সামন্তবাদী ভারতের ইতিহাসের লেখমালা বা সাহিত্যিক উৎস প্রসঙ্গে

সামন্তবাদী ভারতের ইতিহাসের লেখমালা বা সাহিত্যিক উৎস (ইংরেজি: Literary source of the history of India) হচ্ছে ইতিহাস রচবনার একটি প্রধান উৎস। স্থায়ী কোনো বস্তু যেমন পাথর, ধাতবখণ্ড, পােড়ামাটি, কাষ্ঠখণ্ড ইত্যাদির উপর বিশেষ প্রক্রিয়ায় লিখন-পদ্ধতিকে লেখমালা বা লিখিত উৎস বলা যেতে পারে। এসব লিখিত উৎসের মধ্যে সাহিত্যিক উৎসসমূহ প্রধান। প্রাচীন ভারতে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ও বিভিন্ন বিষয়ে লেখা বহু গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেলেও ইতিহাস সম্পর্কে লেখা কোনো গ্রন্থ পাওয়া যায় না।

প্রাচীনকালে ভারতীয় পন্ডিতগণ কেন ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেননি সে সম্পর্কে আধুনিক গবেষক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। স্মিথ বলেছেন যে প্রাচীনকালে ভারতীয় পন্ডিতগণ ইতিহাস – গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, কিন্তু কীট-পতঙ্গের আক্রমণে এবং ভূমিকম্প ও বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। কীথের মতে খ্রিস্টের জন্মের আগে ভারতে বড় ধরনের কোনো বৈদেশিক আক্রমণ না হওয়ায়, ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ না ঘটায় ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়নি। কীথ আরো বলেছেন যে ভারতবাসীরা পরলোক ও অদৃষ্টের ওপর অধিকতর বিশ্বাসী হওয়ায় ইতিহাস রচনার মত ইহলৌকিক বিষয়ে উৎসাহ বোধ করেনি।

কিন্তু সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় এবং স্থাপত্য-ভাস্কর্য সৃষ্টিতে পরলোক-চিন্তা বাধা না হলে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এটা বাধা হবে কেন? আল-বেরুনী বলেছেন যে হিন্দুরা বিভিন্ন ঘটনার ঐতিহাসিক পরম্পরার প্রতি মনোযোগী ছিলেন না। প্রাচীনকালে হিন্দুদের প্রকৃত ইতিহাসবোধ আদৌ ছিল কিনা সে সম্পর্কে কোনো কোনো ঐতিহাসিক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে সে সময়ে ইতিহাস-চেতনা বা ইতিহাসের উপাদান-কোনোটিরই অভাব ছিল না। অভাব ছিল বিভিন্ন তথ্যের সাহায্যে প্রকৃত সাহিত্যগুণ সম্পন্ন ইতিহাস রচনার ইচ্ছার এবং উৎসাহের।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের জন্য আমরা সাহিত্যিক উৎস হিসেবে সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় উপাদান খুঁজে পাই। ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্য হলো বেদ যা চার ভাগে বিভক্ত। ঋগ্বেদ রচিত হয়েছিল ১৫০০-৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। অন্য তিনটি বেদ- সাম, যজু এবং অথর্ব বেদ ৯০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। বেদগুলো থেকে আর্য জাতির ভারত-আগমন এবং তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে জানা যায়।

ভারতের ইতিহাসের লেখমালা বা সাহিত্যিক উৎস

পুরাণ এক ধরনের ইতিহাস সাহিত্য যাতে বিভিন্ন রাজবংশের উল্লেখ রয়েছে। ভারতের দুই প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতে বহু ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায়। রামায়ণ রচিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর আগে, আর মহাভারতের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে। পুরাণ এবং মহাকাব্য দুটিতে প্রাচীনকালের রাজাদের দীর্ঘ তালিকা আছে। বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান পাওয়া যায়। সাহিত্যের অন্যান্য শাখা, যেমন নাটক, কাব্য, এমনকি ব্যাকরণ বই থেকেও মাঝে মাঝে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলো উল্লেখযোগ্য:

