিক, চিকিৎসক ইত্যাদিও তার রচনায় স্থান পেয়েছে। তার গ্রন্থ সম্পর্কে তিনি বলেছেন যে গত এক হাজার বছরেও তারিখ-ই-ফিরোজশাহীর মত কোনো গ্রন্থ রচিত হয়নি। নিজামউদ্দিন আহমদ বখশি, বাদাউনী, ফিরিশতা- বস্তুত ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের প্রায় সব ঐতিহাসিকই বারাণীর ওপর নির্ভর করেই সুলতানি আমলের ইতিহাস রচনা করেছেন। তারিখ-ই-ফিরোজশাহীতে বলবন, কায়কোবাদ, জালালউদ্দিন খলজী, আলাউদ্দিন খলজী, কুতুবউদ্দিন মোবারক শাহ খলজী, নাসিরউদ্দিন খসরু খান, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক, মুহাম্মদ বিন তুঘলক এবং ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বকালের বিবরণ রয়েছে। উল্লেখ্য যে বারাণী তাঁর বইটি শেষোক্ত সুলতানকে উৎসর্গ করেছিলেন।
ঐতিহাসিক হিসাবে বারাণীর কিছু ত্রুটিও লক্ষ করা যায়। তিনি ঘটনার সময়ানুক্রম অনুসরণ করেন নি। তাঁর ইতিহাসে তারিখও খুব বেশি উল্লেখ করা হয়নি। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ২৫ বছরের দীর্ঘ রাজত্বকালের মাত্র ৪টি তারিখ তিনি উল্লেখ করেছেন যেমন তার সিংহাসনারোহণ, গুজরাট অভিযান, খলিফার সনদ লাভ এবং তাঁর মৃত্যু। তাছাড়া বারাণীকে নিরপেক্ষও বলা যায় না- দুর্দিনে সুলতানের কৃপা দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিজের ভাগ্যোন্নয়ন ছিল তাঁর এ গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য। কাজেই অতিরঞ্জন ও সত্য-গোপন দুটোরই দৃষ্টান্ত তাঁর গ্রন্থে রয়েছে। এসব সত্তেও সুলতানি আমলের ইতিহাসের উৎস হিসাবে বারাণীর তারিখ-ই-ফিরোজশাহী যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সে কথা আধুনিক প্রায় সব ঐতিহাসিকই স্বীকার করেন।
তারিখ-ই-ফিরোজশাহী ছাড়া বারাণীর ফতোয়া-ই-জাহানদারী গ্রন্থটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এটি রচিত হয়েছিল ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে। সুলতানের জন্য এতে রাষ্ট্রপরিচালনা বিষয়ক বেশ কিছু উপদেশ-নির্দেশ রয়েছে।
তাবাকাৎ-ই-নাসিরির পান্ডুলিপির মধ্যে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের আত্মজীবনী বলে বিবেচিত ৪টি পৃষ্ঠা পাওয়া গেছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ হাবিব ও আগা মাহদী হুসেন এটিকে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের আত্মজীবনীর খন্ডিতাংশ বলেই মনে করেন।এতে গিয়াসউদ্দিন বলবন থেকে খসরু খান পর্যন্ত দিল্লির সিংহাসন জবরদখলকারীদের বিবরণ রয়েছে। এতে গিয়াসউদ্দিন বলবন, জালালউদ্দিন খলজী এবং আলাউদ্দিন খলজীর তীব্র সমালোচনা করা হলেও গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে। আগা মাহদী হুসেন এ খন্ডিত আত্মজীবনীকে তার চরিত্র ও মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেন। কিন্তু অনেক আধুনিক ঐতিহাসিকই এ পৃষ্ঠা কয়টির প্রামাণিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
শামস-ই-সিরাজ আফিফ: তাঁর গ্রন্থের নাম তারিখ-ই-ফিরোজশাহী; শুধুমাত্র ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বকাল এ গ্রন্থের বিষয়বস্তু। তৈমুরের ভারত আক্রমণের কয়েক বছর পর দিল্লিতে এ গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এটি সহজ-প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত।
সিরাত-ই-ফিরোজশাহী: এ গ্রন্থের লেখকের নাম জানা যায় না। ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বকালে এবং সম্ভবত তাঁরই নির্দেশে রচিত এ গ্রন্থে তাঁর রাজত্বকালের প্রথম অংশের নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায়।
ফুতুহাত-ই-ফিরোজশাহী: ফিরোজ শাহ তুঘলক নিজেই এটা রচনা করেছিলেন। এ গ্রন্থের গুরুত্ব হচ্ছে এই যে এটা থেকে আমরা সুলতানের মানসিকতা ও ধর্মীয় মনোভাব সম্পর্কে জানতে পারি।
