দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদানের বা ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যাবলীর প্রভাব (ইংরেজি: Influence of Geographical factors on Indian History) বলতে বোঝানো হয় ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য যেসব ক্ষেত্রে ইতিহাসে প্রভাব বিস্তার করে। ভারতের উত্তরে অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালা এবং দক্ষিণে অবস্থিত তিন দিক থেকে সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত শস্যশ্যামলা সমভূমি, বালুকাময় প্রান্তর, মালভূমি, গহীন অরণ্য, আর আছে অসংখ্য নদনদী ।
কোনো দেশের ভূপ্রকৃতি ও আবহাওয়া উক্ত দেশের মানুষের দৈহিক ও মানসিক গঠনের ওপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে । সাধারণভাবে শীতপ্রধান দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রমী, কষ্টসহিষ্ণু ও অনুকুল পরিবেশে জীবনধারণ করতে অভ্যস্ত হয়। তুলনামূলকভাবে নাতিশীতোষ্ণ দেশের মানুষ অপেক্ষাকৃত কম কঠোর পরিশ্রমী, কষ্টসহিষ্ণু ও প্রতিকুল পরিবেশে জীবনধারণে অভ্যস্ত হয়। নদীমাতৃক ভারত কৃষিকাজের উপযোগী জলবায়ু, উর্বর ভূমি, অপেক্ষাকৃত কম কঠোর পরিশ্রমে পর্যাপ্ত কৃষিপণ্য উৎপাদনের ফলে ভারতের অর্থনীতি হয়েছে মূলত কৃষিভিত্তিক।
ভারতের ইতিহাসে হিমালয়ের ভৌগোলিক প্রভাব
হিমালয় ভারত উপমহাদেশকে উত্তরের হিমপ্রবাহ থেকে রক্ষা করেছে, তাই উত্তর ভারতের বিস্তৃত মালভূমি আবাসোপযোগী হয়েছে। হিমালয় থেকে সৃষ্টি হয়েছে উত্তর ভারতের প্রধান প্রধান নদী প্রবাহের। আর এই নদীর জলরাশিকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেছে উত্তর ভারতের কৃষি। দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহমান মৌসুমী বায়ু হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে দান করেছে বৃষ্টিপাত। উত্তর ভারতের মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণে হিমালয়ের প্রভাবকে স্বীকার করেই হিমালয় প্রাচীন ভারতীয়দের মানসে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে।
হিমালয় ও পশ্চিমের পার্বত্য সীমারেখার কারণে ভারতীয়দের মনে সৃষ্টি হয়েছে এক ভ্রান্ত নিরাপত্তার ধারণা। ভারতবাসী এই পার্বত্য সীমারেখাকে মনে করেছে অলঙ্ঘনীয়। আর ভ্রান্ত নিরাপত্তার ধারণার বশবর্তী হয়ে ভারতবাসী বিদেশী আক্রমণের কথা খুব একটা চিন্তা করেনি। তাই যুগে যুগে উত্তর-পশ্চিমের গিরিপথগুলো দিয়ে, বিশেষ করে খাইবার গিরিপথের মধ্য দিয়ে ভারত আক্রান্ত হয়েছে বিদেশীদের আক্রমণে। উত্তরপশ্চিমের পথ দিয়েই এসেছে আর্য প্রবাহ, এসেছে গ্রিক, কুষাণ, হুণ, আফগান, তুর্কি আর মোঙ্গল আক্রমণ। ভারত ভ্রান্ত নিরাপত্তা বোধ থেকে বারবারই ব্যর্থ হয়েছে বিদেশীদের প্রতিরোধ করতে।
ভারতের ইতিহাসে বিন্ধ্য পর্বতের প্রভাব
বিন্ধ্যের অবস্থান ভারতকে দুভাগে ভাগ করেছে- উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্য। উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ সমভূমি হয়েছে ইতিহাসের লালনক্ষেত্র। মানুষের কর্মকান্ডের প্রধান রঙ্গমঞ্চ। আর্যরা এসে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ধীরে ধীরে সমগ্র উত্তর ভারতকে পরিণত করেছে আর্যাবর্তে। বিন্ধ্যের দক্ষিণে সরে গিয়েছে দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ। দ্রাবিড় ভূমিতে পরিণত হয়েছে দাক্ষিণাত্য। ভারতের ইতিহাসে উত্তর আর দক্ষিণের মধ্যে যে বৈরিতা লক্ষ করা যায়, তা মূলত বিন্ধ্যের কারণেই। উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপনের পর চেষ্টা চলেছে দাক্ষিণাত্য অধিকারের। আবার দাক্ষিণাত্যের শক্তিশালী সাম্রাজ্য ও চেষ্টা চালিয়েছে উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তারে। উত্তর-দক্ষিণের মধ্যে সংঘর্ষ ভারতীয় ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।