  • দীপবংশ — খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে রচিত কাব্যে শ্রীলংকার ইতিহাস, এর লেখকের নাম জানা যায় না।
  • মহাবংশ — মহানাম রচিত একই সময়কালের শ্রীলংকার ইতিহাস। 
  • পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী — খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের পূর্বে রচিত একটি ব্যাকরণ বই। 
  • পতঞ্জলির মহাভাষ্য — এটা পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীর টীকা, রচিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে। 
  • অর্থশাস্ত্র — রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত এ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য। 
  • রঘুবংশ — কালিদাস রচিত এ কাব্যে সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য বিজয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কালিদাসের মালবিকাগ্নিমিত্রম এর নায়ক অগ্নিমিত্র ছিলেন শুঙ্গ বংশের প্রতিষ্ঠাতা পুষ্যমিত্র শুঙ্গের পুত্র।
  • মুদ্রারাক্ষস — গুপ্তযুগে বিশাখদত্ত রচিত এ নাটকে রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কিত কিছু তথ্য পাওয়া যায়। 
  • নীতিসার — গুপ্ত আমলে কামন্দক রচিত এ গ্রন্থের বিষয়বস্তু কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের অনুরূপ। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উৎস হিসাবে বিভিন্ন সময়ে রচিত রাজাদের জীবন-চরিতগুলোর উল্লেখ করা যেতে পারে। 
  • হর্ষচরিত — হর্ষবর্ধনের জীবনী অবলম্বনে হর্ষচরিত লিখেছিলেন বাণভট্ট। এটা সংস্কৃত ভাষায় গদ্যে লিখিত। 
  • গৌড়বাহ — খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দীতে বাকপতি এটা প্রাকৃত ভাষায় রচনা করেন। এটা কনৌজের রাজা যশোবর্মণ কর্তৃক গৌড়ের এক রাজাকে পরাজিত করার কাহিনী। 
  • বিক্রমাঙ্কদেব চরিত — এর লেখকের নাম বিহন। ১০৮১-৮৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত এ গ্রন্থে চালুক্য বংশীয় রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের কীর্তিসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। 
  • রামচরিত — দ্ব্যর্থবোধক এ কাব্যের রচয়িতা সন্ধ্যাকর নন্দী। এক ভাবে অর্থ করলে এটা রামায়ণের কাহিনী, কিন্তু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলে এতে বাংলার পালবংশীয় রাজা রামপালের রাজত্বকালের কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। 

এ সব জীবন-চরিত থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ইতিহাস রচনা করা যায়, তবে এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। রচয়িতাগণ ছিলেন সভাকবি এবং রাজার অনুগ্রহপুষ্ট। ফলে রাজাদের প্রতি দুর্বলতা থাকা এবং তাদের অহেতুক গুণকীর্তন করা ছিল কবিদের পক্ষে স্বাভাবিক। প্রাচীন ভারতে রচিত একটি মাত্র গ্রন্থকে আধুনিক বিচারে বিজ্ঞান সম্মত ইতিহাস বলা যায়। বইটির নাম রাজতরঙ্গিনী, এর লেখকের নাম কহণ। তিনি ছিলেন কাশ্মিরের অধিবাসী এক ব্রাহ্মণ পন্ডিত। রাজতরঙ্গিনী কাশ্মিরের ইতিবৃত্ত। ১১৪৯-৫০ খ্রিস্টাব্দে এটা লেখা হয়েছিল। বইটি সংস্কৃত ভাষায় এবং পদ্যে লেখা।

তথ্যসূত্র

১. ড আবদুল মোমিন চৌধুরী, মোকাদ্দেসুর রহমান ও আকসাদুল আলম, উপমহাদেশ ও বাংলার ইতিহাস, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, পুনর্মুদ্রণ ২০১৪, পৃষ্ঠা ৯-১০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!