ইসামী: তাঁর সম্পূর্ণ নাম হচ্ছে খাজা আব্দুল মালিক ইসামী। কাব্যাকারে রচিত তাঁর গ্রন্থের নাম ফুতুহুস সালাতীন। ইসামী ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর এই গ্রন্থ রচনা শেষ করেন। ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের আদেশে তিনি তাঁর ৯০ বছর বয়সী পিতামহের সঙ্গে দৌলতাবাদে যেতে বাধ্য হন। তাঁর পিতামহ অবশ্য দৌলতাবাদ পৌঁছাতে পারেন নি, পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। ফুতুহুস সালাতীনে গজনীতে সুলতান মাহমুদের উত্থানের সময় থেকে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের ঘটনাবলির বিবরণ পাওয়া যায়। ইসামী তথ্যের উৎস উল্লেখ না করলেও তার বিবরণ থেকে এটা নিশ্চিতভাবে প্রতীয়মান যে তিনি নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক কিছু উৎসের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। আলাউদ্দিন খলজীর রাজত্বকালের ইতিহাস বর্ণনায় তিনি সেই সুলতানের রাজত্বকালের সমসাময়িক কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন বলে মনে হয়। একাধিক স্থানে তিনি বলেছেন যে বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছে পাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করেই তিনি তাঁর গ্রন্থ রচনা করেছেন। দৌলতাবাদেই তিনি বসবাস করতে থাকেন এবং বাহমনী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হাসান বাহমন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর গ্রন্থ রচনা করেন। তুঘলক আমলের তিনিই একমাত্র ঐতিহাসিক, যিনি ছিলেন সে বংশের সুলতানদের অনুগ্রহ ভীতির উর্ধে। তবে তিনি পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন না একথা বলা যায় না। রাজধানী স্থানান্তরের ফলে তিনি কষ্টভোগ করেছিলেন, তার ফলে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের প্রতি তিনি ছিলেন শত্রুভাবাপন্ন এবং সুলতানের তিনি তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি আলাউদ্দিন খলজীর সঙ্গে মুহাম্মদ বিন তুঘলককে তুলনা করেছেন। তিনি আলাউদ্দিন খলজীর উচ্চ প্রশংসা করেছেন, কিন্তু মুহাম্মদ বিন তুঘলকের অবমূল্যায়ন করেছেন। ইসামীর বিবরণ অনুযায়ী মুহাম্মদ বিন তুঘলক জনগণকে সুষ্ঠু ও সহানুভূতিশীল প্রশাসন উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে প্রচুর অর্থ বিতরণ করে তাদের হৃদয় জয় করেছিলেন, কিন্তু সুলতান হওয়ার পর তাঁর চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি সন্দিগ্ধ ও অত্যাচারী হয়ে ওঠেন। সমসাময়িক হওয়া সত্ত্বেও ইসামী ও বারাণীর মধ্যে মনে হয় কখনও যোগাযোগ ঘটেনি। মনে হয় একজন অপর জন সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। নিজামউদ্দিন আহমদ বখশি, বাদাউনী, ফিরিশতা- বস্তুত ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের প্রায় সব বিখ্যাত ঐতিহাসিকই সুলতানি আমলের ইতিহাস রচনায় বারাণীর তারিখ-ই-ফিরোজশাহী ও ইসামীর ফুতুহুস সালাতীনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।
ইয়াহিয়া বিন আহমদ সিরহিন্দী: সৈয়দ আমলের একমাত্র সমসাময়িক ইতিহাস গ্রন্থ হচ্ছে ইয়াহিয়া বিন আহমদ সিরহিন্দী রচিত তারিখ-ই-মোবারকশাহী। সৈয়দ বংশের দ্বিতীয় সুলতান মোবারক শাহের (১৪২১-১৪৩৪ খ্রি:) রাজত্বকালে এ গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। সৈয়দ বংশের প্রথম দুজন সুলতানের রাজত্বকালের কুড়ি বছরের (১৪১৪-১৪৩৪) বিবরণ এ গ্রন্থে পাওয়া যায়। মোবারক শাহের দরবারে তাঁর প্রবেশাধিকার ও সরকারি মহলে সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে বিভিন্ন ঘটনাবলি জানার সুযোগ ছিল তার। নিজামউদ্দিন আহমদ বখশি, বাদাউনী এবং ফিরিশতাসহ পরবর্তী প্রায় সকল ঐতিহাসিকই এ গ্রন্থকে সুলতানী আমলের ইতিহাসের প্রামাণ্য উৎস হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