ভারতের বিশালতার প্রভাব
ভারত একটি বিশাল উপমহাদেশ যার বিশালতার কারণে ভারতীয় ইতিহাসে সৃষ্টি হয়েছে কিছুটা অন্তর্মুখিতার। ভারত এত বড় ও বিশাল যে, ভারতের মধ্যেই সব সাম্রাজ্যবাদী অভিপ্রায় চরিতার্থ করার সুযোগ রয়েছে। তাই ভারতের সাম্রাজ্যবাদীদের ভারতের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করতে হয়নি। ভারতের বিশালতা আর ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের কারণে ভারতের ইতিহাসে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্য স্থাপনের প্রবণতা। বিশাল ভারতের বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক সত্তা। সেই আঞ্চলিক সত্তার উপস্থিতি ভারতের ইতিহাসের সব যুগেই লক্ষ করা যায়। আঞ্চলিক রাজনৈতিক সত্তার মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে আঞ্চলিক ভাষার আঞ্চলিক সংস্কৃতির। আঞ্চলিক সত্তাসমূহের বিলোপ সাধন করে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের অভিলিপ্সা যুগে যুগে ভারতের ইতিহাসের প্রধান লক্ষবস্তু হিসেবে প্রকাশ পেলেও একথা স্বীকার করতেই হয় যে, কখনোই সর্বভারতীয় ঐক্য স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। মৌলিক কিছু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঐক্য লক্ষ করলেও আঞ্চলিক বিভিন্নতা ভারতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। বৈচিত্র্যই ভারতীয় সংস্কৃতিতে এনেছে উৎকর্ষ।
ভারতের ইতিহাসে নদ নদীর ভৌগোলিক প্রভাব
সিন্ধু ও পঞ্চনদের জলরাশি সৃষ্টি করেছে উৎপাদনশীল পশ্চিম ভারতের সমভূমি। গঙ্গা-যমুনার সৃষ্ট উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ সমভূমি, গোদাবরী, কৃষ্ণা ও কাবেরী সৃষ্টি করেছে দাক্ষিণাত্যের মানব বসতির অনুকূল পরিবেশ। এছাড়াও আরো অসংখ্য নদীকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি ভিত্তিক মানব সমাজ। কৃষি অর্থনীতিই ছিলো ভারতে মানুষের সকল কর্মকান্ডের মূল ভিত্তি। পশ্চিম ভারতে সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ, পরবর্তী পর্যায়ে উত্তর ভারতে আর্য-সভ্যতার বিকাশ নদী বিধৌত এলাকাকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। দক্ষিণ ভারতের সাম্রাজ্যগুলোও গড়ে উঠেছিল মালভূমির উর্বরা ভূ-খন্ডে। উত্তর ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্য, কুষাণ সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য বা পুষ্যভৃতি সাম্রাজ্য সবই গড়ে উঠেছিল নদীবিধৌত সমভূমির ওপর আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। মধ্য যুগে দিল্লির সুলতানদের সাম্রাজ্যও সিন্ধু, গঙ্গা-যমুনা বিধৌত এলাকার ওপর আধিপত্যকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল। অবশ্য সমুদ্র-বাণিজ্য ভারতের সাম্রাজ্যবাদকে যুগে যুগে দিয়েছিল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। আর সমৃদ্ধির কারণেই উৎকর্ষ অর্জিত হয়েছিল বিভিন্ন শিল্পকলায়। ভারতের পশ্চিমে, দক্ষিণে ও পূর্বে অবস্থিত সমুদ্রের কারণে যে বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি সহজলভ্য হয়েছিল সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।