সুলতানী আমলের ইতিহাসের উৎস হিসেবে আফগান শাসনের প্রথম পর্যায়ে লোদি বংশের শাসনামলে তেমন বিখ্যাত কোনো ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়নি। লোদি আমলের ইতিহাস জানার জন্য আমাদের সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত তিনটি গ্রন্থের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর সবগুলোই বাহুলুল লোদির রাজত্বকাল থেকে শুরু। আহমদ ইয়াদগার ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে লিখেছিলেন তারিখ-ই-শাহী বা তারিখ-ই-সালাতীন-ই-আফগানা। হিমুর মৃত্যু পর্যন্ত সময়কালের বিবরণ এ গ্রন্থে পাওয়া যায়। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে লেখা নিয়ামত উল্লাহর মাখজান-ই-আফগানী ইব্রাহিম লোদির রাজত্বকালের বিবরণ দিয়ে শেষ করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে আবদুল্লাহ লিখেছিলেন তারিখ-ই-দাউদী। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে দাউদের মৃত্যু পর্যন্ত সময়কালের বিবরণ এ গ্রন্থে আছে।
সমসাময়িককালে রচিত ইতিহাস গ্রন্থগুলো হচ্ছে আমাদের তথ্যের প্রধান উৎস এবং বহুদিক থেকেই অত্যন্ত মূল্যবান। কিন্তু এগুলোর কিছু ত্রুটিও দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে দরবারী ইতিহাস। প্রচুর তথ্য, সামরিক অভিযানের মোটামুটি সঠিক তারিখ ও বিবরণ এবং অন্যান্য ঘটনার বিবরণ এগুলোতে রয়েছে। কিন্তু রচয়িতারা যে সব সময়ই নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছেন একথা বলা যায় না। তাছাড়া এ সব ঐতিহাসিক শুধুমাত্র সুলতান ও তাঁর কার্যাবলীর দিকেই তাঁদের মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁরা দরবার, রাজধানী, শাসক ও অভিজাত শ্রেণির বাইরে তাঁদের দৃষ্টি প্রসারিত করেন নি। সাধারণ মানুষের জীবন-চর্যা, সামাজিক রীতি-নীতি, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি তাঁদের বিবরণে খুব কমই উল্লেখিত হয়েছে।
পরবর্তীকালে লিখিত চারটি ইতিহাস গ্রন্থ থেকেও সুলতানী আমলের ইতিহাসের উৎস হিসেবে ভারতবর্ষ সম্পর্কে জানা যায়। এগুলো হচ্ছে আবুল ফজলের আকবরনামা, নিজামউদ্দিন আহমদ বখশির তাবাকাত-ই-আকবরী, আবদুল কাদের বাদাউনীর মুন্তাখাব-উৎ-তাওয়ারিখ এবং আবুল কাসিম ফিরিশতার তারিখ-ই-ফিরিশতা। প্রথমোক্ত তিনটি গ্রন্থ আকবরের আমলে এবং দিল্লিতে রচিত। শেষোক্ত গ্রন্থটি বিজাপুরের সুলতান ইব্রাহিম আদিল শাহের সময়ে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়। ফিরিশতা দাক্ষিণাত্যে বসে তাঁর গ্রন্থ লিখলেও উপাদান সংগ্রহের জন্য তিনি প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। দাক্ষিণাত্যে বসে লেখার ফলে ও উৎসের প্রাচুর্যের কারণে ফিরিশতা আলাউদ্দিন খলজীর দাক্ষিণাত্য অভিযান সম্পর্কে বারাণী বা ইসামীর চেয়েও অধিকতর বিস্তারিত বিবরণ দিতে পেরেছেন। ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে রচিত তাবকাৎ-ই-আকবরীতে মূলত: বারাণীর ওপর নির্ভর করেই সুলতানি আমলের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে লেখা মুন্তাখাব-উৎ-তাওয়ারিখ বারাণী ও ইয়াহিয়া- দুজনের ওপরই নির্ভর করে লেখা।
শুধুমাত্র মুসলিম উৎসের ওপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনা করলে সেটা সুষম ও গ্রহণীয় নাও হতে পারে। অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ যেমন বলেছেন যে, বিজিত জনগণের মন-মানস তাদের লেখার মাধ্যমেই প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সুলতানি আমলে রচিত ঐতিহাসিক প্রকৃতির খুব বেশি গ্রন্থ আমরা পাই না। চাঁদবদই রচিত পৃথ্বিরাজচরিত প্রাথমিক হিন্দী কবিতার উত্তম দৃষ্টান্ত হলেও ইতিহাসের উৎস হিসাবে কোনো কাজে আসে না। অজ্ঞাতনামা লেখকের রচিত ও অসম্পূর্ণ পৃথ্বিরাজ-বিজয় লেখা হয়েছিল পৃথ্বিরাজের রাজত্বকালে। এটাতে কিছু কিছু ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়। পৃথ্বিরাজের বংশধর এবং রণথম্ভোরের চৌহান রাজা হামিরের কৃতিত্ব বর্ণনাকারী হামির-মহাকাব্য ইতিহাস রচনায় যথেষ্ট সাহায্য করে। এটার রচয়িতা ছিলেন নয়চন্দ্র।
সুফিদের জীবন-চরিত, তাঁদের লেখা চিঠিপত্র এবং শিষ্যদের সঙ্গে তাঁদের আলোচনার বিবরণও সুলতানি আমলের ইতিহাস রচনায় আমাদের সাহায্য করে। সুফিদের জীবন-চরিতগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মীর খুর্দ লিখেছিলেন সিয়ার-উল-আউলিয়া। চিশতী তরিকার ভারতীয় সুফিদের বিবরণ রয়েছে এতে। এতে প্রধানত শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার জীবন বিবরণ দেওয়া হয়েছে এবং এ গ্রন্থে মুহাম্মদ বিন তুঘলকেরও উল্লেখ আছে। শেখ আবদুল হক দেহলভীর আখবার-উল-আখিয়ার এবং আবদুর রহমান চিশতীর মিরাত-উল-আসরার গ্রন্থ দুটিতে বেশ কয়েকজন সুফির জীবনী আলোচনা করা হয়েছে।
সুফিরা প্রায়ই তাদের শিষ্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন। এসব আলোচনা সভায় আধ্যাত্মিক তত্ত্ব আলোচিত হতো এবং সুফিরা মাঝে মাঝে শিষ্যদের উপদেশ দিতেন। সুফিদের আলোচনা মলফুজ হিসাবে পরিচিত। এসব আলোচনা সভায় সুফিরা মাঝে মাঝে দৃষ্টান্ত দেখাতে গিয়ে পূর্ববর্তী সুফি এবং সুলতানদের কথা উল্লেখ করতেন। সুফিদের শিষ্যরা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি থেকে আসায় সমসাময়িক কালের খাদ্য, পানীয়, আচার-অনুষ্ঠান, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে এ সব আলোচনা থেকে মূল্যবান সুলতানী আমলের ইতিহাসের উৎস আহরণ করা যায়।
বিখ্যাত সুফিদের মলফুজ বা আলোচনার মর্ম তাদের শিষ্যরা বই-এর আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। কবি আমীর হাসান সজ্জি শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দৈনিক আলোচনা ‘ফওয়ায়েদ-উল-ফওয়াদ’ নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন। সুফির চারপাশের মানুষ ও ঘটনাবলি সম্পর্কে এতে কৌতূহলোদ্দীপক সব মন্তব্য রয়েছে। এটি এ জাতীয় অন্যান্য গ্রন্থের আদর্শরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এ জাতীয় অন্যান্য মূল্যবান গ্রন্থগুলো হচ্ছে শেখ কলন্দর রচিত নাসিরউদ্দিন চেরাগ-ই দিল্লির আলোচনাসমূহ সম্বলিত ‘খায়ের-উল-মজলিস’, আমীর খসরু রচিত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার আলোচনাসমূহ সম্বলিত ‘আফজল-উল-ফওয়ায়েদ’ এবং ‘রাহাত-উল-মুহিব্বীন’ এবং শেখ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার খলজীর আলোচনাসমূহ সম্বলিত ‘ফওয়ায়েদ-উলসালেকীন’।
বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন উপলক্ষ্যে সুফিদের লিখিত চিঠিপত্রেও ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। সুলতানী আমলের ইতিহাসের উৎস হিসেবে এসব চিঠিতে সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। এসব চিঠিতে প্রধানত সুফিতত্ত্ব আলোচিত হলেও মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বিষয়াবলী-সুলতানদের কর্তব্য ইত্যাদিরও আলোচনা থাকে।
তথ্যসূত্র
১. ড. আবদুল মোমিন চৌধুরী, মোকাদ্দেসুর রহমান ও আকসাদুল আলম, উপমহাদেশ ও বাংলার ইতিহাস, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, পুনর্মুদ্রণ ২০১৪, পৃষ্ঠা ১৮-২২।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।